মুসলমান মাত্রই দায়ী ইলাল্লাহ। দীনের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে দাওয়াতের ওপর। আল্লাহপাক যাদেরকে হেদায়াত দান করেছেন তারা বড়ো ভাগ্যবান এবং তারা বিশ্বাস করে যে দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে তারা সফলকাম। তারা চেষ্টা করে অপরাপর লোকের কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার। সুরা আসরে স্পষ্ট করা হয়েছে যে স্রেফ ঈমান ও নেক আমল জান্নাতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। সাথে সাথে প্রয়োজন মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছানো ও ধৈর্য ধারণ করা।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে দাওয়াতে দীনের কাজ চলমান রয়েছে। ওহি প্রাপ্তির পরপরই রসুলুল্লাহ সা. মানুষের কাছে প্রথমে গোপনে ও পরবর্তী সময়ে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়েছেন। দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে তিনি প্রথমে আত্মীয়স্বজনকে বাছাই করেছেন। প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি হলেন তাঁর স্ত্রী খাদিজা রা. এবং তার সাথে আলী রা ও আবু বকর রা. প্রমুখ। সম্প্রতি এক ইসলামী সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিজ পরিবার ও আত্মীয়- স্বজনের মধ্যে দীনের দাওয়াত ও ইসলাম মেনে চলার জন্য সপ্তাহব্যাপী পরিবার দিবস পালন করছে। তাদের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সপ্তাহে একদিন পারিবারিক বৈঠক করা। দাওয়াত দান ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এটি একটা প্রশংসীয় উদ্যোগ।
স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে মানব সমাজের ক্ষুদ্র ইউনিটকে আমরা বলি একক পরিবার এবং পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ভাই-বোন ও প্রয়োজনে আরো সদস্য নিয়ে সৃষ্টি হয় যৌথ পরিবার। পরিবার একক না যৌথ সেটা নির্ভর করে প্রয়োজন বিবেচনায়। এখানে কারো গুরুত্ব হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। পরিবারের ভরণপোষণ, তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা পরিবার প্রধান হিসেবে পিতার মৌলিক দায়িত্ব এবং পরিবারের জন্য ব্যয় অন্য যে কোনো খাতে ব্যয়ের তুলনায় সর্বোচ্চ ফজিলতপূর্ণ। শুধু ভরণপোষণ নয় দীন শেখানোও পরিবার প্রধানের মৌলিক দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার বাণী
হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ও নিজেদের পরিবার পরিজনদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর। সুরা তাহরিম ০৬।
এটি আল্লাহপাকের নির্দেশ। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে স্বামী/স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন জান্নাতে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই নিজের স্বামী/স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোনকে দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। জান্নাতে এককভাবে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রশান্তি নেই। বরং নিজেসহ স্বামী/স্ত্রী, বাবা-মা, ছেলে- মেয়েসহ একত্রে যাওয়ার মধ্যেই রয়েছে প্রশান্তি। আল্লাহ তায়ালা সেটিই চান। তাঁর বাণী -
(তাদের বলা হবে) তোমরা এবং তোমাদের স্বামী/স্ত্রী জান্নাতে প্রবেশ করো, সেখানে তোমাদের মেহমানদারি করা হবে। সুরা আয যুখরুফ ৭০।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন -
(নেক বান্দা তারাও) যারা বলে, হে আমাদের রব, তুমি আমাদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান করো, (উপরন্তু) তুমি আমাদের মুত্তাকিদের ইমাম বানিয়ে দাও। সুরা আল ফুরকান ৭৪।
চোখজুড়ানো সন্তান-সন্ততি পেতে হলে তাদেরকে অবশ্যই দীনের জ্ঞান ও নামাজে অভ্যস্ত করাতে হবে। লোকমান আ. তাঁর সন্তানকে দেয়া উপদেশ আল্লাহপাক তুলে ধরেছেন।
হে বৎস! তুমি নামাজ প্রতিষ্ঠা করো, মানুষদের ভালো কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখো, তোমার ওপর কোনো বিপদ মুসিবত এলে তার ওপর ধৈর্য ধারণ করো; এটি নিসন্দেহে বড়ো সাহসিকতাপূর্ণ কাজ। সুরা লোকমান ১৭।
আল্লাহপাক মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম আ.- এর দোয়া তুলে ধরেছেন- হে আমার রব! তুমি আমাকে নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী বানাও, আমার সন্তানদের মাঝ থেকেও, হে আমাদের রব, আমার দোয়া তুমি কবুল করো। সুরা ইব্রাহিম ৪০
সন্তান-সন্ততিকে চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আল্লাহ তায়ালা নামাজের কথা বিভিন্নভাবে বলেছেন। তাঁর বাণী -
যে কিতাব তোমার ওপর নাজিল হয়েছে তুমি তা তেলাওয়াত করো এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করো; নিসন্দেহে নামাজ মানুষকে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে; পরন্তু আল্লাহ তায়ালার স্মরণ একটি মহান কাজ; তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তায়ালা তা জানেন। সুরা আনকাবুত ৪৫।
ইসলামী সরকারেরও যে চারটি মৌলিক কাজ তার প্রথম হলো নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। পরিবার প্রধান হিসেবে সদস্যদের থেকে ভালো কিছু আশা করলে পরিবারে দীনের চর্চা ও নামাজের অনুশীলন অবশ্যম্ভাবী। ৭/৮ বছর থেকে শিশুকে নামাজে অভ্যস্ত করার লক্ষ্যে মসজিদে সঙ্গে করে নিতে হবে এবং আদর-সোহাগের মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে মৃদু আঘাতও করা যাবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, পড়াশোনা না করলে বা স্কুলে না গেলে আমরা যতটা পেরেশান হয়ে পড়ি, নামাজের গাফিলতি আমাদের ততটা পেরেশান করে না।
আমাদের পারিবারিক বন্ধন ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে যাচ্ছে, যার ফলশ্রুতিতে দাম্পত্য সম্পর্ক আর মধুর থাকছে না বা বলা যায় একে অপরকে দেখে প্রশান্তচিত্ত হচ্ছি না। সন্তান-সন্ততি আর চোখ শীতলকারী না হয়ে দুঃখ কষ্টের কারণ হয়ে পড়ছে। অথচ ওদের জন্যই সকল কর্মপ্রচেষ্টা। আমরা কি শুধু হতাশা প্রকাশ করে নিরব হয়ে যাবো না কার্যকর কোনো কর্মপন্থা গ্রহণ করবো?
পরিবারে মূল ভূমিকায় থাকে স্বামী-স্ত্রী। এখানে কারো মর্যাদা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই বা কেউ তার দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। সন্তান প্রতিপালনে মায়ের ভূমিকাই বেশি এবং সন্তানের কাছে মায়ের মর্যাদা পিতা অপেক্ষা তিন গুণ বেশি। পরিবার প্রধান হিসেবে ভরণপোষণের দায়িত্ব পিতাকেই বহন করতে হয় এবং সামগ্রিক কর্তৃত্ব পিতার ওপরই ন্যস্ত। ফলে স্বামীর অনুগত হয়ে চলাটাই স্ত্রীর কর্তব্য এবং যে সংসারে স্বামীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত সেই পরিবারে সুখ-শান্তি বিরাজ করে। কুরআনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা এভাবে তুলে ধরা হয়েছে -'ঈমানদার নর ও নারী পরস্পর বন্ধু ও সাথি।' কেউ কারো প্রভু বা দাস নয়। সাথে সাথে বলা হয়েছে ঈমানদার নারী স্বামীর অনুগত হয়ে চলে। আমি এভাবে উপস্থাপন করতে চাই- গৃহরূপ রাষ্ট্রে স্বামী হলো রাষ্ট্রপ্রধান এবং স্ত্রী হলো তার অধীন প্রধানমন্ত্রী, যেখানে স্ত্রীকে মান্য করে চলা হয়।
পরিবারে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় যদি সেখানে পরামর্শ করার নিয়ম থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে যেখানে একাধিক লোকের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেখানে অবশ্যই পরামর্শক্রমে কাজ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেছেন, তারা তাদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরামর্শ করবে এবং সন্তান বড়ো হলে তাকেও পরামর্শে শরীক করতে হবে। আমরা সপ্তাহের একটি দিনকে Family day হিসেবে বিবেচনা করে কুরআন-হাদিস থেকে কিছু আলোচনার পাশাপাশি পরিবারে সামগ্রিক বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এছাড়া একত্রে খানাপিনা, বেড়ানো, হালকা বিনোদনও হতে পারে। শুধু আয়-উপার্জনই নয় স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের সময়ও দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের পরিবারকে সকলের জন্য নয়ন শীতলকারী বানিয়ে দিন। আমিন।
Comments
Post a Comment