বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
বরেণ্য আলেমদের সমন্বয়ে ‘সমাজ জীবনে জুম’আর খুতবার প্রভাব ও খতিবদের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপনের সুযোগ পাওয়ায় মহান আল্লাহপাকের দরবারে জানাই লখো শুকরিয়া। আলহামদু লিল্লাহ।
দরুদ ও সালাম প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ওপর যাঁর মাধ্যমে আল্লাহপাক দয়া করে আমাদেরকে হেদায়াত দান করেছেন। নবী মুহাম্মদ (সা)-কে অনুসরণের ক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রগামী সেই সাহাবায়ে কেরাম (রা) ও সকল নেক বান্দাদের প্রতি আল্লাহর রহমত ও করুণা কামনা করে আমার প্রবন্ধ পাঠ শুরু করছি।
আজকের এই সেমিারের মাননীয় সভাপতি, মডারেটর, বিজ্ঞ আলোচকবৃন্দ, সেমিনার আয়োজনে নেপথ্যে যারা দায়িত্ব পালন করছেন এবং শ্রদ্ধেয় শ্রোতৃমন্ডলি।
খুতবা অর্থ বক্তৃতা, ভাষণ। মানুষকে স্বমতে আনা বা কোনো আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে বক্তৃতার রয়েছে যাদুকরী শক্তি। মানুষের জন্য হেদায়াত মহাগ্রন্থ আল কুরআন বক্তৃতা আকারেই অবতীর্ণ হয়েছে। রসূলুল্লাহ (সা) মানুষের কাছে বক্তৃতার মাধ্যমেই কুরআনকে পেশ করেছেন। আরবী ভাষায় নাযিলকৃত আল কুরআন সহজেই আরববাসীদের মন জয় করতে সক্ষম হয়। যারাই একবার কুরআন শুনতো তাদের অন্তরে কুরআন রেখাপাত করতো। তাই ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঠেকানোর লক্ষ্যে শত্রুদের লক্ষ্য ছিল কুরআন শোনা বন্ধ করা। রসূল (সা) কুরআন তেলাওয়াত করলে তারা হট্টগোল করতো ও নানাভাবে বাধা দিত। ইসলামের দুশমনদের এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। আল্লাহও কঠোর ভাষায় তাঁর দুশমনদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমি অবশ্যই এই কাফিরদের কঠিন আযাবের স্বাদ আস্বাদন করাবো’।
মক্কা থেকে হিজরতের পরে রসূলুল্লাহ (সা) কুবাতে প্রথম জুম’আ আদায় করেন। সেখানে সামান্য বিরতিসহ দু’টি খুতবা দেন এবং সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। সাপ্তাহিক জুম’আর খুতবা, বছরে দুই ঈদ ও হজ্জের মতো বিশ্ব সম্মেলনে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে খুতবা প্রদান ইসলামের প্রচার, প্রসার ও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার এক অপূর্ব সুযোগ। দুর্ভাগ্য, সবই এখন গতানুগতিক ও নিয়ম রক্ষায় পরিণত হয়েছে। মসজিদ একটি হেদায়াত কেন্দ্র ও আমাদের শক্তির উৎস এবং সেখানে বাধ্যতামূলক উপস্থিতি ও মনোযোগের সাথে খুতবা শ্রবণের মাঝে যে কতো শক্তি, তা উপলব্ধি করতে আজ আর আমরা সক্ষম নই। কথা শোনানোর লক্ষ্যে কয়েকজন লোককে একত্রিত করতে কতো কাঠখড় পোড়াতে হয়। স্থান নির্বাচন, ভাড়া প্রদান, দাওয়াত দান, আপ্যায়ন আরো কতো কী? অথচ মসজিদে সাপ্তাহিক জুম’আর সমাবেশ হয় স্বতঃস্ফুর্ত এবং বক্তৃতা শোনায় কতো আন্তরিক ও মনোযোগী।
বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মসজিদ রয়েছে এবং এ-সব মসজিদে নিয়মিত নামায ও খুতবা হয়। শহরের সীমিত মসজিদ ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্রেফ নিয়ম রক্ষার্থে খুতবা হয়ে থাকে। অধিকাংশ মসজিদে তিনটি খুতবা হয়। প্রথমে বাংলায় আলোচনা, যেটিকে খুতবার মর্যাদা দেয়া হয় না। ফলে সেটি শোনার যে বাধ্যবাধকতা তা তারা অনুভব করে না। ২/১টি ব্যতিক্রম ছাড়া খুবই স্বল্প পরিমাণ মুছল্লির উপস্থিতিতে খতিব মহোদয় বক্তৃতা করেন। আমাদের সমাজে অধিকাংশ মসজিদে বাংলা খুতবার পরে চার রাকাত সুন্নাত নামায পড়ার নিয়ম রয়েছে। অনেক মুছল্লির লক্ষ্য থাকে চার রাকাত সুন্নাত পড়ার। তাই অনেকে বাংলা খুতবা উপেক্ষা করে। সুন্নাত পড়ার এই সুযোগ খতিবের বাংলা বক্তৃতা শোনার গুরুত্ব হ্রাস করেছে।
মসজিদে উপস্থিতির ব্যাপারেও রয়েছে চরম শৈথিল্য। বাংলা বক্তৃতা খুতবার মর্যাদা পায় না, আর আরবী খুতবা মানুষ বুঝে না। তাই স্বল্পসংখ্যক ছাড়া অধিকাংশ মসজিদে (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে) একামতের পূর্ব দিয়ে মুছল্লিরা হাজির হয়। খুতবা অর্থ ভাষণ/বক্তৃতা, অবশ্যই তা মানুষের বোধগম্য হওয়া উচিত। খুতবার মূল উদ্দেশ্য মানুষকে নছিয়ত করা, সদুপদেশ দান। খুতবার ভাষা না বুঝলে খুতবার উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই, হয় সব মুছল্লিকে আরবী জানতে হবে নয়তো খুতবা মাতৃভাষায় হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইতোপূর্বে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জার্নালে প্রকাশিত ‘মাতৃভাষায় খুতবা দান’ একটি আর্টিকেল পড়েছিলাম। এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না এবং ভালো মনেও নেই। সম্ভবত লেখাটি ছিল প্রফেসর ড. এ এইচ এম ইয়াহ্ইয়ার রহমান স্যারের।
খুতবায় অবশ্যই আল্লাহর প্রশংসা ও রসূল (সা)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম থাকতে হবে। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ‘যে কথার শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করা হয় না তাতে কোনো কল্যাণ নেই’-আবু দাউদ ও আহমদ। দেশবরেণ্য আলেম মাওলানা কামালুদ্দিন জাফরী কাঁটাবন মসজিদে রসূল (সা)-এর সুন্নাহ মোতাবেক দু’টি খুতবা শুরু করেছিলেন এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। আলহামদু লিল্লাহ।
কাঁটাবন মসজিদে আযানের পর খতিব মহোদয় মিম্বরে আরোহণ করে খুতবা/ভাষণ শুরু করেন এবং সামান্য বিরতি শেষে ছানি খুতবার পর সেখানে একামত হয়। সুন্নাত/নফল যা পড়ার তা খুতবার পূর্বেই পড়তে হয়। পরে পড়ার কোনো সুযোগ থাকে না। সম্প্রতি ধানমন্ডি তাকওয়া মসজিদেও এমনটি লক্ষ্য করলাম। ইসলামের সোনালী যুগে এমনটিই ছিল। জুম’আর দিন যেন আমাদের ঈদের দিন। গোসল করে ভালো পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে মসজিদে উপস্থিত হওয়া জুম’আর দিনের অন্যতম কাজ এবং দু’রাকাত নামায আদায় শেষে মিম্বরের কাছাকাছি বসাটাই নিয়ম।
রসূলুল্লাহ (সা) মসজিদে উপস্থিতির ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে উট, গরু, ছাগল, মুরগি ও ডিম কুরবানির ছওয়াবের কথা উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, খুতবা শুরু হওয়ার সাথে সাথে ফেরেশতারা ছওয়াব লেখা বন্ধ করে দিয়ে খুতবা শোনা শুরু করেন। এতে উপলব্ধি করা যায়, মুছল্লিরা খুতবা শুরুর পূর্বেই মসজিদে উপস্থিত হবেন। খুতবা নামাযেরই অংশ। নামাযে যে সব কাজ নিষিদ্ধ খুতবার মাঝেও তা নিষিদ্ধ। এমন কি কেউ কথা বললে ভাই চুপ করো তাও বলা যায় না। খুতবার মাঝে কথা বললে সে জুম’আর ছওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়। যে কথা বলে সে যেন জুম’আ নয় যোহর আদায় করলো। এতো মনোযোগের সাথে বক্তৃতা শ্রবণ আর কোথাও পাওয়া যায় না। অথচ এমন সুযোগ কাজে লাগাতে মুসলমানরা ব্যর্থ হচ্ছে। আমি নিজে যে মসজিদে নামায আদায় করি, চেষ্টা করি খুতবা শ্রবণের পাশাপাশি তা শ্রুতিলিখন হিসেবে ফেসবুকে শেয়ার করার।
খুতবা/বক্তৃতা দানের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং অন্যায়-অনাচার থেকে বিরত রাখা। সমসাময়িক ঘটনাবলী অবশ্যই আলোচনায় আসবে। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল বিষয়ে খতিব মহোদয় তাঁর মুছল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। সামাজিক অবিচার, শোষণ, বঞ্চণা ও দুর্নীতি রোধে খতিব মহোদয় জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি হবেন একজন সাহসী ব্যক্তি এবং হক কথাগুলো হিম্মত ও যোগ্যতার সাথে বলা তাঁর দায়িত্ব। মসজিদ আবাদকারীদের অন্যান্য গুণাবলীর সাথে আল্লাহপাক এ কথাও বলেছেন, ‘তারা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না’-সূরা তাওবা ১৮। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বল্পসংখ্যক ছাড়া অধিকাংশ মসজিদে খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালনে যোগ্য লোকের বড় অভাব।
বাংলাদেশে মসজিদগুলোর পরিচালনা স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে হয়ে থাকে এবং এখানে কোনো সরকারি সহযোগিতা নেই। ফলে মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমের সম্মানী অতি নগণ্য। এছাড়াও মসজিদ কমিটি ও মুছল্লিদের দৃষ্টিভঙ্গিও খুব সংকীর্ণ। মসজিদের খেদমতে নিয়োজিতদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে তারা বড় কৃপণ। অথচ মসজিদ চাকচিক্য করা, শীততাপনিয়ন্ত্রিত করা, টাইলস লাগানো ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে তাদের আগ্রহের কমতি নেই। মসজিদের উন্নয়নে অর্থব্যয়ে মুছল্লিরাও বড় উদারহস্ত। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মসজিদ আবাদ করার লক্ষ্যে যোগ্য খতিব-ইমাম-মুয়াজ্জিন নিয়োগ দেয়া তাই সম্ভব হয়ে উঠে না। অথচ আল্লাহপাক দানের ক্ষেত্রে এই শ্রেণির মানুষকে অগ্রাধিকার দানের জন্য বলেছেন। আল্লাহর বাণী-
‘বিশেষ করে এমন সব গরীব লোক সাহায্য লাভের অধিকারী, যারা আল্লাহর কাজে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত অর্থোপার্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারে না এবং তাদের আত্মমর্যাদাবোধ দেখে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে সচ্ছল মনে করে। তাদের চেহারা দেখেই তুমি তাদের ভেতরের অবস্থা জানতে পারো। মানুষের পেছনে লেগে থেকে কিছু চাইবে, এমন লোক তারা নয়। তাদের সাহায্যার্থে তোমরা যা কিছু অর্থ ব্যয় করবে, তা আল্লাহর দৃষ্টির অগোচরে থাকবে না’-বাকারা ২৭৩।
গ্রামে-গঞ্জে হাজারো মসজিদ ছড়িয়ে আছে এবং এ-সব মসজিদে যারা খেদমতে নিয়োজিত তারা খুব সামান্যই সম্মানী পেয়ে থাকেন। ফলে তাদের যোগ্যতার বিকাশ সাধন ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিসহ খুতবাহ দানের আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলে।
বাংলাদেশে অধিকাংশ মসজিদে ইমাম ও খতিব একই ব্যক্তি। ইসলামে মসজিদ ও ইমামের যে মর্যাদা তা আমরা কমই উপলব্ধি করি। যেখানে মুসলমানদের বাস সেখানেই মসজিদ। আল্লাহর রসূল (সা) মদীনায় হিজরত করার পর নিজের বাড়িঘরের চিন্তা না করে প্রথমেই গড়ে তুলেছিলেন একটি মসজিদ। এই মসজিদ নামাযের স্থান হওয়ার সাথে সাথে ছিল মুসলমানদের কম্যুউনিটি সেন্টার (সমাবেশস্থল)। রসূল (সা)-এর হাতেগড়া মসজিদ ছিল তাঁর সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। সেটি ছিল তাঁর সচিবালয়, বিচারালয়, বিপদগ্রস্তদের আশ্রয়স্থল এককথায় সবকিছু সেখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ইবাদত-বন্দেগী যত একাকী ও নিভৃতে হয় তাতে ততো বেশি ছওয়াব। কিন্তু ফরজ নামায তার ব্যতিক্রম। ওজর ছাড়া ফরজ নামায জামায়াতের সাথেই আদায় করতে হয়। এমন কি একজন অন্ধ সাহাবী উম্মে মাকতুম (রা)-কেও জামায়াত ত্যাগ করার অনুমতি দেয়া হয়নি।
জামায়াতে নামায আদায়ের মধ্য দিয়ে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ইমাম/নেতার আনুগত্যের প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়। নামাযে মুক্তাদির কোনো ভুল নেই, ভুল রয়েছে কেবল আনুগত্যের ক্ষেত্রে। ইমামের আনুগত্যের ক্ষেত্রে সামান্যতম বিচ্যুতি মুক্তাদির নামায নষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট। ইমামের আনুগত্যের একটি সীমাও এখানে বলে দেয়া হয়েছে। ইমাম ফরজ লঙ্ঘন করলে সেই ইমামের কোনো আনুগত্য নেই। ইমামের ওয়াজিব ছুটে গেলে সাহু সেজদার মাধ্যমে তা সংশোধন করে নিতে হয়। এরপরে সুন্নাত-মুস্তাহাবের ভুল ধর্তব্যের মধ্যে নয়। উম্মাহর মাঝে যে মতপার্থক্য ও ঝগড়া-ঝাটি তা সবই সুন্নাত-মুস্তাহাব নিয়ে, অথচ নামাযের মতো ইবাদত সুন্নাত-মুস্তাহাবকে বিবেচনার বাইরে সম্পন্ন হয়ে যায়। এ থেকে যদি উম্মাহ শিক্ষা গ্রহণ করতো তাহলে দলাদলি ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে উম্মাহ সহজেই রেহাই পেতে পারতো।
দ্বীনকে জানা-বোঝার ক্ষেত্রে বর্তমানে হাজারো উপায় সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠাসহ ডিজিটাল যুগে ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে মানুষ সহজেই দ্বীনকে জানতে পারে। তারপরও আমি বলবো, একক উপায় হিসেবে বক্তৃতা শ্রবণ (সেটি হতে পারে জুম’আর খুতবা, ওয়াজ মাহফিল, তাফসির মাহফিল, আলোচনা সভা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদি) অনন্য, এর কোনো তুলনা নেই। বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষ সহজেই অনুপ্রাণিত হয়। জুম’আর খুতবা আল্লাহর রসূল (সা)-এর প্রবর্তিত এবং উম্মাহর জন্য খুতবা শ্রবণ ওয়াজিব। উদ্দেশ্য হলো মানুষকে দ্বীনের পথে অনুপ্রাণিত করা, ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা। দ্বীনকে জানা-বোঝার ক্ষেত্রে গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে থাকা হাজারো মসজিদ অনন্য ভূমিকা পালন করছে। মুছল্লিদের মধ্যে উপলব্ধির ঘাটতির কারণে কাঙ্ক্ষিত ফললাভ সম্ভব না হলেও সমাজজীবনে মসজিদ ও ইমাম/খতিবের প্রভাব এখনো কম নয়। আলহামদু লিল্লাহ।
জুম’আর খুতবা থেকে কাঙ্ক্ষিত ফললাভের জন্য নিম্নরূপ সুপারিশ পেশ করা যায়।
১. তিন খুতবার পরিবর্তে সুন্নাহ মোতাবেক দু’টি খুতবার প্রচলন।
২. খতিব মহোদয়ের মিম্বরে আরোহণের পূর্বে মুছল্লিদের মসজিদে উপস্থিত হওয়া। এব্যাপরে উট, গরু, ছাগল, মুরগি ও ডিম কুরবানির ছওয়াব থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়ে মুছল্লিদেরকে অবহিত করা।
৩. খুতবায় আল্লাহর হামদ, রসূলের (সা) শানে দরুদ এবং কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতির মাধ্যমে মুছল্লিদের নছিয়ত করা। বক্তৃতার মাঝে সমসাময়িক ঘটনার উল্লেখ, প্রতিবাদ ও আল্লাহর কাছে চাওয়ার উল্লেখ থাকা এবং খতিবের সাথে মুক্তাদিদের আমিন আমিন বলা।
৪. খুতবার উদ্দেশ্য যেহেতু নছিয়ত করা, তাই খুতবা মানুষের বোধগম্য ভাষায় অর্থাৎ মাতৃভাষায় হওয়া উচিত।
৫. খুতবা শেষ হওয়ার সাথে একামত ও নামায আদায় করা। বর্তমানে প্রচলিত চার রাকাত সুন্নাত নামাযের সময়দান বন্ধ করা। হাদিসে লক্ষ্য করলাম, খতিবের মিম্বরে আরোহণের পূর্বে মুছল্লিরা ইচ্ছামত নামায পড়তে পারে। আর নামায না পড়ে থাকলে খুতবা শুরু হওয়ার পরে বড়জোর দু’রাকাত নামায পড়ার সুযোগ রয়েছে।
খতিবদের করণীয় :
১. ইমাম/খতিব ও মুক্তাদির সম্পর্ক অনেকখানি নেতা ও কর্মীর মতো। ইমামের আনুগত্যের একটি মহড়া এখানে প্রদান করা হয় এবং এর মাধ্যমে ইমামের মর্যাদাও তুলে ধরা হয়। ইসলামের সোনালী যুগে মসজিদ ও সমাজের ইমামের মাঝে কোনো পার্থক্য ছিল না। যিনি মসজিদের ইমাম তিনি ছিলেন সমাজেরও ইমাম। মুছল্লিদের মাঝে এই উপলব্ধি দান খতিব মহোদয়কেই করতে হবে।
২. খতিবের দায়িত্ব হলো তাঁর মুক্তাদিদের প্রশিক্ষিত করা।
৩. সমসাময়িক ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হওয়া ও তা মুছল্লিদের সামনে পেশ করা।
৪. ইসলামের মৌলিক বিষয় ফরজ-ওয়াজিব ও হারাম-হালাম সম্পর্কে অবহিত করা। সমাজ থেকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, যিনা-ব্যাভিচার ও নানাবিধ পাপাচার বন্ধের লক্ষ্যে মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করা।
৫. মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।
৬. কুরআন, হাদিস, ফিকাহ ও সমসাময়িক বিষয়ে নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা।
৭. সমাজ থেকে বিদয়াত দূরীকরণে কৌশলী ভূমিকা রাখা। বিতর্ক সৃষ্টি করে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।
৮. মাজহাবগত বিরোধে সহনশীল হওয়া। খতিবের অধীনে সবশ্রেণির মানুষ নামায আদায় করে। কাউকে আহত করে কথা বলা হেকমতের খেলাপ। অবশ্য সুদ, ঘুষ, যিনা-ব্যাভিচার ও পাপাচারের বিরুদ্ধে কথা বলা ভিন্ন।
৯. খুতবা শ্রুতিমধুর, মার্জিত, সাবলীল, সহজবোধ্য, সুশৃঙ্খল, সুস্পষ্ট ও নাতিদীর্ঘ হওয়া উচিত।
১০. খুতবা উচ্চকণ্ঠে, সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্ব সহকারে দেয়া বাঞ্ছনীয়। অল্প কথায় ব্যাপক বক্তব্য রাখার যোগ্য শব্দ চয়ন, রুচিশীল, সহজ ও প্রাঞ্জল হওয়া উচিত। রসূলুল্লাহ (সা) যখন খুতবা দিতেন, তখন তাঁর চোখ লাল হয়ে যেতো, কণ্ঠ উঁচু হতো এবং আবেগে উদ্দীপ্ত থাকতেন।
১১. খুতবার ভাষা অভদ্র ও অরুচিকর হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা তাতে শ্রোতার মনে প্রভাব বিস্তার করে না এবং তাতে খুতবার উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না।
আল্লাহপাক আমাদেরকে জুম’আর সালাত ও খুতবাহ থেকে উপকৃত হয়ে দ্বীনের পথে অগ্রসর হওয়ার তাওফিক দান করুন। কষ্ট করে আমার প্রবন্ধ পাঠ শোনার জন্য আয়োজক ও শ্রোতৃমন্ডলিকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী, উপাধ্যক্ষ (অব), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment