গতকাল স্যারের একজন স্নেহাশীষ ও ভক্ত সেলিমকে সাথে করে স্যারের বাড়িতে গিয়েছিলাম। স্যারের বড় ভাই এখনো বেঁচে আছেন। বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই করছে। বড় ভাই ও বড় ছেলে সজলের সাথে (সহকারী শিক্ষক, বাহাদুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়) কিছু সময় কাটালাম। স্যারের অছিয়ত মোতাবেক তারা বাহুল্য কিছু না করে তিনটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে একটি মাদ্রাসায় একত্রিত করে একবেলা আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছিল। সাথে কিছু দরিদ্র মানুষকে যোগ করেছিল। আলহামদু লিল্লাহ।
মৃত্যুর পরে ছওয়াব পৌঁছানোর সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো তার সন্তান, পরিবার ও শুভাকাক্সক্ষীদের পক্ষ থেকে বেশি বেশি করে দুআ ও নেকির কাজ করা। সেটি হতে পারে দরিদ্রদেরকে খাদ্যদান, দান-সাদাকা, সদকায়ে জারিয়া, নামায, রোযা, কুরআন পাঠ, তাছবিহ-তাহলিল বা যে-কোনো নেক আমল করে মাইয়াতের ছওয়াবের উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে পেশ করা। সর্বোপরি আল্লাহর কাছে মাইয়াতের মাগফিরাত কামনা করা। মানুষ মারা যাওয়ার সাথে সাথে তার ভালো ও মন্দ সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু রয়ে যায় নেক সন্তানের দুআ ও নেক আমল, ছদকায়ে জারিয়া ও এমন ইলম যা থেকে মানুষ উপকৃত হয়। পিতা-মাতার জন্য দুআ করার ভাষাটিও আল্লাহপাক শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘রব্বির হামহুমা কামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা’। এ দুআ অব্যর্থ।
সজল জানালো, ‘স্যার, সন্তান যদি গুনাহগার হয় বা পিতা-মাতার হক আদায় না করে থাকে’। আমি বললাম, সন্তান উপলব্ধি করে তাওবা করলেই অতীতের গুনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়া যাবে ইনশা-আল্লাহ। তাওবা অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, গুনাহ থেকে ফিরে আসা এবং সেই গুনাহ আর না করা। আল্লাহ তাঁর বান্দার গুনাহ ক্ষমা করার জন্য উদগ্রিব হয়ে আছেন। আর পিতা-মাতার জন্য বেশি বেশি মাগফিরাত কামনার মাধ্যমে তাঁদের হক আদায়ে যতটুকু ঘাটতি আছে সেটি পূরণ হবে আশা করা যায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের মাধ্যমে বান্দাহ পরিশুদ্ধ হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ তৈরী হয়। নামায মানুষের মাঝে বিনয় সৃষ্টি করে এবং বিনয়ী বান্দাকে আল্লাহ জাহান্নামে দেবেন না।
তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে মানুষের জ্ঞান ও আমলের অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা একটি সময়ে দেখেছি, মানুষ মারা গেলে গরু যবেহ করে খানাপিনার ব্যবস্থা করতো। অনেক সময় দেখা গেছে, জানাযায় যতো মানুষ উপস্থিত হয়েছে এমন সবাইকে অর্থাৎ কয়েক গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করা হয়েছে এবং এটি নিয়ে মানুষ বড়াই করেছে। যার সামর্থ নেই সে ভিক্ষে করে আয়োজন করেছে। এ ছাড়া থাকতো কুরআন খতম, কালেমা পাঠ এবং বাড়িতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে কুরআন পড়ানো ও গ্রামের মসজিদের মুছল্লিদের দ্বারা কালেমা পাঠ ইত্যাদি। আরো থাকতো চল্লিশা ও মৃত্যুবার্ষিকীতে খানাপিনা। এ-সবই এখন দূর হতে চলেছে।
জাহিলিয়াতের জামানায় মানুষ বিয়ে-সাদী, মৃত্যু পরবর্তী ও নানা পর্বে বড় ধরনের খানাপিনার আয়োজন করতো। উট যবেহ হতো একের পর এক এবং এ-সব নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতো। বর্তমানেও বিয়ে-সাদী, গায়ে হলুদ, জন্মদিন, বিবাহ-বার্ষিকী বা মৃত্যু পরবর্তী জাঁক-জমকপূর্ণ খানাপিনার আয়োজন হয়ে থাকে। এ-সবই আত্মতৃপ্তি ও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা। আল্লাহপাক সূরা বালাদে এ-রকম ব্যয়ের নিন্দা প্রকাশ করে উত্তম ব্যয়ের উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহর এ-সব নাফরমানদের কথা-‘আমি প্রচুর ধন-সম্পদ উড়িয়ে দিয়েছি’ (সূরা বালাদ ৭)। অঢেল ধন-সম্পদ থেকে এ-সব ব্যয় তাদের কাছে খুবই সামান্য। শয়তানের প্ররোচনা ও নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে আল্লাহর পথে চলাটাকে দুর্গম গিরিপথ অতিক্রমের সাথে তুলনা করে আল্লাহ বলেছেন, দুর্গম গিরিপথ হলো কোনো গলাকে দাসত্ব মুক্ত করা (ঋণ মুক্ত অর্থও প্রকাশ পায়) অথবা অনাহারের দিন কোনো নিকটবর্তী ইয়াতিম বা ধুলিমলিন মিসকিনকে খাবার খাওয়ানো। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে শামিল হওয়া যারা ঈমান এনেছে এবং যারা পরস্পরকে সবর ও (আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি) রহম করার উপদেশ দেয়। এরাই ডানপন্থী (সূরা বালাদ ১১-১৮)।
আল্লাহর অসহায় বান্দাদের প্রয়োজন পূরণ ও তাদের পাশে দাঁড়ানোয় অনেক ছওয়াবের কথা কুরআন-হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। দান-সদকা মানুষকে বিপদাপদ ও জাহান্নামের আগুন থেকে হেফাজত করে। হাদিসে রয়েছে, তোমরা দান করো, এক টুকরো খেজুর দিয়ে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা করো। আখিরাতে ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হলে মানুষ দুনিয়ায় ফেরৎ এসে দান-সদকা বেশি বেশি করার কথা বলবে। রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমরা খরচ করো, কতো খরচ করলে হিসাব করতে যেও না, আল্লাহ তোমাকে বেহিসেবী দান করবেন। ইয়াতিম, মিসকিন ও বিধবাদের কল্যাণে যারা কাজ করে তারা যেন আল্লাহর পথে জিহাদেই রত। সবই করতে হবে নিজের জীবদ্দোশায়। মারা যাওয়ার সাথে সাথে সম্পদের মালিকানাও হস্তান্তরিত হয়ে যায়।
আল্লাহপাক আমাদেরকে সঠিক উপলব্ধি দান করুন এবং মুসলিম (অনুগত) অবস্থায় তাঁর কাছে ফিরে যাওয়ার তাওফিক দান করুন। ২৮.০১.২০২১
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment