আল্লাহপাকের বাণী, ‘নিশ্চয়ই আমি জ্বিন ও মানুষকে কেবল আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ ইবাদত শব্দের অর্থ গোলামী করা, দাসত্ব করা, আনুগত্য করা। মানুষ যাতে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর দাসত্ব করতে পারে সে জন্য আদম (আ:)-কে দুনিয়ায় প্রেরণের সময় তিনি জানিয়ে দেন- ‘আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয়ের কারণ নেই।’ আল্লাহপাকের প্রেরিত প্রথম মানুষ হলেন প্রথম নবী এবং যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রসূল তিনি প্রেরণ করেন। সকলের একই আহবান ছিল, হে মানুষ! তোমরা কেবল আল্লাহরই দাসত্ব কর।’ এই দাসত্বের কোন সুনির্দ্দিষ্ট রূপ নেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূের্যাদয় সকল সময় সকল অবস্থায় মানুষ শুধুই আল্লাহর হুকুম মেনে চলবে। মানুষের জীবনের ব্যাপকতা যতখানি আল্লাহর হুকুমের ব্যাপকতাও ততখানি। একটু মুহূর্তও ব্যতিক্রম ঘটাবার সুযোগ নেই এবং যে এভাবে তার জীবনটা অতিবাহিত করে ত্রাই নাম মুসলিম অর্থাৎ অনুগত। ব্যতিক্রম ঘটালেই সে ইসলামের সীমা থেকে বের হয়ে যায় অর্থাৎ সে তখন কাফের। এই সার্বক্ষণিক গোলামীতে মানুষকে নিয়োজিত করার লক্ষ্যে প্রস্তুতিস্বরূপ আল্লাহপাক ফরজ করেছেন নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্ব। নামায মানুষকে বারবার এ কথা স্মরণ করে দেয় যে তুমি আল্লাহর গোলাম এবং এই গোলামীর বাইরে একটি মুহূর্তও তুমি কাটাতে পারো না। ঘুম ভাঙ্গে নামাযের আযান শুনে এবং কর্মব্যস্ততার মাঝে জোহর, আছর, মাগরিব এবং ঘুমানোর পূর্বে আল্লাহর ঘরে হাজিরা দিয়ে বারবার এ ঘোষণাই প্রদান করে যে ‘আমরা কেবল তোমারই গোলামী করি এবং তোম্রাই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।’ রোযা বছরে পূর্ণ এক মাস এভাবেই মানুষকে প্রস্তুত করে যে, দুনিয়ার সবাইকে আড়াল করতে পার কিন্তু আল্লাহ থেকে নিজেকে আড়াল করা কখনই সম্ভব নয়। ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির এবং পিপাসায় কাতর হলেও লোকচক্ষুর অগোচরে এক মুষ্টি খাবার বা এক ঢোক পানি গ্রহণ করে না। করে না, এ বিশ্বাসে যে আল্লাহ সর্বাবস্থায় তাকে দেখছেন। কেবল আল্লাহরই ভয় তাকে সর্বক্ষণ তাড়া করে। এভাবে আল্লাহর স্মরণ এবং ভয় যদি মানুষের অন্তরে জাগরুক থাকে তাহলে সে নিজেকে সকল পাপাচার থেকে সহজেই মুক্ত রাখতে পারে। যাকাত এ কথা স্মরণ করে দেয় যে তোমার উপার্জিত সম্পদ একান্তভাবে আল্লাহর দান এবং এতে আল্লাহর হক রয়েছে। যাকাত মানুষের দিলকে কার্পণ্য ও স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত করে। হজ্ব কিভাবে একজন ব্যক্তিকে আল্লাহপাকের পূর্ণ গোলাম হতে সাহায্য করে বর্তমান প্রবন্ধে তাই আমাদের আলোচনার বিষয়।
এ পৃথিবীতে মানুষের পরিচয় হলো সে একাধারে আল্লাহর গোলাম ও সাথে সাথে তাঁর প্রতিনিধি। প্রতিনিধি হিসেবে সে নিজে যেমন আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য করবে সাথে সাথে গোটা দুনিয়ায় সবাই যাতে আল্লাহর আনুগত্য করতে পারে সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সমাজের কিছু বাছাইকৃত লোককে আল্লাহপাক প্রতি বছর তাঁর ঘরে নিয়ে যান তাঁর নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ করণের জন্য এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সে সব বান্দাকে পূত-পবিত্র করে স্ব স্ব স্থানে ফেরত পাঠান যাতে যোগ্যতার সাথে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। হজ্ব যাদের উপর ফরজ তা আদায়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব না করে দ্রুত তা সম্পন্ন করার জন্য হাদিসে তাগিদ দেয়া হয়েছে। হজ্ব সম্পন্ন করার জন্য মোটামুটি দেড় মাসের সফর করতে হয়। নিয়ত করার সাথে সাথে তার মধ্যে একটি মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। কারো নিকট তার দেনা-পাওনা থাকলে তা মিটে ফেলে, কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে বা কারো হক নষ্ট করলে তা পূরণ করার বা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আল্লাহর একজন সাচ্চা বান্দাহ্ হিসেবে তাঁর কাছে হাজির হতে চায়। মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি স্বাভাবিক এবং মানুষ যদি তার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন জীবন-যাপন করতে চায় তা হলে আল্লাহপাক তাকে সে সুযোগ দান করেন। হজ্ব ক্ষমা পাওয়ার এক অপূর্ব সুযোগ। এ জন্য হাদিসে বলা হয়েছে মকবুল হজ্বের প্রতিদান হলো জান্নাত। আমাদের দেশ থেকে যারা হজ্বে যান বিমানবন্দর থেকে তাদেরকে ইহরাম বাঁধতে হয় যদিও নিয়ত করে বিমানে বসে ইয়ালামলাম পৌঁছে। দুই প্রস্থ সাদা কাপড়ে খালি মাথায় এক জোড়া চটি সেন্ডেল পায়ে ফকিরী বেশে রওয়ানা হতে হয়। কাফনের কাপড়ের সাথেও তুলনা করা যায়। কোন গর্ব-অহংকার নেই, অত্যন্ত দীনহীনভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একই পোশাকে লাব্বাইক আল্লাহুম্মাা লাব্বাইক----(হে আল্লাহ! আমরা তোমার আহবানে উপস্থিত হয়েছি, উপস্থিত হয়েছি, তোমার কাছে উপস্থিত হয়েছি, তোমার কোন শরীক নেই, আমরা হাজির হয়েছি। সমস্ত প্রশংসা, নিয়ামত ও সা¤্রাজ্য তোমারই। তোমার কোন শরীক নেই্) উচ্চারণ করতে করতে কাবায় উপস্থিত হয়। হাজ্বীদের কণ্ঠে কেবল আল্লাহরই প্রশংসা। দেশে দেশে আল্লাহকে বাদ দিযে নিজেরা নিজেদের মত সা¤্রাজ্য গড়ে তুলেছে এবং প্রশংসা চলে কেবল নেতা-নেত্রীদের। আল্লাহর গোলামী নির্দ্দিষ্ট কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে সমগ্র কর্মময় জীবনে ইসলামকে বিসর্জন দিয়ে সেজেছে ধর্মনিরপেক্ষ। ফলে কর্মময় জীবনে ধর্মের অনুপস্থিতির কারণে অন্যায়-অত্যাচারে সমাজটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ইহরামের পোশাক পরে সারাক্ষণ সে এ কথায় বলে হে আল্লাহ, তোমার কোন শরীক নেই-তুমিই একমাত্র শাসক, তোমার আইন শিরোধার্য। উচ্চারণ শেষ হয় খানায়ে কাবায় উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। হাজরে আসওয়াদ বরাবর থেকে শুরু করে সাত বার তাওয়াফ এবং এ তাওয়াফেও তার মুখে উচ্চারিত হয় আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের কথা, আল্লাহরই প্রশংসার কথা, তাঁরই সার্বভৌমত্বের কথা (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লøাহিল হামদ) এবং কাতরভাবে বারবার আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ কামনা করে। সাতবার তাওয়াফে তিনবার রমল করতে হয় অর্থাৎ শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করতে হয়। এ তাওয়াফের মাধ্যমে আল্লাহর ঘরে উপস্থিত তাঁর এ মেহমান এ কথায় বলে থাকে যে আমি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে এখন আমার জীবনটা কাবাকেন্দ্রিক করছি অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে আমার কোন জীবন নেই। ছাফা ও মারওয়া দৌড়াদৌড়ি ও জমজমের পানি খাওয়ার মধ্যে রয়েছে আল্লাহপাকের নিদর্শন। হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর তিন বান্দাহ্ হযরত ইবরাহিম (আ:), হযরত হাজেরা (আ:) ও ইসমাইল (আ:)-এর চরম আত্মত্যাগের স্মরণ। কেবল আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য হযরত ইবরাহিম (আ:) আরাম-আয়েশের নিরাপদ জীবন ও পিতা-মাতার আদর-¯েœহ ত্যাগ করেছেন, নিজের জীবনকে বিপন্ন করার জন্য আগুনে পুড়তে রাজি হয়েছেন ও নিজের স্বদেশভূমি ত্যাগ করেছেন। তাঁর জীবনে পরীক্ষার পর পরীক্ষা। বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া সন্তানকে আল্লাহরই নির্দেশে সন্তানসহ স্ত্রীকে জনমানবহীন প্রান্তরে সামান্য পানি ও খাবার দিয়ে রেখে আসা এবং হযরত হাজেরার ্(আ:) আল্লাহর উপর পূর্ণ নির্ভরতা ও মা হয়ে সন্তানের জীবন বাঁচাতে তাঁর যে ব্যাকুলতা ও ছাফা-মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি সব থেকেই শিক্ষালাভের জন্য আল্লাহপাক কুরআনে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর এ অতি ধৈর্যশীলা বান্দীর স্মরণে কিয়ামত পর্যন্ত হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে হাজ্বীরা ছাফা ও মারওয়া সায়ী করবেন। শিশু ইসমাইলের (আ:) জীবনরক্ষার্থে আল্লাহর কুদরত জমজমের পানি অব্যাহত রয়েছে এবং এ পানি পানও অন্যতম হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা। এটা আল্লাহপাকের একটি বড় নিদর্শন-মরুর দেশে অফুরন্ত পানি যে পানি সকল হাজী পান করছে এবং বয়ে বাড়ী নিয়ে যাচ্ছে-যার কোন শেষ নেই। মানুষের হেদায়াতের জন্য এটাই যথেষ্ট হতে পারে। হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে রয়েছে মিনায় তাঁবু জীবন, আরাফায় নামায সংক্ষেপ করে জোহর ও আছর একত্রে আদায়, খুতবাহ্ শ্রবণ ও সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান। এ যেন এক বিশ্বসম্মেলন-সমগ্র পৃথিবী থেকে আল্লাহর বাছাইকৃত বান্দাহ্রা একত্রে বসে উম্মাহ্র সমস্যার সমাধান এবং অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা সবাইকে অবহিত করবে। দ্রুত মুজদালাফা গমন এবং সেখানে মাগরিব ও এশা একত্রে আদায় এবং ফজরের নামায আদায় করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে জামারায় শয়তানকে পাথর মারার জন্য ছোটা-সবকিছুতে মনে হয় যেন একজন সৈনিক একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে। হযরত ইবরাহিম (আ:) ও হযরত হাজেরা (আ:)-কে প্ররোচনা দানকারী শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের স্মারক হিসাবে আজও পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে সকল অশুভ শক্তিকে প্রতিহতের এক শপথ গ্রহণ করে হাজ্বী সাহেবরা। হজ্বের অনুষ্ঠানের অন্যতম হলো কুরবানি। আল্লাহর ভালোবাসাকে সকল ভালোবাসার ঊর্দ্ধে প্রমাণের জন্য বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া কলিজার টুকরো সন্তানকে কুরবানি দানের স্মারক হিসাবে হাজ্বী সাহেবদেরকে কুরবানি করতে হয়। এখানে গোশত খাওয়া মুখ্য নয়। কুরবানি মূলত রক্ত প্রবাহিত করা। প্রতিকী- কুরবানি দানের মাধ্যমে একজন কুরবানিদাতা এ ঘোষণাই দান করে যে, ‘নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু কেবল আল্লাহরই জন্য।’ কতবড় শক্তিশালী ঘোষণা। আমি বেঁচে থাকলে সেটা হবে আল্লাহর জন্য এবং আমি মরে গেলেও সেটা হবে আল্লাহরই জন্য। কুরবানি শেষে নিজের মাথা মুন্ডন করে সে ইহরামমুক্ত হয় অর্থাৎ হালাল হয়। ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ করার তো প্রশ্নই উঠেনা কিছু হালাল কাজকেও সামায়িকভাবে নিষিদ্ধ থাকে। আসলে আল্লাহর হুকুম পালনের নামই ইবাদত এবং মানুষকে অভ্যস্ত করার লক্ষ্যেই এত আয়োজন। মারামারি নয় বরং সামান্য ঝগড়া-ঝাটিও নিষিদ্ধ। পরস্পর সৌহার্দ্র-সম্প্রীতি এবং একে অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকারের এক অনন্য নজীর সৃষ্টি হয় সে সময়ে। আল্লাহতে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার এক জজবা নিয়েই একজন হাজী সাহেব দেশে ফিরেন। এ ছাড়া কাবায় নিয়মিত নামায আদায় যাতে আছে লক্ষ গুণ ছাওয়াব এবং মদীনার মসজিদে কমপক্ষে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় যাতে আছে পঞ্চাশ হাজার গুণ ছাওয়াব-এ সবই একজন হাজ্বীকে আল্লাহর ভয় ও স্মরণে সিক্ত করে। মদীনার মসজিদে রসূল (সা:) তাঁর দু’জন সাহাবীকে সাথে নিয়ে শুয়ে আছেন। দীর্ঘ দেড় মাস মক্কা ও মদীনায় অবস্থানের মধ্য দিয়ে একজন হাজ্বীর স্মৃতিতে রসূল (সা:) ও তাঁর সাহাবীদের কর্মতৎপরতা ও আত্মত্যাগ ভাস্মর হয়ে উঠে এবং এক নতুন প্রেরণা নিয়ে স্বদেশে ফিরে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সকল ইবাদতের মত আমাদের হজ্বও প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। সকল অনুষ্ঠান অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করছে কিন্তু আল্লাহর প্রতি প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা যা ইবরাহিম (আ:)-এর পরিবার প্রদর্শন করে গেছেন তার ছিটে-ফোঁটাও আমরা নিজেদের মধ্যে আয়ত্ত করতে পারছি না। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক হজ্ব করছেন এবং সমাজের প্রভাবশালী লোকেরাই হজ্ব করেন এবং আল্লাহপাক এ লোকগুলোকে জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত করে আবার দেশে ফেরত পাঠান। কিন্তু খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে হজ্বের চেতনা শয়তানের মোকাবেলা বাদ দিয়ে যেন তার সহযোগী হয়ে কাজ করতে থাকে। ফলে রাজত্ব আল্লাহর এ ঘোষণা বাস্তবায়নে আর হাজ্বী সাহেব কর্মতৎপর থাকতে পারেন না। আল্লাহপাকের কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা করি তিনি যেন মুসলিম উম্মাহ্কে তাদের ইবাদত বন্দেগীর মধ্যে চেতনাসমৃদ্ধ করেন। আমীন
এ পৃথিবীতে মানুষের পরিচয় হলো সে একাধারে আল্লাহর গোলাম ও সাথে সাথে তাঁর প্রতিনিধি। প্রতিনিধি হিসেবে সে নিজে যেমন আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য করবে সাথে সাথে গোটা দুনিয়ায় সবাই যাতে আল্লাহর আনুগত্য করতে পারে সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সমাজের কিছু বাছাইকৃত লোককে আল্লাহপাক প্রতি বছর তাঁর ঘরে নিয়ে যান তাঁর নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ করণের জন্য এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সে সব বান্দাকে পূত-পবিত্র করে স্ব স্ব স্থানে ফেরত পাঠান যাতে যোগ্যতার সাথে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। হজ্ব যাদের উপর ফরজ তা আদায়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব না করে দ্রুত তা সম্পন্ন করার জন্য হাদিসে তাগিদ দেয়া হয়েছে। হজ্ব সম্পন্ন করার জন্য মোটামুটি দেড় মাসের সফর করতে হয়। নিয়ত করার সাথে সাথে তার মধ্যে একটি মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। কারো নিকট তার দেনা-পাওনা থাকলে তা মিটে ফেলে, কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে বা কারো হক নষ্ট করলে তা পূরণ করার বা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আল্লাহর একজন সাচ্চা বান্দাহ্ হিসেবে তাঁর কাছে হাজির হতে চায়। মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি স্বাভাবিক এবং মানুষ যদি তার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন জীবন-যাপন করতে চায় তা হলে আল্লাহপাক তাকে সে সুযোগ দান করেন। হজ্ব ক্ষমা পাওয়ার এক অপূর্ব সুযোগ। এ জন্য হাদিসে বলা হয়েছে মকবুল হজ্বের প্রতিদান হলো জান্নাত। আমাদের দেশ থেকে যারা হজ্বে যান বিমানবন্দর থেকে তাদেরকে ইহরাম বাঁধতে হয় যদিও নিয়ত করে বিমানে বসে ইয়ালামলাম পৌঁছে। দুই প্রস্থ সাদা কাপড়ে খালি মাথায় এক জোড়া চটি সেন্ডেল পায়ে ফকিরী বেশে রওয়ানা হতে হয়। কাফনের কাপড়ের সাথেও তুলনা করা যায়। কোন গর্ব-অহংকার নেই, অত্যন্ত দীনহীনভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একই পোশাকে লাব্বাইক আল্লাহুম্মাা লাব্বাইক----(হে আল্লাহ! আমরা তোমার আহবানে উপস্থিত হয়েছি, উপস্থিত হয়েছি, তোমার কাছে উপস্থিত হয়েছি, তোমার কোন শরীক নেই, আমরা হাজির হয়েছি। সমস্ত প্রশংসা, নিয়ামত ও সা¤্রাজ্য তোমারই। তোমার কোন শরীক নেই্) উচ্চারণ করতে করতে কাবায় উপস্থিত হয়। হাজ্বীদের কণ্ঠে কেবল আল্লাহরই প্রশংসা। দেশে দেশে আল্লাহকে বাদ দিযে নিজেরা নিজেদের মত সা¤্রাজ্য গড়ে তুলেছে এবং প্রশংসা চলে কেবল নেতা-নেত্রীদের। আল্লাহর গোলামী নির্দ্দিষ্ট কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে সমগ্র কর্মময় জীবনে ইসলামকে বিসর্জন দিয়ে সেজেছে ধর্মনিরপেক্ষ। ফলে কর্মময় জীবনে ধর্মের অনুপস্থিতির কারণে অন্যায়-অত্যাচারে সমাজটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ইহরামের পোশাক পরে সারাক্ষণ সে এ কথায় বলে হে আল্লাহ, তোমার কোন শরীক নেই-তুমিই একমাত্র শাসক, তোমার আইন শিরোধার্য। উচ্চারণ শেষ হয় খানায়ে কাবায় উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। হাজরে আসওয়াদ বরাবর থেকে শুরু করে সাত বার তাওয়াফ এবং এ তাওয়াফেও তার মুখে উচ্চারিত হয় আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের কথা, আল্লাহরই প্রশংসার কথা, তাঁরই সার্বভৌমত্বের কথা (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লøাহিল হামদ) এবং কাতরভাবে বারবার আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ কামনা করে। সাতবার তাওয়াফে তিনবার রমল করতে হয় অর্থাৎ শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করতে হয়। এ তাওয়াফের মাধ্যমে আল্লাহর ঘরে উপস্থিত তাঁর এ মেহমান এ কথায় বলে থাকে যে আমি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে এখন আমার জীবনটা কাবাকেন্দ্রিক করছি অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে আমার কোন জীবন নেই। ছাফা ও মারওয়া দৌড়াদৌড়ি ও জমজমের পানি খাওয়ার মধ্যে রয়েছে আল্লাহপাকের নিদর্শন। হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর তিন বান্দাহ্ হযরত ইবরাহিম (আ:), হযরত হাজেরা (আ:) ও ইসমাইল (আ:)-এর চরম আত্মত্যাগের স্মরণ। কেবল আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য হযরত ইবরাহিম (আ:) আরাম-আয়েশের নিরাপদ জীবন ও পিতা-মাতার আদর-¯েœহ ত্যাগ করেছেন, নিজের জীবনকে বিপন্ন করার জন্য আগুনে পুড়তে রাজি হয়েছেন ও নিজের স্বদেশভূমি ত্যাগ করেছেন। তাঁর জীবনে পরীক্ষার পর পরীক্ষা। বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া সন্তানকে আল্লাহরই নির্দেশে সন্তানসহ স্ত্রীকে জনমানবহীন প্রান্তরে সামান্য পানি ও খাবার দিয়ে রেখে আসা এবং হযরত হাজেরার ্(আ:) আল্লাহর উপর পূর্ণ নির্ভরতা ও মা হয়ে সন্তানের জীবন বাঁচাতে তাঁর যে ব্যাকুলতা ও ছাফা-মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি সব থেকেই শিক্ষালাভের জন্য আল্লাহপাক কুরআনে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর এ অতি ধৈর্যশীলা বান্দীর স্মরণে কিয়ামত পর্যন্ত হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে হাজ্বীরা ছাফা ও মারওয়া সায়ী করবেন। শিশু ইসমাইলের (আ:) জীবনরক্ষার্থে আল্লাহর কুদরত জমজমের পানি অব্যাহত রয়েছে এবং এ পানি পানও অন্যতম হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা। এটা আল্লাহপাকের একটি বড় নিদর্শন-মরুর দেশে অফুরন্ত পানি যে পানি সকল হাজী পান করছে এবং বয়ে বাড়ী নিয়ে যাচ্ছে-যার কোন শেষ নেই। মানুষের হেদায়াতের জন্য এটাই যথেষ্ট হতে পারে। হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে রয়েছে মিনায় তাঁবু জীবন, আরাফায় নামায সংক্ষেপ করে জোহর ও আছর একত্রে আদায়, খুতবাহ্ শ্রবণ ও সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান। এ যেন এক বিশ্বসম্মেলন-সমগ্র পৃথিবী থেকে আল্লাহর বাছাইকৃত বান্দাহ্রা একত্রে বসে উম্মাহ্র সমস্যার সমাধান এবং অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা সবাইকে অবহিত করবে। দ্রুত মুজদালাফা গমন এবং সেখানে মাগরিব ও এশা একত্রে আদায় এবং ফজরের নামায আদায় করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে জামারায় শয়তানকে পাথর মারার জন্য ছোটা-সবকিছুতে মনে হয় যেন একজন সৈনিক একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে। হযরত ইবরাহিম (আ:) ও হযরত হাজেরা (আ:)-কে প্ররোচনা দানকারী শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের স্মারক হিসাবে আজও পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে সকল অশুভ শক্তিকে প্রতিহতের এক শপথ গ্রহণ করে হাজ্বী সাহেবরা। হজ্বের অনুষ্ঠানের অন্যতম হলো কুরবানি। আল্লাহর ভালোবাসাকে সকল ভালোবাসার ঊর্দ্ধে প্রমাণের জন্য বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া কলিজার টুকরো সন্তানকে কুরবানি দানের স্মারক হিসাবে হাজ্বী সাহেবদেরকে কুরবানি করতে হয়। এখানে গোশত খাওয়া মুখ্য নয়। কুরবানি মূলত রক্ত প্রবাহিত করা। প্রতিকী- কুরবানি দানের মাধ্যমে একজন কুরবানিদাতা এ ঘোষণাই দান করে যে, ‘নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু কেবল আল্লাহরই জন্য।’ কতবড় শক্তিশালী ঘোষণা। আমি বেঁচে থাকলে সেটা হবে আল্লাহর জন্য এবং আমি মরে গেলেও সেটা হবে আল্লাহরই জন্য। কুরবানি শেষে নিজের মাথা মুন্ডন করে সে ইহরামমুক্ত হয় অর্থাৎ হালাল হয়। ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ করার তো প্রশ্নই উঠেনা কিছু হালাল কাজকেও সামায়িকভাবে নিষিদ্ধ থাকে। আসলে আল্লাহর হুকুম পালনের নামই ইবাদত এবং মানুষকে অভ্যস্ত করার লক্ষ্যেই এত আয়োজন। মারামারি নয় বরং সামান্য ঝগড়া-ঝাটিও নিষিদ্ধ। পরস্পর সৌহার্দ্র-সম্প্রীতি এবং একে অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকারের এক অনন্য নজীর সৃষ্টি হয় সে সময়ে। আল্লাহতে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার এক জজবা নিয়েই একজন হাজী সাহেব দেশে ফিরেন। এ ছাড়া কাবায় নিয়মিত নামায আদায় যাতে আছে লক্ষ গুণ ছাওয়াব এবং মদীনার মসজিদে কমপক্ষে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় যাতে আছে পঞ্চাশ হাজার গুণ ছাওয়াব-এ সবই একজন হাজ্বীকে আল্লাহর ভয় ও স্মরণে সিক্ত করে। মদীনার মসজিদে রসূল (সা:) তাঁর দু’জন সাহাবীকে সাথে নিয়ে শুয়ে আছেন। দীর্ঘ দেড় মাস মক্কা ও মদীনায় অবস্থানের মধ্য দিয়ে একজন হাজ্বীর স্মৃতিতে রসূল (সা:) ও তাঁর সাহাবীদের কর্মতৎপরতা ও আত্মত্যাগ ভাস্মর হয়ে উঠে এবং এক নতুন প্রেরণা নিয়ে স্বদেশে ফিরে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সকল ইবাদতের মত আমাদের হজ্বও প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। সকল অনুষ্ঠান অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করছে কিন্তু আল্লাহর প্রতি প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা যা ইবরাহিম (আ:)-এর পরিবার প্রদর্শন করে গেছেন তার ছিটে-ফোঁটাও আমরা নিজেদের মধ্যে আয়ত্ত করতে পারছি না। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক হজ্ব করছেন এবং সমাজের প্রভাবশালী লোকেরাই হজ্ব করেন এবং আল্লাহপাক এ লোকগুলোকে জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত করে আবার দেশে ফেরত পাঠান। কিন্তু খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে হজ্বের চেতনা শয়তানের মোকাবেলা বাদ দিয়ে যেন তার সহযোগী হয়ে কাজ করতে থাকে। ফলে রাজত্ব আল্লাহর এ ঘোষণা বাস্তবায়নে আর হাজ্বী সাহেব কর্মতৎপর থাকতে পারেন না। আল্লাহপাকের কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা করি তিনি যেন মুসলিম উম্মাহ্কে তাদের ইবাদত বন্দেগীর মধ্যে চেতনাসমৃদ্ধ করেন। আমীন
Comments
Post a Comment