আমার দেখা সেরা কলেজসমূহের অন্যতম এম এম কলেজ, যশোর। এই কলেজে ২৫.০৪.২০০৪ হতে ১৭.০৩.২০০৯ পর্যন্ত সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ লাভ করায় নিজেকে ধন্য মনে করি। ঐ কলেজ থেকেই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাই। শিক্ষার সুষ্ঠু ও নকলমুক্ত পরিবেশ, শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখা, রাজনীতিক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের প্রভাবমুক্ত চমৎকার পরিবেশ সে সময়টিতে লক্ষ্য করেছি। আমি ঐ কলেজে শিক্ষক পরিষদের দুই টার্ম সম্পাদক এবং বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির কলেজ ইউনিটের সভাপতি ছিলাম। সে সময়ে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন প্রফেসর টিএম জাকির হোসেন (বর্তমান অধ্যক্ষ, বয়রা সরকারি মহিলা কলেজ, খুলনা)।
এম এম কলেজে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপকের দু’টি পদ এবং একটি পদ খালি থাকা সত্ত্বেও আমাকে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে বদলী করা হয়। সেখানে মাত্র ৬ মাস চাকুরি করলেও আমি ও আমার পরিবার সেটি খুব উপভোগ করেছি। বিদায় গ্রহণের সময় দু’টি কলেজ থেকেই আমার সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীরা বর্ণাঢ্য সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। শিক্ষার্থীদের মাঝে যারা উদ্যোক্তা ছিল তাদের মাঝে অনেকের সাথে ফেসবুকে আমার যোগাযোগ রয়েছে। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আমি একটি বিশ্বাস লালন করি এবং সে অনুসারে চলার চেষ্টা করি। সেই বিশ্বাসটি হলো, ইসলাম আল্লাহপ্রদত্ত সর্বোত্তম জীবনব্যবস্থা এবং পরিপূর্ণভাবে ইসলাম অনুসরণের মধ্যেই দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ রয়েছে। আমার আমল-আখলাক, কথাবার্তা ও চলাফেরায় সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন অনেকে অনুভব করে। এম এম কলেজে শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর ১০.০৭.২০০৭ তারিখে অনুষ্ঠিত অভিষেক অনুষ্ঠানে আমার প্রদত্ত বক্তৃতাটি শেয়ার করতে চাই। হ্যাঁ, বক্তৃতায় আমার বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে। সে সময়ে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ মহোদয়ের মাঝে সম্পর্ক বেশ শীতল ছিল, বক্তৃতায় তারও কিছুটা প্রতিফলন রয়েছে। স্মৃতিকথা লেখার ইচ্ছা আমার রয়েছে এবং এসব তারই উপজীব্য।
শিক্ষক পরিষদের সভায় প্রদত্ত বক্তৃতা
শিক্ষক পরিষদের আজকের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পরম শ্রদ্ধাভাজন সভাপতি ও কলেজের সম্মানিত অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. জালাল উদ্দীন আহমেদ, শ্রদ্ধাভাজন সহ-সভাপতি ও সম্মানিত উপাধ্যক্ষ প্রফেসর কাদের হোসাইন চৌধুরী এবং শিক্ষক পরিষদের প্রাক্তন সম্পাদক, যুগ্ম-সম্পাদকসহ আমার শ্রদ্ধেয় সহকর্মীবৃন্দ। আসসালামু আলাইকুম।
আমার প্রতি আপনারা যে আস্থা ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন সেজন্য আমি প্রথমেই পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার দরবারে গভীর শুকরিয়া এবং আপনাদের প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। সাথে সাথে আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি আমার পূর্বসূরী প্রফেসর মো. আব্দুর রহমান, প্রফেসর ড. জালাল উদ্দীন আহমেদ, প্রফেসর নূর মোহাম্মদ, প্রফেসর মো. মিজানুর রহমান ও জনাব মো. মফিজুর রহমানসহ যাঁরা ইতোপূর্বে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদেরকে। আমি তাঁদের শারীরিক সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু এবং যাঁরা দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন তাঁদের মাগফেরাত কামনা করছি।
সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ। শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক হিসেবে আমার দায়িত্বের ব্যাপারে আমি পূর্ণ সচেতন। শিক্ষকদের মান-ইজ্জত-সম্মান অক্ষুন্ন রাখা এবং মুখপাত্র হিসেবে আপনাদের মনের কথা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন করার ব্যাপারে আমি সর্বদা সচেষ্ট থাকবো ইনশা-আল্লাহ। লেখাপড়াসহ কলেজের সার্বিক উন্নয়নে আপনাদেরকে সাথে নিয়ে অধ্যক্ষ মহোদয়কে সার্বিক সহযোগিতা দানের মাধ্যমে কলেজের ভাবমূর্তি সমুজ্জল রাখার ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা চালাবো। সাথে সাথে অধ্যক্ষ মহোদয়ের সাথে আপনাদের, আপনাদের পারস্পরিক, ছাত্র-শিক্ষক, শিক্ষক-কর্মচারী সকলের মধ্যে সৌহার্দ্রপূর্ণ সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য আমার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে ইনশা-আল্লাহ।
সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ। আমরা যারা এখানে দায়িত্ব পালন করছি তারা কখনও অভিভাবক ও কর্তৃত্বশীল আবার কখনও বা অধীন। যেমন, আমরা আমাদের বাসায় অভিভাবক ও কর্তৃত্বশীল আবার এখানে নিজ নিজ বিভাগ ও অধ্যক্ষ মহোদয়ের অধীন। আবার কর্মচারীরা আমাদের অধীন। আমরা যদি প্রত্যেকের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হই তাহলে আমাদের সম্পর্ক বিনষ্টের কোনো কারণ নেই। অভিভাবক ও কর্তৃত্বশীলদের অধিকার হলো অধীনস্থরা তাদের আনুগত্য ও সম্মান করবে এবং অধীনস্থদের অধিকার হলো অভিভাবক ও কর্তৃত্বশীলরা তাদেরকে স্নেহ ও আদর করবে এবং ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে দিবে। এ প্রসঙ্গে আমাদের মহান স্রষ্টা আল্লাহপাকের বাণী, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রসুলের আনুগত্য কর ও তোমাদের কর্তৃত্বশীলদের আনুগত্য কর। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যদি মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের দিকে ফিরে এসো।
আল্লাহর রসুল (সা) বলেন, ‘যে কর্তৃত্বশীলের আনুগত্য করলো সে আমার আনুগত্য করলো এবং যে আমার আনুগত্য করলো সে আল্লাহর আনুগত্য করলো। আর স্রষ্টার নাফরমানি করে সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই’। কর্তৃত্বশীলের বৈধ কাজে আনুগত্যকে আল্লাহর আনুগত্যের সাথে একাকার করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর্তৃত্বশীলের দায়িত্বের ব্যাপারেও তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে অধীনস্থদের নিকট উত্তম। দৈনিক ৭০ বার হলেও অধীনস্থদের ত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি নিকৃষ্ট যে অধীনস্থদের অপছন্দ করে এবং অধীনস্থরাও যাকে অপছন্দ করে’। মূলত পারস্পরিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই সম্পর্ক উন্নত হয়। সরকারি এম এম কলেজে আমরা সবাই মিলে একটি পরিবার এবং এ পরিবারের প্রধান হলেন আমাদের অধ্যক্ষ মহোদয়। এ পরিবারের সদস্য হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব হলো যথাযথভাবে অধ্যক্ষ মহোদয়ের আনুগত্য করা এবং বিনিময়ে আমরা অধ্যক্ষ মহোদয়ের নিকট থেকে স্নেহ ও প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার আশা করি।
সম্মানিত সাথী ও বন্ধুগণ। একটি পরিবারে বসবাস করতে গিয়ে পরিবারের প্রধানের সাথে সদস্যদের এবং সদস্যদের পারস্পরিক মনোমালিন্য হতেই পারে। এমনটি হলে আমাদের দ্রুত সংশোধন করে নেয়া উচিৎ। আমরা একদিকে আল্লাহর বান্দাহ, আবার সাথে সাথে তাঁর প্রতিনিধিও। আল্লাহপাক আমাদের প্রতি উদার ও সহনশীল বলেই আমরা টিকে আছি। আল্লাহ চান তাঁর বান্দাহরা তাঁরই মত হোক। এজন্যই বলা হয়েছে তোমরা আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হও। আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আমরাও আল্লাহর বান্দাহদের প্রতি উদার ও সহনশীল হব। তাঁর বাণী, ‘যে স্বীয় মনের সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করলো সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করলো’। কারো নিকট থেকে কষ্ট পেলে তার বিনিময় গ্রহণের অধিকার থাকলেও তা সকল সময় কাঙ্ক্ষিত নয়। আল্লাহপাক বলেন, ‘অন্যায়ের প্রতিবিধান সমপরিমাণ অন্যায় কিন্তু কেহ যদি ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে নেয় তার পুরস্কার আল্লাহর জিম্মায়’।
মন্দ আচরণের বিনিময় মন্দ দিয়ে নয় বরং ভালো আচরণের মাধ্যমে তার জবাব দিতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মন্দকে দূর কর সেই ভালো দ্বারা যা অতীম উত্তম, তাহলে দেখবে তোমার জানের দুশমনরা প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে’। কাজটা অবশ্য সহজ নয়-তাই তিনি বলেন, ‘এ গুণ কেবল তারাই অর্জন করতে পারে যারা অতীব ভাগ্যবান ও অতীব ধৈর্যশীল’। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)। রাস্তায় কাঁটা বিছানো সেই বুড়িকে অসুস্থতার সময় সেবাযত্ন দিয়ে তিনি সুস্থ করে তুলেন। এরপরও কি বুড়ির দুশমনি থাকতে পারে? তাই আসুন, আমরা সবাই পূর্বের সব কিছু ভুলে গিয়ে নিজেদের সম্পর্কটা আরও ঘনিষ্ট করি। আর যদি শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন হয়েই পড়ে তবে আমাদের উচিৎ তাড়াহুড়া না করা। আল্লাহপাক মানুষকে শাস্তি দানের জন্য অন্তত মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।
সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ। বাংলাদেশে চলছে গণতন্ত্রের সংকট। গণতন্ত্র মানে হলো মিলে-মিশে কাজ করা। অপরের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও সহনশীল আচরণ করা। নিজ মতে জিদ না ধরে সকলের মতকে আপন করে নেয়া। আমাদের বিশ্বাস হলো নবী-রসুলরা ভুল-ত্রুটির ঊর্দ্ধে। তারপরও আল্লাহপাক তাঁর রসুল (সা)-কে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তুমি তোমার সঙ্গী-সাথীদের সাথে পরামর্শ করো এবং যে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় তার ওপর অবিচল থাক’। কুরআন মজিদে একটি সূরার নামকরণ হয়েছে আস-শূরা (পরামর্শ)। যেখানে আল্লাহপাক তাঁর অনুগত বান্দাহদের পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে ‘তারা তাদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে’।
জীবনের সকল ক্ষেত্রেই অর্থাৎ পরিবার, সমাজ, বিভাগ যেখানেই একাধিক ব্যক্তির স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেখানেই পরামর্শ। পরিবারে স্ত্রীর সাথে এবং ছেলে-মেয়ে বড় হলে তাদেরকেও পরামর্শে শরীক করা হলে পরিবারে অবশ্যই শান্তি বিরাজ করবে। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এই নীতি অবলম্বনের ফলে আমি আল্লাহর মেহেরবানীতে তার সুফল পাই। আমার পরিবারে তেমন সচ্ছলতা নেই। এমন কি আমার স্ত্রীর এক ভরি স্বর্ণও নেই বা আমার স্ত্রীকে পাঁচশত টাকা দামের শাড়ী দিয়েছি কবে তাও তেমন একটা মনে পড়ে না। তবুও আমি দাবী করতে পারি, পৃথিবীর সুখী দম্পতিদের আমরা একজন।। এর মূলে রয়েছে পরস্পরের মতের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ। পরামর্শের ক্ষেত্রে অবশ্যই পরামর্শের নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। নিজের মতটা বিনয়ের সাথে পেশ করতে হবে, কোনো হৈ-চৈ চিৎকার করে নয় বা নিজের মতে জিদ ধরেও নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতটাকে নিজের মত হিসেবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিতে হবে। সরকারি এম এম কলেজ শিক্ষক পরিষদ সভাকক্ষ আমাদের পার্লামেন্ট। আমরা উত্তম পন্থায় এখানে বিতর্ক করবো এবং গৃহিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে হবো আন্তরিক। তাহলেই আমরা সফলকাম হবো। আর একটি বিষয় সম্পর্কে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তাহলো চাটুকারিতা ও গীবৎ। এ দু’টি অত্যন্ত ঘৃণ্য। এতে অভ্যস্তরা কারো বন্ধু হতে পারে না। হাদীসে এ দু’শ্রেণিকেই অত্যন্ত ঘৃণা করা হয়েছে। সম্পর্ক বিনষ্টের ক্ষেত্রে গীবতের কোনো জুড়ি নেই। আমরা নিজেরা এ থেকে বিরত থাকি এবং অন্যদেরকেও বিরত থাকতে সহায়তা করি।
সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ। আসুন আমরা গণতান্ত্রিক চর্চা ও অপরের অধিকার যথাযথভাবে আদায়ের মাধ্যমে আমাদের কর্মস্থল এম এম কলেজের এ পবিত্র অংগনকে শান্তি ও স্বস্তির স্থানে পরিণত করি। আল্লাহপাক আমাদেরকে সে তাওফিক দান করুন। আমি আমার পূর্বসূরী সদ্য বিদায়ী সম্পাদকসহ তার পরিষদকে যথাযথ দায়িত্ব পালনের জন্য অভিনন্দন ও আমার প্রতি আস্থা প্রদর্শনের জন্য আবারও আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment