Skip to main content

আল্লাহর বান্দাকে ক্ষমা করুন বিনিময়ে ক্ষমা পাবেন

 বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

ঈদগাহে আলোচনা (২২.০৪.২০২৩)

কুচিয়ামোড়া বাজার ঈদগাহ

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আজ আমরা ঈদগাহে উপস্থিত হয়েছি ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য। ঈদগাহ কমিটির পক্ষ থেকে আপনাদেরকে জানাই ঈদ মোবারক। সারাদিন রোজা শেষে আমরা সন্ধ্যায় ইফতার করি অর্থাৎ রোজা ভঙ্গ করি। ঈদুল ফিতর অর্থ রোজা ভাঙ্গার আনন্দ। আমরা দীর্ঘ একমাস রোজা পালন করেছি আজ তার পুরস্কার। ঈদের দিনটিকে বলা হয় পুরস্কার দিবস (ইয়াওমাল জায়েজা)। এতো খুশি, এতো আনন্দ তো এ কারণেই যে, আমরা গুনাহ থেকে মুক্তি লাভ করেছি এবং জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত হয়েছি। আপনাদের কি সন্দেহ হয়? কথা তো আমার নয়, আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর।

রসুলুল্লাহ সা. একদিন মিম্বরে আরোহণ করছেন আর বলছেন-আমিন, আমিন, আমিন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রসুলুল্লাহ সা.! আপনি আমিন, আমিন, আমিন বলছেন কেন? জবাবে বলেন, জিবরাইল আ. এইমাত্র আমাকে বলে গেলেন- যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ নিজের গুনাহ মাফ করে নিতে পারলো না সে যেন ধ্বংস হয়, আমি বললাম- আমিন। জিবরাইল আ. নিজের থেকে কোনো কথা বলেন না বা বলতে পারেন না। আল্লাহরই কথা, তিনি রমজানের মাধ্যমে তাঁর বান্দাকে গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে চান। অর্থাৎ রমজান মাস গুনাহ মাফের মাস।

রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমান ও এহতেছাবের সাথে রোজা রাখবে আল্লাহ তার পেছনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। এখানে ছগিরা-কবিরা নয়, সকল গুনাহ মার্জনা করে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাকে নতুনভাবে চলার সুযোগ করে দিতে চান। আমাদের জীবনে অনেক গুনাহ রয়েছে। আপনারা কি মনে করেন, আল্লাহপাক এই গুনাহের কারণে ধরে ধরে সবাইকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন? না, আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করতে চান। আল্লাহর বাণী- ‘(হে নবি!) বলে দাও, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের আত্মার ওপর জুলুম করেছ তারা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিতভাবে আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু’- সুরা ঝুমার ৫৩। তাই গুনাহ করে হতাশ না হয়ে আল্লাহরই কাছে ফিরে আসতে হবে। গুনাহ থেকে (তওবা) ফিরে আসলেই আল্লাহর ক্ষমা পাওয়া যাবে।

আল্লাহপাক আরো বলেছেন, ‘আল্লাহর কী প্রয়োজন তোমাদের অযথা শাস্তি দেবার, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে থাকো এবং ইমানের নীতির ওপর চলো, আল্লাহ বড়ই পুরস্কার দানকারী ও সর্বজ্ঞ’- সুরা আন নিসা ১৪৭। আপনি যদি আল্লাহর অবাধ্য বান্দা না হয়ে থাকেন অর্থাৎ আল্লাহ সম্পর্কে বেপরোয়া না হন তাহলে আপনি আল্লাহর ক্ষমা আশা করতে পারেন। আমাদের ব্যবহারিক জীবনেও দেখি, কোনো সন্তান যদি পিতামাতার বাধ্য হয়ে থাকে তাহলে তার দোষ-ত্রুটি পিতামাতা উপেক্ষা করে। স্ত্রী যদি স্বামীর বাধ্য হয়ে থাকে তাহলে রান্না খারাপ হওয়া বা কোনো দোষ-ত্রুটি স্বামীর দৃষ্টিতেই আসে না। অবশ্য যারা বাধ্য বা অনুগত তারা ইচ্ছাকৃত নাফরমানি করে না। তাই আল্লাহর অবাধ্য নয়, অনুগত হতে হবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কখনো বাহানা তালাশ করবেন না বরং ক্ষমা করার নানা উপায় খুঁজবেন। 

নেক আমল বদ আমলকে মিটিয়ে দেয়। এক ওয়াক্ত থেকে পরবর্তী ওয়াক্ত পর্যন্ত যেসব গুনাহ হয়ে থাকে আল্লাহপাক নামাজের মাধ্যমে মিটিয়ে দেন। আবার ওজুর মাধ্যমেও অনেক গুনাহ ঝরে যায়। রমজানের রোজা এমন একটি ইবাদত যা পূর্ববর্তী বছরের গুনাহসমূহ মার্জনা করে দেয় এবং জান্নাতের সুসংবাদ দান করে। রাইয়ান নামক স্পেশাল দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ কেবল রোজাদাররাই পাবে। কারণ রোজা মানুষের মধ্যে তাকওয়ার এমন গুণ সৃষ্টি করে যার ফলে তার দ্বারা আর আল্লাহর নাফরমানি সম্ভব হয় না। 

রোজা ফরজ করার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আল্লাহপাক সুরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে বলেছেন, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনটি করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। এতে বোঝা যায়, সকল নবি-রসুলের ওপর রোজা ফরজ ছিল এবং উদ্দেশ্য, মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করা। হ্যাঁ, রোজা রাখার মধ্য দিয়ে আমরা যদি তাকওয়া অর্জন করতে পারি অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে তাঁর সকল নাফরমানি থেকে দূরে থাকতে পারি তাহলে ইনশা-আল্লাহ আমরা পেছনের সকল গুনাহের মার্জনা পাবো।

আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি রাতে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছ আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, রিজিক চাইবে আমি তাকে দেব। প্রতিটি রাতে আল্লাহপাক তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন। ক্ষমা করেন না কেবল মুশরিক ও হিংসুককে। মুশরিক সেই যে আল্লাহর জাত ও ছিফাতে অন্য কাউকে সমকক্ষ বা শরিক করে। সাধারণত জাতে শরিক আমরা করি না। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই আল্লাহর গুণাবলিতে শরিক করে এবং আমাদের মাঝে মাজার ও দরবারকেন্দ্রিক শিরক বেশ হয়ে থাকে। 

আর একটি শিরক হয় আল্লাহর অধিকারের প্রশ্নে। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। সর্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক আল্লাহ এবং মানুষ কেবল আল্লাহরই হুকুম মেনে চলবে। আল্লাহকে মেনে চলার পাশাপাশি আর কাউকে মেনে চলার নামই শিরক। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়- আনিই বুদুল্লাহ ওয়াজতানিবুত তাগুত (আল্লাহর দাসত্ব করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো)- সুরা নহল ৩৬। হাদিসের ভাষায়- স্রষ্টার নাফরমানি করে সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই। যারা নানাভাবে আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরিক করে তাদের ক্ষমা নেই। 

আর ক্ষমা নেই হিংসুকের। হিংসা জঘন্যতম অপরাধ। এটি শুধু কবিরা গুনাহ নয় বরং হিংসা মানুষকে আমলশূন্য করে দেয়। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের সকল নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। সুরা ফালাকে আল্লাহপাক হিংসুকের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে আশ্রয় চাইতে বলেছেন।

আমাদের দেশে হিংসা-বিদ্বেষ প্রবল যার কারণে সমাজে এতো হানাহানি ও খুনোখুনি এবং গিবতের চর্চা। হিংসা থেকে মুক্ত না হলে জান্নাতপ্রাপ্তি সম্ভব নয়। হিংসুক ব্যক্তি মানুষকে ক্ষমা করতে জানে না, সে হয় প্রতিশোধপরায়ণ এবং ফলে তার অন্তরে প্রশান্তি নেই। রাজনীতির অঙ্গনে হিংসা-বিদ্বেষ আমাদের সকল অশান্তির মূল। আমরা ক্ষমা করা ভুলে গেছি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, ভবিষ্যতে আমাদের কবরস্থানও আলাদা করতে হবে। পক্ষান্তরে মুমিন হয় হিংসামুক্ত, সে হয় উদার ও মানুষকে ক্ষমা করতে জানে।

আপনারা হিংসা পরিহার করে আল্লাহর বান্দাদের ক্ষমা করুন তাহলে আপনারাও আল্লাহর ক্ষমা লাভে ধন্য হবেন। আর খেয়াল রাখবেন, আপনার দ্বারা যেন কোনো জুলুম না হয়। জুলুম ভয়ঙ্কর গুনাহ। জালেমের জন্য জান্নাতে কোনো স্থান নেই।

নামাজ-রোজার পাশাপাশি আপনারা আল্লাহর পথে উদারভাবে খরচ করুন। আল্লাহর পথে খরচকে তিনি কর্জ বলেছেন। আল্লাহকে কর্জে হাসানা দাও, আল্লাহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করো, কত খরচ করলে হিসাব করো না, আল্লাহও বেহিসেবি দান করবেন। এক টুকরো খেজুর দিয়ে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো। দান-সাদাকা মানুষকে বিপদাপদ থেকে হেফাজত করে। 

খরচ করার ক্ষেত্রে মসজিদ-মাদ্রাসার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের প্রতি আপনারা সদয় হবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘সাহায্য সামগ্রী প্রাপ্য সেসব অভাবগ্রস্ত লোকদের, যারা আল্লাহর কাজে নিয়োজিত থাকায় জীবিকার জন্য জমিনে পদচারণা করতে পারে না এবং (আত্মসম্ভ্রমের কারণে) কারও নিকট হাত পাতে না বলে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদের (দারিদ্রের) লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট মিনতি করে যাচনা করে না। আর যে কল্যাণকর কিছু তোমরা ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’- বাকারা ২৭৩। 

রসুলুল্লাহ সা. অর্থসম্পদ রেখে যাননি। রেখে গিয়েছেন ইলম। যারা ইলমের অধিকারী তারা মূলত আল্লাহর রসুল সা.-এর উত্তরাধিকার (ওয়ারিছ) এবং তাঁদের সাথে সদাচরণ অর্থ রসুল সা.-এর সাথেই সদাচরণ। আপনারা মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট ইমাম-মুয়াজ্জিন ও অন্যান্যদের প্রতি দয়ার্দ্র হবেন। তাঁদেরকে উপঢৌকন প্রদান ও গাছের ফলফলাদি প্রদান ভালোবাসারই পরিচায়ক। আল্লাহপাক আমাদেরকে বাকি জীবন তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন।

* প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী কর্তৃক ঈদগাহে আলোচনা।

Comments