Skip to main content

পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দানে আল্লাহর সুন্নাত (নিয়ম) ★ ৫ই সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত।

 

এই বিশ্বজাহান পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার একটি নিয়ম রয়েছে কিন্তু তিনি নিজে সেই নিয়মের অধীন নন। আল্লাহপাক সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। তিনি যা ইচ্ছা করেন সেটিই ঘটে। শুধু বলেন, হও- তাৎক্ষণিক হয়ে যায় এবং এই বিশ্বে সাগর-মহাসাগর, গ্রহ-নক্ষত্র ও সকল সৃষ্টি আল্লাহর ইচ্ছার প্রকাশ। সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর দেওয়া নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই অর্থে সবাই মুসলিম। কিন্তু মানুষ ব্যতিক্রম।

আল্লাহপাক আদম আ.-কে মাটি থেকে সৃষ্টি করে একটি অবয়ব দানের পর নিজ থেকে রুহ ফুঁকে দেন। মানুষ মূলত আল্লাহর গোলাম ও প্রতিনিধি (খলিফা)। মহান আল্লাহপাকের যেসব গুণ ও ক্ষমতা রয়েছে তার অতি ক্ষুদ্র অংশ মানুষকে দান করেছেন যাতে মানুষ আল্লাহ তায়ালার যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। এজন্য বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও, আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হও। আল্লাহ আল মালিক এবং মানুষ হবে আব্দুল মালিক যার কাজ হবে সুশাসন কায়েম করা। আবার আল্লাহ হলেন আল হাকিম এবং মানুষ আব্দুল হাকিম হয়ে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করবে।

মানুষ ফেরেশতা নন যার কাজ কেবল আল্লাহর গোলামি করা বরং তার চেয়েও বড়ো। মানুষ নিজে আল্লাহর গোলামি করবে এবং সেই সাথে সকলে যাতে স্বচ্ছন্দে আল্লাহর গোলামি করতে পারে সে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা তার মৌলিক কাজ। আদম আ.-কে সৃষ্টি করার পর ফেরেশ্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদমকে সেজদা করার জন্য। ইবলিস ছাড়া সবাই সেজদা করেছিলেন। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার ফলে সে অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত হয় এবং সে আল্লাহর কাছে হায়াত ও সুযোগ চায় যাতে সে তার শত্রু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে। আল্লাহপাক তাকে সে সুযোগ দেন এবং এখানেই মানুষের পরীক্ষা। আল্লাহপাক মানুষকে সকল সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, সে শয়তানের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত নস্যাত করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর গোলামি করবে ও তাগুতকে অস্বীকার করবে।

আদম আ. পৃথিবীতে চলে আসার সময় স্বাভাবিকভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং সেসময়ে আল্লাহপাক তাঁকে অভয়বাণী শুনিয়েছিলেন, ‘আমরা বললাম, তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোনো হেদায়াত তোমাদের কাছে পৌঁছবে তখন যারা আমার সেসব হেদায়াত অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় ও দুঃখ থাকবে না’- সুরা বাকারা ৩৮। আদম আ. ছিলেন প্রথম মানুষ ও প্রথম নবি এবং যুগে যুগে অসংখ্য নবি ও রসুলের আগমন ঘটেছে। শেষ নবি হলেন প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.। সকল নবি ও রসুলের দাওয়াত ছিল অভিন্ন - ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। ভিন্নভাবে বলা যায়, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো’- সুরা নহল ৩৬। এই কালিমা তাইয়্যেবা স্রেফ একটি বাক্য নয়, এ এক বিপ্লবাত্মক ঘোষণা, এক পলিটিকাল স্লোগান। এই কালিমা যখনই কোনো নবি-রসুল তাঁর জাতির কাছে ঘোষণা করেছেন তখনই শাসকবর্গ ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করেছে এবং এটিই স্বাভাবিক। আজও যারা তাগুতকে অস্বীকার করে একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহকে মানতে চায় তাগুতের পক্ষ থেকে বাধা আসবেই। দেশে দেশে ইসলামপন্থীদের উপর স্বৈরশাসকদের বাধা ও জুলুম-নির্যাতন তা কুরআনে বর্ণিত অতীতকালে নবি-রসুল ও তাঁদের সঙ্গী-সাথিদের সাথে যা করা হয়েছে তারই ধারাবাহিকতা।

সকল নবি-রসুল ও তাঁদের অনুসারী ঈমানদার জনগোষ্ঠীর মৌলিক দায়িত্ব হলো দীন কায়েম করা এবং এরই মধ্য দিয়ে প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন সম্ভব। আল্লাহর বাণী, ‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের সেসব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নুহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মদ) যা এখন আমি তোমার কাছে ওহির মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহিম, মুসা ও ইসাকে। তার সাথে তাগিদ করেছিলাম এই বলে যে, দীন কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে মতপার্থক্য সৃষ্টি করো না’- সুরা শুরা ১৩। দীন কায়েমের প্রশ্নে কোনো মতপার্থক্য আল্লাহপাক মেনে নেবেন না। হ্যাঁ, প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে। দীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যেই মূলত রসুল সা.-এর সকল কর্ম-প্রচেষ্টা এবং আল্লাহর ঘোষণাও তাই। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কুরআন মজিদে তিন জায়গায় সুরা তাওবা (৩৩ নং), সুরা ফাতাহ্ (২৮ নং) ও সুরা সফে (৯ নং) উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘তিনি আপন রসুলকে হেদায়াত ও সঠিক জীবনব্যবস্থা (দীনে হক) দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে সকল জীবনব্যবস্থার ওপর একে বিজয়ী করে দিতে পারেন, মুশরিকদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক’- সুরা সফ ৯। 

দীন কায়েমের এই চেষ্টা-প্রচেষ্টার নামই হলো জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। মৌলিক ইবাদতসমূহের (নামাজ, জাকাত, রোজা, হজ) মূল লক্ষ্যই হলো জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর জন্য প্রস্তুত করা। এজন্য রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, নামাজ হলো দীনের ভিত্তি এবং এর চূড়া হলো জিহাদ। জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার কাজকে আল্লাহপাক ব্যবসা হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আনা ও জান-মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম কল্যাণ এবং যারা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজে আত্মনিয়োগ করবে তাদের সকল গুনাহ মাফ ও এমন জান্নাত দেবেন যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত। একজন মুমিনের জন্য এটিই সবচেয়ে বড়ো সফলতা। আল্লাহপাক বাড়তি দেবেন যা মুমিনরা খুবই আকাঙ্ক্ষা করেন- তা হলো আল্লাহর সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয় (সুরা সফ ১০-১৩)। রসুলুল্লাহ সা. যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে যাচ্ছেন সেসময়ে আল্লাহ তাঁকে দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘তুমি বলো, হে আমার রব (যেখানেই নিয়ে যাও), তুমি আমাকে সত্যের সাথে নিয়ে যেও এবং (যেখান থেকেই বের করো) সত্যের সাথে বের করো এবং তোমার কাছ থেকে আমার জন্য একটি সাহায্যকারী রাষ্ট্রশক্তি দান করো’- সুরা বনি ইসরাইল ৮০। আল্লাহপাক চান, তাঁর বান্দারা তাগুতকে অস্বীকার করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আনুগত্য করবে। আল্লাহপাকের বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না; নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন’- সুরা বাকারা ২০৮। এটি স্পষ্ট যে, জমিনে দীন কায়েম ছাড়া পুরোপুরি ইসলাম মানা যায় না। দীনের কিছু অংশ মানা এবং কিছু অমান্য করা কালিমা তাইয়্যেবার দাবির সাথে সাংঘর্ষিক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘তোমরা কি দীনের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব’- সুরা বাকারা ৮৫। আজ মুসলমানদের জীবনে জিল্লতির পেছনে মূল কারণ জমিনে দীন প্রতিষ্ঠিত না থাকা।

প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ছাড়া দীন কায়েম সম্ভব নয় এবং দীনের বিজয় একান্তভাবে আল্লাহপাকের মর্জির উপর নির্ভরশীল। তাই প্রচেষ্টার সাথে আল্লাহর কাছে কাতরভাবে দোয়া করতে হবে এবং নামাজ -রোজা, জিকির-আজকার ও আল্লাহর পথে ব্যয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। জিহাদবিমুখ জীবন মুসলমানদের জীবন নয়। নবি মুহাম্মদ সা. জিহাদকে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত করেছেন। তিনি বলেছেন, যে লোক মারা গেল অথচ না জিহাদ করলো আর না জিহাদের বাসনা অন্তরে পোষণ করলো তার মৃত্যু হলো মুনাফিকের মৃত্যু।

এইতো শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে সকল মজলুম সাড়া দেয়ায় আল্লাহপাক স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছেন। এই আন্দোলনে মজলুমদের বিজয় মূলত সাত শতাধিক লোকের আত্মদান ও অসংখ্য ছাত্র- জনতার পঙ্গুত্ববরণের বিনিময়ের ফসল। এটিই আল্লাহপাকের সুন্নাত। কিছু বান্দার প্রচেষ্টা ও অধিকাংশের সমর্থন থাকলে আল্লাহ তায়ালা তাদের সাহায্য করেন। মানুষের সকল প্রচেষ্ট ব্যর্থ হতে পারে যদি তাতে সমর্থন না থাকে। তাঁর বাণী, ‘বলো, হে আল্লাহ! তুমি রাজত্বের মালিক, যাকে চাও রাজত্ব দান করো, আর যার থেকে চাও রাজত্ব কেড়ে নাও এবং যাকে চাও সম্মান দান করো। আর যাকে চাও অপমানিত করো, তোমার হাতেই কল্যাণ, নিশ্চয়ই তুমি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’- সুরা আলে ইমরান ২৬। সমাজে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন চলতে থাকলে এবং মজলুমের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষমতা জালেম ধ্বংস করে দিলে আল্লাহপাকের দায়িত্ব হয়ে পড়ে মজলুমের পক্ষ অবলম্বন করা। তাঁর বাণী, ‘আমি সংকল্প করেছিলাম, যাদেরকে পৃথিবীতে লাঞ্ছিত করে রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবো, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করবো, তাদেরকে উত্তরাধিকার করবো এবং পৃথিবীতে তাদেরকে কর্তৃত্ব দান করবো’- সুরা ক্বাসাস ৫-৬। তিনি আরো বলেছেন, ‘যদি আল্লাহ লোকদেরকে একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করতেন, তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশি করে উচ্চারণ করা হয় সেসব আশ্রমে, গির্জা, ইবাদতখানা ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হতো। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা তঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ বড়ই শক্তিশালী ও পরাক্রান্ত’- সুরা হজ ৪০।

এবারের এ বিজয় পরিপূর্ণ ইসলামের বিজয় নয়। বরং এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলাম কায়েমের পথকে আল্লাহ তায়ালা প্রশস্ত করে দিয়েছেন। আল্লাহর দেয়া এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এখন প্রয়োজন ইসলামপন্থী সকলের ঐক্য এবং ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। এই দাওয়াত হতে হবে জনকল্যাণমূলক কাজের মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা নির্বিশেষে মানুষকে সম্মান প্রদান, তাদের কল্যাণ সাধন আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এরই নির্দেশ। আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘তোমরা সর্বোত্তম দল। তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করবে’- সুরা আলে ইমরান ১১০। ইসলামী রাষ্ট্র বলতে বোঝায় কল্যাণমূলক সমাজ, এক ইনসাফপূর্ণ সমাজ যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না, থাকবে না শোষণ-বঞ্চনা। প্রতি জুমায় খতিব ময়োদয় তেলাওয়াত করেন, আল্লাহ ন্যায়-নীতি, পরোপকার ও আত্মীয়-স্বজনদের দান করার হুকুম দেন এবং অশ্লীল-নির্লজ্জতা ও দুষ্কৃতি এবং অত্যাচার-বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষালাভ করতে পারো’ - সুরা নহল ৯০। তিনি আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও, তোমাদের ইনসাফ ও সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার অথবা তোমাদের বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও। উভয় পক্ষ ধনী বা অভাবী যাই হোক না কেন আল্লাহ তাদের চাইতে অনেক বেশি কল্যাণকামী। কাজেই নিজেদের কামনার বশবর্তী হয়ে ইনসাফ থেকে বিরত থেকো না। আর যদি তোমরা পেঁচালো কথা বলো অথবা সত্যতাকে পাশ কাটিয়ে চলো, তাহলে জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ তার খবর রাখেন’- সুরা নিসা ১৩৫। ইনসাফ ও সুবিচারের কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! সত্যের ওপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। কোনো দলের শত্রুতা তোমাদেরকে যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয়, যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও। ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করো। এটা আল্লাহভীতির সাথে বেশি সামঞ্জস্যশীল। আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছেন’- সুরা মায়েদা ০৮।

বিচার-মীমাংসার ক্ষেত্রেও ইনসাফের পরিচয় দিতে হবে। আল্লাহর বাণী, ‘আর মীমাংসা করে দিলে যথার্থ ইনসাফ সহকারে মীমাংসা করো। কারণ আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন’- সুরা মায়েদা ৪২। 

শাসককে হতে হবে ন্যায়পরায়ণ, প্রতিশোধপরায়ণ নয়, সকলের সাথে ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। ইনসাফকারী শাসকের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অতি উচ্ছে। এ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘হাশরের ময়দানে যখন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো আশ্রয় থাকবে না সেই কঠিন মুহূর্তে আরশের ছায়ার নিচে আশ্রয়প্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম হবেন ন্যায়পরায়ণ শাসক ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী বিচারক’। আবার তিনি হুশিয়ারিও উচ্চারণ করেন এ বলে ‘যে শাসক জালেম ও খেয়ানতকারী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবে, আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন’। তিনি বলেন, ‘যে বিচারক সত্যকে জানতে পেরেও ফায়সালা করার ব্যাপারে অবিচার ও জুলুম করেছে, সে জাহান্নামে যাবে। আর যে অজ্ঞতা সত্ত্বেও জনগণের জন্য বিচার ফয়সালা করেছে সেও জাহান্নামি হবে’।

ইসলামী রাষ্ট্রে মানুষের সম্মান ও মর্যাদা অতি উচ্চে কারণ মানুষতো আল্লাহর খলিফা। মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার অর্থ আল্লাহর সাথেই ভালো ব্যবহার এবং মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার অর্থ আল্লাহর সাথেই দুর্ব্যবহার। তাই মানুষের দোষ- ত্রুটি আঁতিপাতি করে খোঁজা, তাকে হেয় করা, তার গিবত করা সবই হারাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! বেশি ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো, কারণ কোনো কোনো ধারণা ও অনুমান গুনাহ। দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গিবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ অধিক পরিমাণে তওবা কবুলকারী এবং দয়ালু’- সুরা হুজুরাত ১২।

আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের ওপর জুলুম কখনই সহ্য করেন না। সাধারণত তিনি শাস্তি দানের জন্য তাড়াহুড়ো করেন না, তিনি তাঁর বান্দার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেন, সে ফিরে আসে কি না? আল্লাহ বলেন, ‘যারা কুফরি করেছে এবং আল্লাহর পথে চলতে বাধা দিয়েছে আল্লাহ তাদের সমস্ত কাজ-কর্ম ব্যর্থ করে দিয়েছেন’- সুরা মুহাম্মদ। তিনি আরো বলেন, ‘যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের উপর জুলুম-পীড়ন চালিয়েছে, তারপর তা থেকে তওবা করেনি, নিশ্চিতভাবে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব এবং জ্বালা-পোড়ার শাস্তি। আর যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে নিশ্চিতভাবেই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের বাগান যার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত। এটিই বড় সাফল্য’- সুরা বুরুজ ১০-১১। জালেম যখন সীমালংঘন করে আল্লাহপাক অনেক সময় দুনিয়াতেই তাকে শাস্তি দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা তা বুঝতে চায় না। আসলে বিপদ দেয়ার মালিক যেমন আল্লাহ আবার বিপদ থেকে মুক্ত করার মালিকও তিনি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘কোনো বিপদ কখনই আসে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে আল্লাহ তার দিলকে হেদায়াত দান করেন। আল্লাহ সবকিছু জানেন’- সুরা তাগাবুন ১১।

সৃষ্টির আদি থেকে পৃথিবীতে রয়েছে দুটি পক্ষ। এক. বিশ্বাসী, দুই. অবিশ্বাসী এবং এই দুইয়ের কার্যও দু’ধরনের। আল্লাহপাকের বাণী, ‘যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে আর যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই তোমরা শয়তানের সঙ্গী-সাথিদের বিরুদ্ধে লড়াই করো আর বিশ্বাস করো শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’- সুরা আন নেসা ৭৬। একজন মুমিন সার্বক্ষণিক মুজাহিদ। চেতনা লাভের পর থেকে সে সর্বদা আল্লাহর রাস্তায় প্রচেষ্টাকারী (জিহাদকারী)। এই জিহাদের মৌলিক দাবি মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা। মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা অর্থাৎ আল্লাহর সার্বমৌমত্ব মেনে চলার আহবান (কালিমা তাইয়্যেবার দাবি পূরণ)। তাগুতকে অস্বীকার করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে মেনে চলার আহবানে শয়তান নিশ্চুপ থাকে না। সে অস্থির হয়ে পড়ে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর দিকে আহবান সবই তাগুতের দিকে আহবান। হক ও বাতিলের এ দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম থেকে নিজেকে দূরে রেখে নির্ঝঞ্জাট জীবন-যাপন বা বাতিলের সাথে আপোষরফা করে চলা মুমিনের জন্য সম্ভব নয়। এখানে আল্লাহপাকের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী দুটি পক্ষ এবং স্বয়ং আল্লাহপাক নিজেই তাদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। এই দ্বন্দ্ব- সংগ্রাম থেকে যারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে তাকওয়ার পরিচিত কিছু আনুষ্ঠানিকতার মাঝে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে চলার চেষ্টা করে তাদের ঈমান বড়ো সংশয়পূর্ণ। বলা যায়, মুনাফিকের স্বভাব তাদের মধ্যে রয়েছে। তারা সুবিধাবাদী, উভয় পক্ষেই থাকে।

জমিনে মুমিন ও কাফির উভয়ের উপস্থিতি থাকলে আল্লাহপাক চান জমিনে তাঁর মুমিন বান্দারা প্রতিষ্ঠিত হোক। আল্লাহপাকের এই চাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহর এই চাওয়াটা পূরণ হবে তাঁরই দেয়া নিয়মানুসারে। তাঁর বাণী, ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দীনকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক’- সুরা নূর ৫৫। জমিনে দীন কায়েম না হওয়া বা বিলম্ব হওয়ার অর্থ মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ নয় বরং আমাদের অযোগ্যতা। ঈমানের সাথে নেক আমল আল্লাহপাক মিলিয়ে দিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহ কাজ না করার নাম দিয়েছে আমল। নেক আমল হলো কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত আল্লাহর সকল আদেশ মেনে চলা এবং তাঁর সকল নিষেধ থেকে বিরত থাকা। সততা-বিশ্বস্ততা, ওয়াদা- প্রতিশ্রুতি পালন, আমানত সংরক্ষণ, সদাচরণ, উদারতা-প্রশস্ততা, ক্ষমা-সহনশীলতা-ধৈর্য- এসব মৌলিক মানবীয় গুণে গুণান্বিত জনসমষ্টিকে সাধারণত আল্লাহপাক নেতৃত্ব দান করেন। বিশ্বে নেতৃত্বের আসনে আসীন জাতিসমূহের মধ্যে মৌলিক মানবীয় গুণের আধিক্য আমাদের চেয়ে বেশি বলেই মনে হয়। তাই তারা আছে নেতৃত্বের আসনে আর আমরা তাদের পদানত হয়ে জিল্লতির জীবন যাপন করছি। আবার দূরাচার জনগোষ্ঠীকে শাস্তিদানের জন্যও আল্লাহপাক জালেম সরকার চাপিয়ে দেন। দীন কায়েমের জন্য প্রয়োজন একদল সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব ও কর্মবাহিনী এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। যেমনটি আমরা লক্ষ করলাম, একদল যোগ্য শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে মহান আল্লাহ বিজয় দান করেছেন।

Comments