Skip to main content

সদাচারী ব্যক্তিই সফলকাম

 সদাচারী ব্যক্তি অর্থাৎ উত্তম আচরণকারী ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে সফল। এখানে সদাচরণ বলতে আল্লাহর প্রতি, নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, মানুষের প্রতি ও সমগ্র সৃষ্টির প্রতি উত্তম আচরণ বোঝানো হয়েছে। আল্লাহর প্রতি সদাচার অর্থ আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা পোষণ, তাঁর নাফরমানি না করা ও অনুগত হয়ে চলা। ইসলাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে বিশ্বাসী। আল্লাহর দরবারে ব্যক্তিকে এককভাবে দাঁড়াতে হবে। কেহ কারো বোঝা বহন করবে না। ইসলামের দাবি নিজে বাঁচো ও পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। নিজেকে ধ্বংস করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধন করতে ইসলাম বলে না বরং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে নিজের মর্যাদা উন্নীত করার কথাই বলে। নিজেকে বাঁচাও বলতে নিজের শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেয়ার পাশাপশি নৈতিক মান সমুন্নত রাখা বোঝায়। মানুষ প্রায়ই নিজের সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনের কারণে দুর্নীতি করে থাকে। এমন আচরণ ব্যক্তির নিজের প্রতি সদাচার নয় বরং সুস্পষ্ট জুলুম। আবার ইবাদত -বন্দেগির নামে নিজের ওপর কাঠিন্য চাপিয়ে নেয়া ইসলামে পছন্দ নয়। ইসলাম মধ্যমপন্থা পছন্দ করে।

ব্যক্তির পাশাপাশি পরিবারের প্রতি সুবিচার করার জোর তাগিদ ইসলাম তার অনুসারীদের প্রদান করে। পরিবারে সদাচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বড়ো হকদার মাতা-পিতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি ও ঊর্ধে যদি কেহ থেকে থাকে। আল্লাহর আনুগত্যের পাশাপাশি পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করার তাগিদ আমরা সুরা বনি ইসরাইলসহ কুরআন মজিদে বিভিন্ন আয়াতে পাই। সবসময় তাঁদের প্রতি নত হয়ে চলা এবং বার্ধক্যে উপনীত হলে বিরক্তিসূচক একটু উহ্ শব্দও উচ্চারণ না করার জন্য আল্লাহ নির্দেশ প্রদান করেছেন। পিতামাতা ইন্তেকাল করলে তাদের জন্য দোয়া করার কথা আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এবং দোয়া করার ভাষাও তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন (রব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা)। যিনি দোয়া কবুল করবেন তিনিই আবার দোয়ার ভাষা শিখিয়ে দিয়েছেন, এ দোয়া কবুল না হয়ে পারে না। পিতামাতার কর্তব্য, সন্তানকে উত্তম খাবার, পোশাক ও ভালো প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি দোয়াকারী নেক সন্তান হিসেবে গড়ে তোলা। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া ছাড়া বাবা-মার বড়ো কিছু দেওয়ার নেই।

একটি পরিবারের ভিত্তি হলো স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান -সন্ততি। মানুষ এদের প্রতি খুব দুর্বল থাকে। একজন ব্যক্তির নিজের প্রয়োজন খুবই সীমিত। অধিকাংশ সময় স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মনোরঞ্জনের জন্য মানুষ অন্যায় পথে পা বাড়ায়। আল্লাহপাক সুরা তাগাবুনে সতর্ক করেছেন, তোমাদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে কতিপয় শত্রু, তাদের ব্যাপারে সাবধান থেকো। আল্লাহপাক সতর্ক করেছেন, কিন্তু ঝগড়াঝাটি ও মারপিট করতে বলেননি বরং ক্ষমা ও সহনশীল আচরণ করার কথা বলেছেন। স্বামী/স্ত্রী ও সন্তান -সন্ততি দ্বারা চোখকে শীতল করে দেওয়ার জন্য আল্লাহপাক তাঁর কাছে দোয়া করতে বলেছেন। চোখজুড়ানো স্বামী/স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তায়ালার বড়ো নেয়ামত। একটি বয়সে উপনীত হলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। স্বামী-স্ত্রীর এই জুটিকে আল্লাহ পরস্পরের বন্ধু ও সাথি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। স্বামী-স্ত্রী এবং মাতাপিতা ও সন্তানদের মধ্যে সৌহার্দ্য- সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সকলের প্রচেষ্টা থাকা দরকার। কখনো মনোমালিন্য ও রাগ- অভিমান হবে না, এমনটি নয়, স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনেও ঘটেছে। এব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা হলো ক্ষমা ও সহনশীল আচরণ করা। উদারতা, ক্ষমাশীলতা জীবনটাকে সহজ করে, আনন্দময় করে। পক্ষান্তরে সংকীর্ণতা জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলে। আল্লাহপাকের বাণী, যে স্বীয় মনের সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করলো সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করলো- সুরা তাগাবুন। সন্তানকে সময় দিতে হবে, সদাচরণ ও নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে। সন্তানকে নামাজের ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে। নামাজের মাধ্যমে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখার ব্যাপারে আল্লাহ নিশ্চয়তা দান করেছেন। আমরা আমাদের সন্তানদের দীন শেখার ব্যাপারে যত্নশীল হই যাতে সন্তান আমাদের জন্য দোয়াকারী হয়। 

আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, চলার পথের সাথি সকলের সাথে সদাচরণ করা ইসলামের দাবি। দুর্ব্যবহার, জুলুম একজন মুমিনের কাছে অকল্পনীয়। সুরা হুমাজায় আল্লাহপাক বলেছেন, নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা -সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে। একটু গালাগাল ও অসাক্ষাতে নিন্দাবাদ যদি কারো ধ্বংস নিশ্চিত করে তাহলে যারা গুম- খুনের মতো ঘটনা ঘটায় তাদের পরিণতি কী হতে পারে? এককথায় বলা যায়, জান্নাত রয়েছে সদাচারী ও বিনয়ী লোকদের জন্য। পক্ষান্তরে জাহান্নামের বাসিন্দা হবে দাম্ভিক, অহঙ্কারী ও জালেমরা। দুনিয়ার জীবনে জালেমের অঢেল ধনসম্পদ, ক্ষমতা ও মর্যাদা থাকলেও আখেরাতে সে হবে সবচেয়ে নিঃস্ব ও হতভাগা। মজলুমকে তার সব নেক আমল দেওয়ার পরও পরিশোধ হবে না এবং মজলুমের গুনাহ জালেমের ঘাড়ে দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। 

আল্লাহর এক নাম মুমিন এবং আমরাও মুমিন অর্থাৎ নিরাপত্তাদাতা এবং আল্লাহর সকল সৃষ্টি আমাদের থেকে নিরাপদ। ইতরপ্রাণি, গাছপালা সবকিছুকে আমরা সুরক্ষা দান করবো। আমরা এক পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর বিনিময়ে এক পতিতাকে ক্ষমা করার কথা জানি। ভারবাহী পশুকে অতিরিক্ত বোঝা না চাপানোর কথা বলা হয়েছে। জীব-জানোয়ারকে আটকে রেখে কষ্ট দেওয়ার অধিকার কারো নেই। সমগ্র সৃষ্টি মানুষের খেদমতের জন্য নিয়োজিত এবং অবশ্যই তা মানুষের কল্যাণ সাধনে ব্যবহৃত হবে। অপ্রয়োজনে গাছের একটি পাতাও ছেঁড়া যায় না। মোট কথা আল্লাহর সকল সৃষ্টি মুমিনের কাছে নিরাপদ। সমাজের মানুষ কারো কাছ থেকে অসম্মানিত হবে এবং শারীরিক বা মানসিকভাবে কষ্ট পাবে এটা হতেই পারে না। যদি হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে এমন লোকের মুমিন বা মুসলিম হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। মুসলিম মাত্রই সৃষ্টির কল্যাণকামী। আল্লাহপাক একজন মুসলিমকে সেভাবেই উপস্থাপন করেছেন। তাঁর বাণী, তোমরা শ্রেষ্ঠতম উম্মত, তোমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য, তোমরা ভালো কাজের আদেশ দিবে ও মন্দ কাজে নিষেধ করবে।

কুরআন মজিদে নানাভঙ্গিতে বলা হয়েছে ইমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ ব্যক্তি জান্নাতে যাবে এবং সুরা নুর ৫৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে ইমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের আল্লাহ খেলাফত দান করবেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, কুরআন মজিদে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার কথা বারংবার বলা হয়েছে। সবই ঠিক আছে। তবে জান্নাতে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম শর্ত করা হয়েছে নির্ভেজাল ইমান ও ইমানের দাবি অনুসারে নেক আমল করা। আল্লাহকে ইলাহ মেনে কিছু মৌলিক ইবাদত পালন যথেষ্ট নয় বরং তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহকে মানার কথা বলা হয়েছে। আনিই বুদুল্লাহা ওয়াজতানিবুত তগুত (আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তগুতকে অস্বীকার করো)। আল্লাহ তায়ালা প্রতিদিন তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন যদি সেই বান্দা শিরক ও হিংসা থেকে মুক্ত থাকে। কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে প্রমাণ করতে পারে যে, সে ইসলামের পক্ষের শক্তি তাহলে তার সামান্য আমল জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে মানার ক্ষেত্রে যদি কারো মধ্যে দুর্বলতা থাকে এবং ইসলামের শত্রুদের সাথে তার সখ্যতা থাকে তাহলে বুঝতে হবে সে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের সার্থক অনুসারী নিরেট মুনাফিক বৈ আর কেউ নয়।

একজন ছাত্রের তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য হয়তো দৈনিক দুই ঘন্টা করে পড়া যথেষ্ট হতে পারে। কিন্তু সে তাতে সন্তুষ্ট নয়। সে চায় সবার সেরা রেজাল্ট করতে। ফলে সে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালায় এবং দৈনিক ৮/১০ ঘন্টা লেখাপড়া করে। দৈনিক দুই ঘন্টা করে পড়ে উত্তীর্ণ হওয়া ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে। একজন মুমিনের বিষয়টি এমনই। নিষ্ঠাপূর্ণ ইমান এবং মৌলিক ইবাদতসমূহ পালন ও সদাচরণের মাধ্যমে জান্নাতপ্রাপ্তির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যারা আল্লাহর আনুগত্যের পাশাপাশি দীন কায়েমের মাধ্যমে সকলের জন্য আল্লাহর হুকুম পালন সহজ করে দিতে চায় তাদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অতি উচ্চে এবং তাদের জন্যই রয়েছে জান্নাতুল ফেরদাউস। আল্লাহপাক জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকার হওয়ার তৌফিক আমাদের দান করুন। আমিন। ২৪.০৪.২৩

Comments