জুমা আলোচনা
কুচিয়ামোড়া মদিনাতুল উলুম জামে মসজিদ
তারিখ : ২২.০৯.২০২৩
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আমাদের বাড়ির সন্নিকটে এটি একটি নতুন মসজিদ, কুচিয়ামোড়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ। মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রায় ১৫ বছর হলো। আমাদের ইউনিয়নের সেরা ধনী ও দানশীল ব্যক্তি মরহুম আহছান উদ্দিন কোম্পানির ছেলে আলহাজ মো. রশিদুল ইসলাম একক প্রচেষ্টায় ১০ কাঠা জমি ক্রয় করে দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি গড়ে তুলেছেন। দীর্ঘদিন পরিচালনার পর তিনি দায়িত্ব এলাকাবাসীর কাছে অর্পণ করেছেন। বর্তমানে সভাপতি, সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যথাক্রমে ডা. মো. শামীম ফেরদৌস, প্রকৌশলী মো. হারুনর রশিদ এবং জনাব মো. গোলাম জাকারিয়া। মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা মো. আব্দুল্লাহ। এই মসজিদে নামাজ আদায় আজ আমার প্রথম।
মসজিদের সম্মুখে খোলা চত্তর ও অজুখানা- পেশাবখানা সবই আছে এবং মসজিদের মেঝে ও দেয়াল পুরোটাই টাইলস। আমাদের দেশে একটা ভালো দিক হলো, আল্লাহর কোনো বান্দা মসজিদ শুরু করলে অল্পদিনেই সেটি একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদে রূপ নেয়। আলহামদু লিল্লাহ। আমি মরহুম আহছান উদ্দিন ও তাঁর পরিবারে যারা আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন তাঁদের মাগফেরাত কামনা করি এবং আলহাজ মো. রশিদুল ইসলাম ও মসজিদ প্রতিষ্ঠায় তাঁর যারা সহযোগী ছিলেন তাদের সকলের শারীরিক সুস্থতা, দীর্ঘায়ু ও ইসলামের ওপর অবিচল থাকার তৌফিক কামনা করি।
মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়। সেটি এখানে তুলে ধরছি।
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
মসজিদ আল্লাহর ঘর। আল্লাহপাক আমাদের তৌফিক দিয়েছেন তাঁর ঘরে উপস্থিত হওয়ার। আমরা তাঁর বাছাইকৃত বান্দা। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাই। আলহামদু লিল্লাহ।
গ্রামের সব মসজিদে একই দৃশ্য এবং সেটি হলো মুসল্লিরা অনেক বিলম্বে আসেন। অথচ জুমার দিন সপ্তাহের সেরা দিন এবং আমাদের ঈদের দিন। গোসল করে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে আজানের পরপরই আল্লাহর ঘরে আমাদের উপস্থিত হওয়া উচিত। আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় একটি উট কুরবানি করার। অথচ মসজিদে জুমার দিন প্রথম উপস্থিত ব্যক্তি একটি উট কুরবানির সওয়াব পেয়ে থাকেন। আগমনের ভিত্তিতে ফেরেশতারা উট, গরু, ছাগল কুরবানির সওয়াব লিখতে থাকেন এবং খতিব মহোদয় মিম্বরে আরোহণের পরপরই তাঁরা সওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে থাকেন। আপনাদেরকে অনুরোধ করবো, জুমার দিন আজানের সাথে সাথে মসজিদে এসে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে মিম্বরের কাছাকাছি বসে পড়তে।
আপনাদের মসজিদে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি ভালো। আলহামদু লিল্লাহ। সাত বছর বয়স থেকে নামাজের জন্য তাদের তাগিদ দিতে হবে। শিশুরা যদি নামাজের কাতারে ছুটাছুটি করে বা হাসাহাসি করে তাতে নামাজের কোনো ক্ষতি হয় না। রসুলুল্লাহ সা.-এর নাতিদ্বয় থেকে আমরা সেটা জানি। তাঁর নাতিরা তো রীতিমত নানাকে ঘোড়া বানিয়ে আনন্দ করতো। তাই আপনারা সন্তানদের নিয়ে আসবেন এবং নামাজের সাথে সাথে তাদের কুরআন শেখানোর চেষ্টা করবেন।
বর্তমানে সন্তান লালন-পালন বড়ো কঠিন হয়ে পড়েছে। মাদকের ছোবল তো রয়েছেই তার ওপর যোগ হয়েছে মোবাইলে আসক্তি। এই দুরবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের নৈতিক শিক্ষা প্রয়োজন। নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে নামাজ এবং ইসলামী শিক্ষা। একটি ছেলে বা মেয়ে যদি নামাজি হয় তাহলে দেখবেন তার আচার-আচরণ, চাল-চলন অন্যদের থেকে আলাদ। নামাজি ছেলেমেয়েরা বাবা-মা ও মুরুব্বিদের মেনে চলে, নেশা থেকে মুক্ত থাকে এবং লেখাপড়াতেও ভালো। সন্তানদের নামাজে অভ্যস্ত করাতে পারলে আপনারা দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে যাবেন। আর আল্লাহপাক নিজেই গ্যারান্টি দিয়েছেন। তাঁর বাণী, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে।’
শুধু জুমা নয় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করা আল্লাহপাক আমাদের প্রতি ফরজ করেছেন। একজন ব্যক্তির মুসলিম পরিচিতি হয় নামাজের মধ্য দিয়ে। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ঈমান ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো নামাজ। জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে রসুলুল্লাহ সা. জোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি তাঁর অন্ধ সাহাবি উম্মে মাকতুম রা.-কেও একাকী নামাজ পড়ার অনুমতি দেননি। তিনি বলেছেন, আজান শুনে যারা ঘরে বসে থাকে, আমার ইচ্ছা হয়, আমার এখানে আর কেউ ইমামতি করুক আর আমি গিয়ে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেই। দেই না শুধু এ কারণে যে সেখানে নারী ও শিশু বাস করে। আমাদের বোঝা উচিত, রহমাতুল্লিল আলামিন কারো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে চাইলে তাদের কি আর কিছু থাকে। আলী রা. বলেন, মসজিদের যারা প্রতিবেশী তাদের নামাজ মসজিদেই আদায় করতে হবে। মাইকের কারণে আজান না শোনার মতো আর কেহ নেই।
আপনারা মসজিদ নির্মাণ করেছেন এই আশায় যে আল্লাহপাক জান্নাতে আপনাদের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দিবেন। সেই ঘর কিন্তু তালাবদ্ধ থাকবে। তালা খুলে প্রবেশের জন্য যে চাবি সেটি হলো নামাজ। নামাজে অবহেলা করে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। গ্রামের মানুষ আপনারা নানাকর্মে ব্যস্ত থাকেন। মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ার মধ্য দিয়ে আপনাদের দিনের কাজ শুরু হতে পারে। এতে আপনারা সুস্থও থাকতে পারবেন।
রসুলুল্লাহ সা.-এর সময়ে নামাজ না পড়ে কেউ মুসলমান থাকতে পারতো না। মুনাফিকরা বাধ্য হয়ে নামাজ আদায় করতো কিন্তু অবহেলা করতো। সুরা মাউনে সেটাই বলা হয়েছে। রসুল সা. বলেছেন, আমাদের ও মুনাফিকদের মধ্যে পার্থক্য হলো ফজর ও এশার সালাতে হাজির হওয়া। আপনারা নামাজ ছাড়বেন না। সাধারণ মানুষের হিসাব আল্লাহপাক খুবই হালকাভাবে নেবেন। আপনাদের আয়-রোজগার হালাল। আশা করা যায়, নামাজে কোনো অবহেলা না করলে জান্নাতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।
আল্লাহপাক আলেমদের অনেক ইজ্জত দান করেছেন। এখন আর নবি-রসুল আসবেন না। তাঁদের অবর্তমানে নবিদের দায়িত্ব পালন করেন আলেম সমাজ। রসুলুল্লাহ সা. আলেমদের তাঁর ওয়ারিশ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘আলেমগণ হলেন নবিদের ওয়ারিশ। নবিগণ কোনো দিনার বা দিরহাম মিরাসরূপে রেখে যান না; তাঁরা উত্তরাধিকারসূত্রে রেখে যান শুধু ইলম। সুতরাং যে ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’- সুনানে আবু দাউদ ৩৬৪৩।
আমার সন্তান আমার উত্তরাধিকার। নিশ্চয়ই আমার সন্তানের সাথে কেউ দুর্ব্যবহার করলে আমি কষ্ট পাবো। তাই কোনো আলেমকে যদি কেউ কষ্ট দেয় বা তার সাথে অসদাচরণ করে তাহলে বুঝতে হবে রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রতি তার কোনো ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই। শুধু তাই নয়, তার অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসাও নেই।
একজন আলেম ছোট হোক বা বড়ো হোক বা শিক্ষা লাভ করছে এমন সকলের সাথে নবির ওয়ারিশ হিসেবে আপনারা মুহাব্বতের সম্পর্ক রাখবেন। আলেমদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা যদি না করেন তাহলে দেশে আলেম তৈরি হবে না।
গ্রামের মসজিদগুলোয় ইমাম-মুয়াজ্জিন হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদেরকে সামান্যই সম্মানী প্রদান করা হয়। আমরা আমাদের শৈশবে দেখেছি, বাড়িতে লাউ হয়েছে প্রথম লাউটি ইমাম সাহেবের, মুরগির ডিম, গরুর দুধ, নারিকেল যা কিছু বাড়িতে হয়েছে আল্লাহর ঘরের খেদমতে যারা নিয়োজিত তাদেরকে প্রদান করে মানুষ তৃপ্তি লাভ করেছে। সাহাবায়ে কেরাম রসুলুল্লাহ সা.-কে অন্তর থেকে মুহাব্বাত করতেন এবং তাঁকে নিজ বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে পরম তৃপ্তি পেতেন। এখন নবি নেই, কিন্তু নবির ওয়ারিশ আলেমদের প্রতি উত্তম ব্যবহারের বিনিময়ে সেই সওয়াব আপনারাও লাভ করতে পারেন।
দানের ক্ষেত্রে মসজিদ আবাদকারী ইমাম- মুয়াজ্জিনদের অগ্রাধিকার দিবেন এবং এটা আল্লাহরই কথা। তাঁর বাণী, ‘দান-সদকা প্রাপ্য সেসব অভাবগ্রস্ত লোকদের, যারা আল্লাহর কাজে নিয়োজিত থাকায় জীবিকার জন্য জমিনে পদচারণা করতে পারে না এবং (আত্মসম্ভ্রমের কারণে) কারও নিকট হাত পাতে না বলে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদের (দারিদ্রের) লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট মিনতি করে যাচনা করে না। আর যে কল্যাণকর কিছু তোমরা ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’- বাকারা ২৭৩। মসজিদগুলোর আয়ের কোনো উৎস নেই। আপনাদের দানই মসজিদের আয়। আপনারা উদার হাতে দান করবেন, বিনিময়ে আল্লাহও আপনাদের বেহিসেবী দান করবেন। আমি ঢাকায় একটি মসজিদ সম্পর্কে জানি যাদের এক জুমায় দানবাক্সে আদায় দুই লক্ষ ছাব্বিশ হাজার টাকা।
মানুষ সুদ নেয় এই ধারণায় যে তার সম্পদ বেড়ে যাবে। অথচ আল্লাহপাক বলেন, আল্লাহ সুদকে নির্মূল করে দেন এবং দান-সাদাকাকে ক্রমবৃদ্ধি দান করেন। জাকাত শব্দের দুটি অর্থ- এক. পবিত্রতা, দুই. ক্রমবৃদ্ধি। তাই আমরা আল্লাহর পথে খরচের ক্ষেত্রে একটু উদার হই। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর পথে ব্যায় করাকে সহজ করে দিন। আমিন।
Comments
Post a Comment