দেশে মাদকের সয়লাব বয়ে চলছে। গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র সবার মাঝে মাদকের প্রসার। দেশের ছাত্র ও যুবসমাজ মাদকের ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত মাদকের ব্যবহারটা আড়ালেই হয়ে থাকে। তারপরও যতটুকু প্রকাশ পায় সে চিত্রও ভয়াবহ। মা’র অসুস্থতার কারণে এবারে বাড়ি এসে দীর্ঘদিন থাকা হলো। অত্যন্ত সচ্ছল পরিবারের এক পিতা একদিন রাস্তায় আমাকে ধরে কেঁদে বললো, ছেলেদের কারণে আমি শেষ হয়ে গিয়েছি। অথচ তিনি ছিলেন এক সচ্ছল ও পরিচিত ব্যবসায়ী। তার দুটি ছেলে এবং দুটিই মাদকাসক্ত। একজন দূরদেশে মরে থাকলো এবং লাশ আত্মীয়স্বজন এনে দাফনের ব্যবস্থা করলো। আর বড়ো ছেলের স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে সম্ভবত অন্যত্র বিয়েসাদী করেছে। শেষে আমার সেই ভাইটিও মারা গেল। তার স্ত্রী বর্তমানে খুবই অসুস্থ এবং ছোট ছেলের বিধবা স্ত্রী সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করছে। মাদকাসক্ত বড়ো ছেলেটি এখন সংসারের জন্য বোঝা। মাদকাসক্ত সন্তান কর্তৃক পিতার প্রহৃত হওয়ার ঘটনাও আমি জানি। এই হলো আমাদের সমাজচিত্র। মাদকাসক্ত সন্তানের কাছে বাবা-মা বড়ো অসহায়। যখন যেটা দাবি করে সেটি দিতে বাধ্য হয়।
প্রাক ইসলামি যুগে আরবে মাদকের ব্যাপক প্রসার ছিল। সেই সমাজে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, জেনা-ব্যাভিচার প্রসারের পেছনে মাদক ছিল অন্যতম কারণ। মাদকগ্রহণ ছিল তৎকালে আভিজাত্যের প্রতীক। বর্তমানে ধনী-দরিদ্র সবার মাঝে মাদকাসক্তি লক্ষ করা যায়। আমাদের গ্রাগুলোও আর নিরাপদ নয়। একটি কমন কথা শুনি, হেরোইনখোরদের কারণে লোহালক্কড় বা কোনো কিছুই বাইরে রাখা সম্ভব নয়। মক্কায় তেরো বছর মুহাম্মদ সা. মদের ব্যাপারে নীরব থাকলেও নৈতিকতাবোধসম্পন্ন অনেকেই মদ স্পর্শ করতেন না। তেরোটি বছর তাওহিদ, আখেরাত ও রেসালাতের দাওয়াতের মাধ্যমে একদল মানুষের মাঝে এমন ইমান তিনি তৈরি করেছিলেন যাতে আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর যে কোনো বিধান দ্বিধাহীনচিত্তে মেনে নিতে পারেন। এসব সোনার মানুষগুলোর (সাহাবি রা.) কথা ছিল, ‘আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম’।
মদ হারাম হয় মদিনায় এবং বিভিন্ন পর্যায়ে। মক্কিযুগে একটু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। হাবশায় হিজরতের সময়কালে নাজিলকৃত সুরা নাহলে বলা হয়েছে খেজুর ও আঙ্গুর উত্তম খাবার, কিন্তু তোমরা পচিয়ে মদও তৈরি করো। এতটুকু বলেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘আর খেজুর গাছের ফল ও আঙ্গুর হতে তোমরা মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাকো- সুরা নাহল ৬৭।
মদিনায় হিজরতের পরে পর্যায়ক্রমে মদ হারাম করা হয়েছে। আরবের অন্যান্যদের মতো সাহাবায়ে কেরামও মদ পান করতেন কিন্তু এটা নিয়ে তাঁদের মাঝে কানাঘুঁষা ছিল। রসুলুল্লাহ সা. অপেক্ষা করছিলেন আল্লাহর নির্দেশের দিকে। কুরআনের বাণী, ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। হে নবি! আপনি বলে দিন, এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে। তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়ো’- সুরা বাকারা ২১৯।
সুস্পষ্ট হারাম না করে বলা হয়েছে যে ভালো-মন্দ দুইই থাকলেও মন্দ বেশি। এতে অনেকেই ছেড়ে দেন। মদপানের ফলে মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পায় এবং আবল তাবল বকে। মাতাল হয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে নামাজে হাজির হতে না করা হয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা মাতাল অবস্থায় নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না। যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে সক্ষম হও যা তোমরা বলছো’- সুরা নিসা ৪৩।
এই নির্দেশের ফলে মদপান অনেকাংশে লোপ পায়। সর্বশেষ মদ নিষিদ্ধের আয়াত আসে সুরা মায়েদায়। আল্লাহর বাণী, ‘হে ইমানদারগণ! নিশ্চয় মদ, জুয়া, পূজার বেদি, লটারি ইত্যাদি ঘৃণিত ও শয়তানের কাজ। এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে। শয়তান তো চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদের বিরত রাখতে। তাহলে তোমরা কি এসব থেকে বিরত থাকবে না?’- সুরা মায়েদা ৯০-৯১।
এই আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে মদ, জুয়া ইত্যাদি অত্যন্ত ঘৃণ্য ও শয়তানের কাজ এবং শয়তান চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে। সাথে সাথে আরো বলা হয়েছে যে মদ ও জুয়া মানুষকে নামাজ থেকেও গাফেল করে। এই নির্দেশ আসার পর সাহাবায়ে কেরাম তাৎক্ষণিক মদ বর্জন করেন এবং ঘোষক যখন ঘোষণা করতে থাকেন তখন কারো হাতে মদের গ্লাস থাকলে তিনি তা ছুঁড়ে ফেলেন। মদ বিদায় নেয়। রাষ্ট্র মদ নিষিদ্ধের ব্যাপারে শক্তি প্রয়োগ করে কার্যকর করে। ওমর রা.-এর শাসনামলে কোনো এক দোকান থেকে গোপনে মদ বিক্রি হলে তিনি সেই দোকানটি জ্বালিয়ে দেন এবং কোনো এক গ্রামে মদ তৈরি করা হলে তিনি পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেন।
মদের ভয়াবহতা সম্পর্কে রসুলুল্লাহ সা.-এর কিছু হাদিস উল্লেখ করতে চাই।
তুমি মদ্যপান করবে না। কেননা ইহা সব মন্দের চাবিকাঠি- ইবনে মাজাহ। তিনি আরো বলেছেন, মাদক গ্রহণকারী জান্নাতে যাবে না- ইবনে মাজাহ।
হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. আমাকে দশটি বিষয়ে উপদেশ দান করেছেন, (তন্মধ্যে একটি হলো) কখনো শরাব তথা মদ পান করবে না। কেননা, তা সকল প্রকার অশ্লীল কর্মের উৎস- আহমাদ।
হজরত ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন, প্রত্যেক নেশা আনয়নকারী বস্তু মদের শামিল এবং প্রত্যেক নেশা আনয়নকারী বস্তু হারাম।
হজরত আনাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. মদের ক্ষেত্রে দশ ব্যক্তিকে অভিসম্পাত করেছেন। এক. মদ প্রস্তুতকারী, দুই. যার নিমিত্তে মদ তৈরি করা হয়, তিন. মদ পানকারী, চার. মদ বহনকারী, পাঁচ. যার নিকট মদ বহন করে নেওয়া হয়, ছয়. মদ পরিবেশনকারী, সাত. মদ বিক্রেতা, আট. মদের মূল্য ভোগকারী ব্যক্তি, নয়. মদ তৈরি করার আসবাব ক্রয়কারী ব্যক্তি, দশ. মদের নিমিত্তে যা ক্রয় করা হয়’- তিরমিজি, ইবনে মাজাহ।
যুক্তরাষ্ট্রের নারীসমাজ নারীর ভোটাধিকার প্রাপ্তি ও মদপান নিষিদ্ধকরণের দাবিতে আন্দোলন করে। ফলশ্রুতিতে সংবিধানের ১৮তম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯২০-১৯৩৩ পর্যন্ত মদ তৈরি, বিপণন, আমদানি এবং পরিবহন পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল। এই সময়টাকে প্রহিবিশন যুগ বলা হয়। কিন্তু এতে দেখা যায় অপরাধী চক্র গোপনে মদ তৈরি ও বিক্রি করতে থাকে। ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় এবং নিম্নমানের মদ পান করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে ও মারা যায়। পরবর্তী সময়ে রুজভেল্ট তার নির্বাচনী ওয়াদায় মদের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তা কার্যকর করেন। এখনো যুক্তরাষ্ট্রে ২১ বছরের কমবয়সীরা আইনত মদ পান করতে পারে না। তাদের কাছে অ্যালকোহল বিক্রি নিষিদ্ধ। আমেরিকায় প্রতি পাঁচজনের একজন মনে করে মদ পান নৈতিকতার খেলাপ।
আমাদের সমাজে প্রকাশ্যে মদপান ও বেচাকেনা হয় না। বিভিন্ন হোটেলে নারী ও মদের উপস্থিতির কারণে পুলিশী অভিযান এবং গোপনে মদপান করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া ও মারা যাওয়ার খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। আমাদের সমাজে ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী লোকদের মাঝে বলা যায় মদপান শূন্য। প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসীদের মাঝে মাদকের ব্যবহারটা বেশি। আমাদের শিশু-কিশোরদের মাঝে ইসলামি শিক্ষার প্রসার, ধর্মীয় আচার- আচরণ বিশেষ করে নামাজে অভ্যস্ত করাতে পারলে মাদকের ছোবল থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। মাদক গ্রহণ শুরু হয় বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা ও শিশু- কিশোরদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারলে তাদেরকে অসৎ সংসর্গ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। যে কোনো অভ্যাস দ্রুত পরিবর্তন করা সহজসাধ্য নয়। এজন্য প্রয়োজন দৃঢ় ইচ্ছা ও পর্যায়ক্রমে সরে আসা। আল্লাহপাক আমাদের প্রতি রহম করুন এবং সন্তান দ্বারা চোখকে শীতল করে দিন। আমিন। ২৫.০৪.২০২৩
Comments
Post a Comment