মহান স্রষ্টা প্রতিটি জীবকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে সর্বোত্তম কাঠামোয় এবং জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক দান করেছেন। আল্লাহপাক নারী জাতিকে চেহারায় সৌন্দর্য, স্বভাবে কোমলতা এবং কণ্ঠে মাধুর্য দিয়েছেন।
নর ও নারীর মধ্যে তীব্র আকর্ষণ প্রকৃতিজাত। এ কারণেই মানুষ পরস্পর ঘর বাঁধে ও একত্রে জীবন-যাপন করে। নর ও নারী পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং পরিপূরক। একে অপরের অভাবে জীবনটা হয়ে পড়ে নিরানন্দের এবং দু’য়ের সমন্বয়েই আসে পূর্ণতা, সুখ ও আনন্দ।
মানুষের প্রকৃতিতে লজ্জা-শরম ও ন্যায়-অন্যায়বোধ স্বাভাবিক। এ ছাড়াও মানুষ যাতে সুখি ও সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে সেজন্য স্রষ্টার পক্ষ থেকে বিধানও দেয়া হয়েছে।
নর ও নারীর শারীরিক গঠনপ্রক্রিয়ায় পুরুষকে করা হয়েছে বহিরাঙ্গনের উপযোগী করে এবং সংসারের সকল দায়-দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হয়েছে।
আর নারীকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শরীর কাঠামো ও অসীম ধৈর্য, সহনশীলতা, কষ্ট সহিষ্ণুতা দান করা হয়েছে যার ফলে সন্তান গর্ভে ধারণ, জন্মদান, দুগ্ধপান ও লালন-পালনের মত গুরু দায়িত্ব পালন তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
একজন নারী তার শিশু অবস্থা থেকে একটা স্বাতন্ত্র নিয়ে বেড়ে ওঠে। তার খেলাধুলার উপকরণ পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল, মিছা-মিছি রান্না-বান্না ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে একজন পুরুষ শিশুর আচরণ ও খেলার উপকরণ নারী শিশু থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। প্রকৃতিপ্রদত্ত পার্থক্য মেনে নিয়ে উভয়ের যোগ্যতা-কর্মক্ষমতা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে নর ও নারীকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না এনে পরস্পরকে পরিপূরক করে মানব সমাজের উন্নয়নই স্রষ্টার অভিপ্রায়।
আল্লাহর ভাষায়, ‘ঈমানদার নর ও নারী পরস্পরের বন্ধু ও সাথী’-সূরা তাওবা : ৭১
সুন্দর জীবন-যাপনের লক্ষ্যে তিনি নর ও নারী উভয়ের জন্যই বিধান দিয়েছেন। গৃহ নারীর উত্তম কর্মক্ষেত্র হওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে এবং এ জন্যই মূলত পর্দার বিধান।
পর্দা অর্থ আবরণ। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সাঃ) নির্ধারিত পোশাক।
আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্যে পোশাক নাযিল করেছি যেন তোমাদের দেহের লজ্জাস্থানসমূহকে ঢাকতে পার। এটা তোমাদের জন্যে দেহের আচ্ছাদন ও শোভাবর্ধনের উপায়, সর্বোত্তম পোশাক হলো তাকওয়ার পোশাক। তা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। সম্ভবত লোকেরা তা হতে শিক্ষা গ্রহণ করবে’-সূরা আরাফ : ২৬
আমাদের স্রষ্টা, মনিব-মালিক মহান আল্লাহ বলেন একজন ভদ্র ও শরীফ নারীকে চেনা ও তার মর্যাদা সমুন্নত রাখার উপায় হলো তার পোশাক।
তাঁর বাণী, ‘হে নবী! তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ এবং মু’মিন মহিলাদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চিনতে পারা যায় ও ফলে তাদেরকে সহজে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’-সূরা আহযাব : ৫৯
পর্দার বিধান নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! মু’মিন পুরুষদেরকে বলে দাও, তারা যেন নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে চলে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হিফাযত করে। এটা তাদের জন্যে উত্তম। যা তারা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে পুরোপুরি অবহিত’-সূরা নূর : ৩০
তিনি আরো বলেন, ‘আর হে নবী! মু’মিন স্ত্রীলোকদেরকে বল, তারা যেন নিজেদের চোখকে নিম্নগামী রাখে, নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হিফাযত করে ও নিজেদের সাজ-সজ্জা না দেখায়; কেবল সেসব জিনিস ছাড়া যা আপনা হতে প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং নিজেদের বুকের ওপর ওড়নার আঁচল ফেলে রাখে’- সূরা নূর : ৩১
কুরআনের উদ্ধৃতির মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে পর্দার বিধান আল্লাহর। তাঁর ভাষায় একজন সতী-সাধ্বী-চরিত্রবতী নারীর পরিচয় ফুটে ওঠে পর্দার মাধ্যমে এবং সে অবস্থায় কোন বখাটে কর্তৃক উত্যক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না।
পর্দা নারীর ভূষণ ও তার নিরাপত্তার গ্যারান্টি। পর্দার কোন ধরন বা কাটিং বলে দেয়া হয়নি, বরং বলা হয়েছে নিজেদের ছতর বা লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে এবং যা আপনা থেকে প্রকাশিত হয়ে পড়ে সেটা ছাড়া সবকিছু আবৃত করে রাখতে।
ফকীহদের মতে মুখমন্ডল, হাতের কব্জি ও পায়ের পাতা ব্যতিত নারীর সমগ্র শরীর ছতর। আজ নারী তার কর্মক্ষেত্রে, চলাফেরায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানাভাবে উত্যক্ত হচ্ছে এবং এর মূলে রয়েছে পর্দাহীনতা।
নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে পরস্পরে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়ছে এবং তাতে দাম্পত্য জীবনে সৃষ্টি হচ্ছে কলহ। যার ফলশ্রুতিতে আত্মহত্যা ও তালাক প্রবণতাও বাড়ছে এবং তথাকথিত প্রগতিশীলদের মাঝেই এ সামাজিক সমস্যা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
একটি মধুর দাম্পত্য জীবন ইসলামে একান্তভাবে কাম্য। এজন্য নারী ও পুরুষ উভয়েরই আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা একান্ত অপরিহার্য।
উচ্চবিত্ত পরিবারে প্রায়ই দেখা যায় স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের সাথে আড্ডা না দিয়ে পুরুষটাকে দীর্ঘরাত ক্লাবে কাটাতে।
অথচ বিনোদনের জন্য নিজ গৃহই একজন মু’মিনের সর্বোত্তম স্থান হতে পারে। অফিসে, কারখানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী ও পুরুষের একান্তে কাজ করা বিপদজনক।
রসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘দু’জন নারী ও পুরুষ যখন নিভৃতে মিলিত হয় তখন তৃতীয় জন হিসেবে উপস্থিত থাকে শয়তান’।
সকল কর্মক্ষেত্রে নারীর উপযোগী কর্মপরিবেশ দাবী করা তার অধিকার এবং তার ব্যবস্থা করা কর্তৃপক্ষের একান্ত কর্তব্য। ইসলামে যিনা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক।
কুরআনের নির্দেশ-‘যিনার ধারে-কাছেও যেও না’। অর্থাৎ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে হেফাযত করা।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত রসূল (সাঃ) বলেন, ‘আদম সন্তানের জন্য ব্যাভিচারের একটি অংশ নির্দিষ্ট করা আছে। এটা সে নিঃসন্দেহে পাবেই। দু’চোখের যিনা পর স্ত্রীর প্রতি নযর করা, দু’কানের যিনা হলো যৌন উত্তেজক কথাবার্তা শ্রবণ করা, মুখের যিনা হলো আলোচনা করা, হাতের যিনা স্পর্শ করা, পায়ের যিনা ঐ উদ্দেশ্যে যাতাযাত করা। অন্তর ঐ কাজের প্রতি কুপ্রবৃত্তিকে জাগ্রত করে এবং তার আকাঙ্খা সৃষ্টি করে। আর যৌনাঙ্গ এমন অবস্থা সত্যায়িত বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে’-বুখারি ও মুসলিম।
যিনা-ব্যাভিচার থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো নারী ও পুরুষ উভয়কে পর্দা মেনে চলা।
পর্দার বিধান স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সাঃ)-এর। যে নিজেকে মুসলিম দাবী করবে তার এর বিরোধীতা করার কোনই সুযোগ নেই।
একজন নিরেট নাস্তিকের পক্ষেই সম্ভব পর্দার বিরোধীতা করা। পর্দাকে ফরজ হিসেবে মেনে নিয়ে নানা দুর্বলতার কারণে ব্যক্তিগত জীবনে না মানা কবীরা গুনাহ।
কিন্তু এর বিরোধীতা করা, পর্দাকে প্রগতির অন্তরায়, এ যুগে অচল ইত্যাদি বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল করা নিঃসন্দেহে কাফির-মুরতাদদেরই কাজ। এ বিপদজনক আচরণ থেকে সকল মুসলিমের সতর্ক থাকা একান্তই কর্তব্য।
একজন মুসলিম নারীর প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম কখনই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। রসূল (সাঃ)-এর যামানায় নারীরা জুমার নামায ও ঈদগাহে উপস্থিত হয়েছে; যুদ্ধের ময়দানে, ব্যবসা ও ক্ষেতে-খামারে কাজ করেছে।
যদিও ইসলাম পূর্বযুগে নারী ছিল সবচেয়ে অবহেলিত, নিঃগৃহিত। ইসলামই নারীকে মর্যাদার উচ্চাসনে আসীন করেছে।
বর্তমান বিশ্বে পুরুষের পাশাপাশি নারী তার স্বাতন্ত্র বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তুরস্ক, ইরান, মিশর এবং আমাদের দেশে অনেক নারী পর্দাসহ সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে বিপুল সংখ্যক মহিলা কর্মী নিয়োজিত এবং সারিবদ্ধভাবে যখন তারা রাস্তায় চলে ওড়নাসহ শালীন পোশাকেই তাদেরকে দেখা যায়।
হেফাজতে ইসলাম প্রদত্ত ১৩ দফা দাবীসমূহের অন্যতম দাবী সমাজে পর্দার প্রচলন ফরজ হিসেবে কার্যকর করা। নানাভাবে এর ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে যে, মহিলারা ঘর হতে বের হতে পারবে না এবং গার্মেন্টসে কোন মহিলা শ্রমিক কাজ করতে পারবে না, সমাজে বেকারত্ব বাড়বে ইত্যাদি।
অথচ পর্দা অনুসরণের মাধ্যমে নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদার কথায় সেখানে বলা হয়েছে এবং নারীর উপযোগী কর্মপরিবেশ এবং ন্যায্য পারিশ্রমিকও দাবী করা হয়েছে।
আমার যতদূর মনে পড়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ৮,০০০/- টাকা হেফাজতের পক্ষ থেকেই প্রথম বলা হয়েছে। একজন মুসলিম হিসেবে তাদের দাবীর যথার্থতা স্বীকার না করে কোন উপায় নেই।
পর্দার মধ্যে থেকে একজন নারীর সামাজিক যে কোন দায়িত্ব পালন বা কর্ম করার সুযোগ ইসলামে রয়েছে। ইসলাম যে মানবিক মূল্যবোধের কথা বলে তার অনুপস্থিতির কারণে নারী তার ন্যায্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ইসলাম নারীকে মা (মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত), স্ত্রী (তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম) ও কন্যা (যে তার কন্যা সন্তানকে উত্তমভাবে লালন-পালন করবে কিয়ামতের দিন তার ও আমার অবস্থান হবে একত্রে) হিসেবে যে মর্যাদা দান করেছে তার জন্য আমাদের সবারই উচিত আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ ও সন্তুষ্ট থাকা।
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর বিধানে পূর্ণ আনুগত্য ও সন্তুষ্ট থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন। ২৩.১১.২০১৩
Comments
Post a Comment