মৃত্যুকে এড়িয়ে চলার কোনো সুযোগ নেই। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরণ করছে। বৃদ্ধ বাবা-মা রয়ে যাচ্ছে অথচ যুবক সন্তান ও শিশু নাতি-নাতনি চলে যাচ্ছে। রসুলুল্লাহ (সা)-এর ছেলে সবগুলো অতি শৈশবে এবং মেয়ে ফাতিমা (রা) ছাড়া সবাই তাঁর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেছেন। এ-সবই পরীক্ষা এবং প্রিয়জনের বিদায়ে যারা ধৈর্য অবলম্বন করে আল্লাহ তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।
প্রিয়জনের মৃত্যু ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে সবাই শোকাতুর হয় এবং নানাভাবে শোক প্রকাশ করে। তিন দিনের বেশি শোক প্রকাশের সুযোগ নেই। তবে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীকে চার মাস দশ দিন শোক পালন করতে হয়। এ সময়ে সাজ-সজ্জা করা এবং অলঙ্কার ও সুগন্ধি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হয়। এমতাবস্থায় স্ত্রীর উচিত স্বামীর ঘরে অবস্থান করা।
প্রিয়জনের মৃত্যুতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন স্বামী-স্ত্রী। তারপরও বলবো স্ত্রীই হন অধিক ক্ষতিগ্রস্ত। স্ত্রী মারা গেলে স্বামী যত সহজেই আর একটি বিয়ে করতে পারে স্বামীর মৃত্যুতে সন্তানের মায়া ও সামাজিক নানা কারণে স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ে অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও ইসলামে বিধবা বিয়েকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আর নারী ও পুরুষের মাঝে সৃষ্টিগতও পার্থক্য রয়েছে। একজন নারী যতখানি সংযমী হতে পারে ও নিজেকে পবিত্র রাখতে পারে, পুরুষ প্রায়ই পারে না। এ ছাড়া সন্তানের প্রতি মায়া-মহব্বত পিতা অপেক্ষা মাতার অনেক বেশি। স্বামীর মৃত্যুর পর যে নারী সন্তানের দিকে চেয়ে নিজের জীবনের স্বাদ-আহলাদ বিসর্জন দেয় রসূলুল্লাহ (সা) সেই নারীর জন্য জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়েছেন।
স্বামীহারা হলে একজন নারীর কষ্ট সীমাহীন। সংশ্লিষ্ট নারীই কেবল তা অনুভব করে। একদিন ফেসবুকে লক্ষ্য করলাম, গল্পচ্ছলে শিক্ষক তার ছাত্রীকে বোঝাতে চাচ্ছেন, কে তার জীবনে অধিক প্রয়োজনীয়। বোর্ডে দশ জন তার প্রিয় মানুষের নাম লিখতে বললে পিতা-মাতা, স্বামী, সন্তানসহ সে দশ জনের নাম লিখে। পাঁচ জনের নাম রেখে বাকিগুলো কেটে দিতে বললে কষ্ট হলেও সেটি করে। শেষে দুটি নাম রাখতে বললে স্বামী ও সন্তানের নাম রাখে। সবই ছিল তার জন্য কষ্টকর। স্বামী ও সন্তানের মধ্যে একটি মুছে দিতে বললে সে আর পেরে উঠে না। অবশেষে স্বামীকে রেখে ছেলের নাম মুছে দেয় এই ভেবে যে, ছেলে বড় হয়ে তাকে ভুলে যেতে পারে কিন্তু স্বামী তার অবলম্বন, তাকে ছাড়া সে চলতে পারবে না। আসলে স্বামী-স্ত্রীর মনোভাব ও সম্পর্ক এমনই হওয়া দরকার।
আমার বেয়াই ছিলেন ডায়লাইসিস রোগী, আর বেয়াইন ছিলেন সুস্থ ও সবল এবং অত্যধিক পরিশ্রমী। পতিপরায়ণা আমার বেয়াইনকে আমরা খুব অনুভব করি। বেয়াইনের মৃত্যুর পর বেয়াই বেশ অসহায় ও ভেঙ্গে পড়েন। একদিন তিনি বলছিলেন, 'আপনার বেয়াইনকে যখন কবরে নামানো হয় তখন আমার মনে হচ্ছিলো সেই কবরে যদি আমাকেও রাখা হতো কতই না ভালো হতো'। তিনি সবসময় বেয়াইনকে অনুভব করতেন এবং তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেন। তিনি প্রায়ই বেয়াইনের একটি বোরকা সঙ্গে রাখতেন। তিনি বলতেন, 'আমার খেদমত ও সন্তুষ্টির বিনিময়ে আল্লাহ তাকে জান্নাত দিবেন'। তাঁর মৃত্যুর পরে অসিয়ত হিসেবে বেয়াইনের কবরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আমার বেয়াইন ছিলেন একজন দ্বায়ী এবং আল্লাহর পথে নিবেদিতপ্রাণ।
মৃত্যু সবসময় আমাদেরকে ডাকছে। যে কোনো সময়ে মৃত্যু চলে আসতে পারে। কোনো কিছু বলে যাওয়ার সুযোগ নাও পাওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি আমার এক ভাই এমনিভাবেই তাঁর রবের কাছে ফিরে গেলেন। মৃত্যুকে নয়, মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে আমাদের ভয় করতে হবে, ভাবতে হবে ও সতর্ক হতে হবে। যে কোনো সময়ে চলে যেতে হবে সেই লক্ষ্যে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। হৃদয়ে আল্লাহর স্মরণ সবসময় জাগরুক রাখতে হবে।
বর্তমানে ব্রেন স্ট্রোক ও হার্ট এ্যাটাক মারাত্মকভাবে দেখা দিয়েছে। এর কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। সব বয়সের মানুষই এর শিকার হচ্ছে। আমার ধারণা, এর পেছনে অন্যতম কারণ টেনশন ও দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা। দাম্পত্য জীবনে কলহ-বিবাদ মানুষকে হতাশ করে এবং জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দই হারিয়ে ফেলে। জীবনকে আনন্দময় এবং দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা দূর করার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সহযোগী হতে পারে। যদি একে অপরের সংস্পর্শে প্রশান্তি পায় তাহলে তা হতে পারে তাদের জন্য বড়ই কল্যাণকর।
ক্ষমার গুণে গুণান্বিত হলে অনেকটা টেনশন ফ্রি থাকা যায়। সেই ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শন স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি, পাড়া-প্রতিবেশি ও বন্ধু-বান্ধবসহ সব শ্রেণির মানুষের সাথে। আমরা সবার জন্য পরস্পর কল্যাণকামী হয়ে যাই এবং কারো মৃত্যুর পর ক্ষমা করার মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষমা নিশ্চিত করি। কারণ প্রিয়তম নবী (সা) বলেছেন, ‘যে তার ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করবেন’। তাতে আশা করা যায় আল্লাহপাক ক্ষমার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে জান্নাতে যাওয়ার পথটি সহজ করে দিবেন।
হে আল্লাহ! তুমি আমাদের ক্ষমা করো ও তোমার পথে চলাটা সহজ করে দাও। আমিন। ১৭.০১.২০২১
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment