মুসলিম নামধারী ইসলামের শত্রুরা মাঝে-মধ্যেই বলে থাকে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। যারা এই দাবি করে তারা সবাই লুটেরাগোষ্ঠী। সুযোগ পেলেই তারা লুটেপুটে খেতে চায়। রাজনীতির অঙ্গনে ধর্মীয় অনুভূতি (পরকালে বিশ্বাস) না থাকায় তারা এক একজন দানবে পরিণত হয়। পরকালে বিশ্বাস বা আখেরাতে জবাবদিহির অনুভূতি থাকলে এই গণহত্যা ও হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট কখনই সম্ভব হতো না। যে ধর্মের শিক্ষা, মানুষকে একটু গালি দেওয়া ও আড়ালে নিন্দা (গিবত) করার পরিণতি হুতামা (জাহান্নাম) সেই ধর্মের অনুসারী দাবিদারদের পক্ষে কি গুম-খুন, আয়নাঘর করে মানুষকে শাস্তিদান সম্ভব? রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কেহ যদি এক টুকরো সূতা বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে তাহলে কিয়ামতের দিন খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে। আবার এটাও বলেছেন, কাউকে দায়িত্ব প্রদান করা হলে সে তার নিজের কাজ যতো নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করে সরকারি দায়িত্ব সেভাবে পালন না করলে উল্টা করে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। রাজনীতির অঙ্গনে ইসলাম না মানার ফলে আজকের সমাজে এই চরম দুর্বৃত্তনা। সেখানে কেউ নিরাপদ নয় এবং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংখ্যালঘুরা। যারা লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে তারাই হিন্দুদের সম্পদ কুক্ষিগত করেছে। ধিক মুসলিম নামধারী নরপশুদের।
সকল নবি-রসুলের সাথে সমসায়িক স্বৈরশাসকের বিরোধের মূলে ছিল রাজনীতি। নমরুদ, ফেরাউন ও আবু জেহেল-আবু লাহাবরা ইবরাহিম (আ.), মুসা (আ.) ও মুহাম্মদ (সা.)-কে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই চরম বিরোধিতা করেছে। আল্লাহপাক সকল নবি-রসুলকে দীন কায়েমের দায়িত্ব দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর বাণী, ‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের সেসব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নুহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মদ) যা এখন আমি তোমার কাছে ওহির মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহিম, মুসা ও ইসাকে। তার সাথে তাগিদ করেছিলাম এই বলে যে, দীন কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে মতপার্থক্য সৃষ্টি করো না’- সুরা আশ শুরা ১৩। দীন কায়েমের প্রশ্নে কোনো মতপার্থক্য আল্লাহপাক মেনে নেবেন না। হ্যাঁ, প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে। দীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যেই মূলত রসুল সা.-এর সকল কর্ম-প্রচেষ্টা এবং আল্লাহর ঘোষণাও তাই। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কুরআন মজিদে তিন জায়গায় সুরা তওবা (৩৩ নং), সুরা ফাতাহ্ (২৮ নং) ও সুরা সফে (৯ নং) উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘তিনি আপন রসুলকে হেদায়াত ও সঠিক জীবনব্যবস্থাসহ (দীনে হক) পাঠিয়েছেন যাতে সকল জীবনব্যবস্থার ওপর একে বিজয়ী করে দিতে পারেন, মুশরিকদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক’- সুরা সফ ৯। দীন কয়েমের ক্ষেত্রে ইসলামিক দল ও ব্যক্তিবর্গের যারা বিরোধিতা করে তারা নমরুদ, ফেরাউন ও আবু জেহেল-আবু লাহাবদেরই উত্তরসূরী মুশরিক এবং এরা যে অসহনীয় হবে সেটি আল্লাহরই কথা।
সকল নবি ও রসুলের দাওয়াত ছিল অভিন্ন - ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। ভিন্নভাবে বলা যায়, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো’- সুরা নহল ৩৬। এই কালিমা তাইয়্যেবা স্রেফ একটি বাক্য নয়, এ এক বিপ্লবাত্মক ঘোষণা, বলতে পারেন এক পলিটিকাল স্লোগান যার আঘাতে সকল স্বৈরশাসক অস্থির হয়ে পড়েছিল। এই কালিমা যখনই কোনো নবি-রসুল তাঁর জাতির কাছে ঘোষণা করেছেন তখনই শাসকবর্গ ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করেছে এবং এটিই স্বাভাবিক। আজও যারা তাগুতকে অস্বীকার করে একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহকে মানতে চায় তাগুতের পক্ষ থেকে বাধা আসবেই। দেশে দেশে ইসলামপন্থীদের উপর স্বৈরশাসকদের বাধা ও জুলুম-নির্যাতন কুরআনে বর্ণিত অতীতকালে নবি-রসুল ও তাঁদের সঙ্গী- সাথিদের সাথে যা করা হয়েছে তারই ধারাবাহিকতা।
আল্লাহপাক তাঁর ঈমানদার বান্দাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চান। তাঁর বাণী, ‘তোমরা সর্বোত্তম দল। তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করবে’- সুরা আলে ইমরান ১১০। রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া আদেশ দানের ক্ষমতা কারো নেই এবং শক্তি প্রয়োগ ছাড়া শুধু নসিহতের মাধ্যমে মন্দ থেকে দূরে রাখাও সম্ভব নয়। ইসলামী রাষ্ট্র বলতে বোঝায় কল্যাণমূলক সমাজ, এক ইনসাফপূর্ণ সমাজ যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না, থাকবে না শোষণ-বঞ্চনা। ইসলামে ন্যায়পারায়ণ শাসকের মর্যাদা দুনিয়া ও আখেরাতে অনেক উচ্চে। এ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘হাশরের ময়দানে যখন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো আশ্রয় থাকবে না সেই কঠিন মুহূর্তে আরশের ছায়ার নিচে আশ্রয়প্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম হবেন ন্যায়পরায়ণ শাসক ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী বিচারক’। আবার তিনি হুশিয়ারিও উচ্চারণ করেন এই বলে ‘যে শাসক জালেম ও খেয়ানতকারী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবে, আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন’। তিনি বলেন, ‘যে বিচারক সত্যকে জানতে পেরেও ফায়সালা করার ব্যাপারে অবিচার ও জুলুম করেছে, সে জাহান্নামে যাবে। আর যে অজ্ঞতা সত্ত্বেও জনগণের জন্য বিচার ফয়সালা করেছে সেও জাহান্নামি হবে’।
রাজনীতি বহির্ভূত জীবন মুসলমানের জীবন নয়। মুসলমান মাত্রই একজন সংগ্রামী, লড়াকু ও সার্বক্ষণিক মুজাহিদ। আল্লাহপাকের স্পষ্ট বাণী, ‘যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে আর যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই তোমরা শয়তানের সঙ্গী-সাথিদের বিরুদ্ধে লড়াই করো আর বিশ্বাস করো শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’- সুরা আন নেসা ৭৬। এই দু’টি পক্ষের (মুমিন ও কাফের) বাইরে কোনো পক্ষ নেই। যদি থেকে থাকে তাহলে সেটি সুবিধাবাদী পক্ষ, ইসলামের পরিভাষায় যাকে বলা হয় মুনাফিক।
একজন সমাজতন্ত্রী ভালো করেই বুঝে, সে তখনই সমাজতন্ত্রী যখন সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, সে অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলে এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালায় ও এর বিজয় কামনা করে। ঠিক একজন মুসলমানও তাই। মুসলমান সেই যে ইসলামে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করে, জীবনে ইসলাম মেনে চলে ও প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় এবং ইসলামের বিজয় কামনা করে। একজন ব্যক্তির নামাজ-রোজা-হজ-জাকাত, দাঁড়ি-টুপি সব আছে কিন্তু সে বাতিলের মোকাবেলায় ইসলামের বিজয় কামনা করে না সে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়েরের সার্থক অনুসারী নিরেট মুনাফিক বৈ আর কেউ নন। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের সব ছিল কিন্তু রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সান্নিধ্যে থেকেও সে ইসলামের বিজয় কামনা করতে পারেনি। ফলে তার সকল আমল আল্লাহ তায়ালা নিষ্ফল করে দিয়েছেন। ০৯.০৯.২০২৪
Comments
Post a Comment