বিয়ে শুধু দু'জন নর ও নারী নয়, দু'টি পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সবার মাঝে সৃষ্টি হয় আনন্দ-উল্লাস। এটিই স্বাভাবিক।
বিয়েকে নিয়ে নানা আচার-অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। গায়ে হলুদ, ক্ষীর খাওয়া, কনের বাড়িতে অনুষ্ঠান, ঘরসাজানো, বৌভাত, নববধুকে সংবর্ধনা ইত্যাদি। আল্লাহর রসূল (সা)-এর সময়ে বিয়ে ছিল খুবই অনাড়ম্বর। সেসময়ে সাধারণত মসজিদে খেজুর বিতরণ বা একটু সচ্ছল হলে ছাগল জবেহ করে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং এসবই করা হয়েছে বরের পক্ষ থেকে। বর্তমানে কনের পরিবারের ওপর যে চাপ সেটি সে সময়ে ছিল না। কনের পরিবার স্বতঃস্ফূর্ত যা করে সেটিতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু কোনো কিছু বাধ্য করা বা চাপিয়ে দেয়া সুস্পষ্ট জুলুম।
বর্তমানে বিয়ে অনেক আড়ম্বরপূর্ণ হয়েছে। বিয়েকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজন, নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। দেশাচারও রয়েছে অর্থাৎ এক এক এলাকায় এক এক ধরনের আচার-অনুষ্ঠান। বৈধতার প্রশ্ন উঠালে আমার মতে সবই বৈধ যদি সেখানে বাহুল্য (অপচয়) ও অশ্লীলতা না থাকে।
ইসলামে হারাম সুনির্দিষ্ট, বাকি সবই হালাল। ফিতরাতের ধর্ম ইসলাম অনেক উদার, এর মাঝে কোনো সংকীর্ণতা নেই। ইবাদতের ক্ষেত্রে নতুনত্বকেই বিদয়াত বলে। এসব আচার-অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে বিদয়াতের কোনো সম্পর্ক নেই বরং পালনের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান লঙ্ঘিত হলে গুনাহ। আবার এর মাঝ দিয়ে ভালো কোনো মেসেজ দিতে পারলে রয়েছে ছওয়াব।
নববধু ও জামাই দেখার ঔৎসুক্য খুবই স্বাভাবিক। যেটি স্বাভাবিক আমার মতে সেটি বৈধ। তবে সাজসজ্জা করে প্রদর্শনী ও ফটোসেশানের যে কালচার সেটি সমর্থনযোগ্য নয়। বরং পর্দাবস্থায় (মুখ খোলা) একনজর দেখার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখি না। উদার, সার্বজনীন, কিয়ামত পর্যন্ত যে বিধান সে বিধানে সহজতা থাকাই স্বাভাবিক। অতি উত্তম, উত্তম, মুবাহ ইসলামে স্বীকৃত। রসূল (সা)-এর সময়ে আল্লাহর বিধান পালনে যতটুকু ছাড় ছিল তা দেয়ার ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ দ্বীনের জন্য কল্যাণকর নয়। বর্তমানে পর্দাহীনতার সয়লাবে পর্দা মেনে (সতর আবৃত করে) বিয়ে অনুষ্ঠানে যাওয়ার মধ্যে কোনো দোষ বা গুনাহ দেখি না।
পর্দা একটি ফরজ বিধান। পর্দা পালনের ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ বড় শৈথিল্য প্রদর্শন করে। আবার এটি নিয়ে বাড়াবাড়িও রয়েছে। আমি মনে করি নেকাবসহ পর্দা অতি উত্তম এবং পরিপূর্ণ সতর আবৃত করে যারা চলে তারাও প্রশংসার দাবীদার। দেড়খানা ইট দিয়ে বিল্ডিং নির্মাণ সম্ভব নয়। ব্যাপক নারী সমাজ যারা অফিস-আদালতে কর্মরত ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে তাদেরকে নেকাবসহ পর্দা পালনের ব্যাপারে যদি জোরাজোরি করা হয় তাহলে সেটিকে ফলপ্রসু করা কঠিন। বরং তাদেরকে সতর আবৃত করে চলার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারলে সেটি কার্যকর করা অনেকখানি সহজ।
বিয়ে অনুষ্ঠানে আপ্যায়ন একটি বড় অনুষঙ্গ। এব্যাপারে ত্রুটি-বিচ্যুতি খুব বড় করে দেখা হয়। বিশেষ করে মেয়ের বাড়ির ত্রুটি যেন ক্ষমার অযোগ্য। ইসলামের সোনালি যুগে মেয়ের পক্ষ থেকে এ জাতীয় আয়োজন লক্ষ্য করা যায় না। ছেলে মহরানা ও পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়ে সজ্জিত করে নিজ ঘরে নববধুকে আনবে, এটিই ছিল নিয়ম। সে সময়ে মেয়ের পরিবার ব্যবহার্য হালকা কিছু দিতেন। যেমন দিয়েছিলেন, প্রিয়তম নবী (সা) তাঁর মেয়েকে আলী (রা)- এর সাথে বিয়ে দেয়ার সময়।
বর্তমানে বিয়েসাদী শুধু নয় সবধরনের অনুষ্ঠানে বাহুল্য (অপচয়) একটি ফ্যাশান হয়ে পড়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয় সউদী আরবসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের একই চিত্র। অমুসলিম বিশ্বে এটি ধর্তব্যের বিষয় নয়। আশ্চর্যের বিষয় অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষও এব্যাপারে গাফেল। অথচ রসূল (সা) কত সতর্ক ছিলেন। আল্লাহর বাণী- 'তোমরা খাও, পান করো কিন্ত অপচয় করিও না'। অপচয়কারী সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, 'নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই'। আল্লাহর রসূল (সা) সাধারণত দস্তরখানা বিছায়ে খানা খেতেন। কোনো খাদ্যকণা পড়ে গেলে উঠিয়ে খেতেন, খাওয়া শেষে প্লেট পরিষ্কার করে ও আঙুলগুলো চেটে খেতেন। অথচ তাঁর উম্মাহ ও আল্লাহর বান্দাহ বলে দাবিদারদের আচরণ কত ভিন্নধর্মী। অপচয়ের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার।
ইসলামের মৌলিক বিষয় হলো দ্বীন কায়েম। দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই দ্বীনের শরীয়ত চালু হয়ে যায়। আল্লাহপাক মদীনায় তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই শরীয়ত (আইন-বিধান-নিয়ম) প্রদান করেন। আমি অবশ্য বলছি না, শরীয়ত পালনকে গৌণ বিবেচনা করে দ্বীন পালনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। বরং যারা দ্বীন পালন করতে চায় (কর্মী) শরীয়ত পালনের বাধ্যবাধকতা তাদের যতখানি সাধারণের কাছে ততখানি নয়। তাদের কাছে দাওয়াতের মূল বিষয় হবে কালিমা তাইয়্যেবা এবং তারা যেন দ্বীনকে কঠিন করে উপস্থাপন না করে। শরীয়ত পালনের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো নয় বরং কারো মধ্যে দ্বীনের সঠিক উপলব্ধি আসলে সে শরীয়ত পালনে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠবে।
সামাজিক বিষয়াবলী নিয়ে আমি ভাবি। দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে আমি সহজ উপায়টি তালাশ করি এবং চেষ্টা করি সেটি মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে। ইসলাম কোনো কাঁচপাত্র নয় যা সহজে ভেঙ্গে যায়। আমরা সবকিছুতে গুনাহ তালাশ করি। গুনাহ তাই যা মানুষ আল্লাহর নাফরমানির লক্ষ্যে করে থাকে। যে কাজের পেছনে আল্লাহর নাফরমানির নিয়ত নেই বা অবাধ্যতা নেই সেটি গুনাহ নয়। আবার কোনো কারণে আল্লাহর নাফরমানি হয়ে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিক ফিরে আসলে সে আর শাস্তিযোগ্য থাকে না। আমরা যেন জেনে-বুঝে আল্লাহর নাফরমানি না করি ও পৌনঃপুনিক না করি সেই তাওফিক আল্লাহ আমাদের দান করুন। আমিন। ১৮.১০.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment