করোনা ভাইরাস বর্তমানে বিশ্ববাসীকে তাদের চরম অসহায়ত্ব নতুন করে স্মরণ করে দিয়েছে। ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান প্রদেশে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাস স্বল্প সময়ে দুই শতাধিক দেশকে আক্রমণ করেছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসকে মহামারি হিসেবে উল্লেখ করেছে। অতীতেও পৃথিবী বিভিন্নভাবে মহামারির সম্মুখীন হয়েছে। হযরত ওমর (রা)-এর শাসনামলে সিরিয়ায় মুসলিম সেনাবাহিনী প্রধান হযরত আবু উবায়দা বিন জাররাহ (রা)সহ প্রায় ২০ হাজার সৈনিক প্লেগ রোগে মৃত্যুবরণ করেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে (১৩৪৭-৫২) প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ এই রোগে মারা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দুই কোটি লোক নিহত হয় এবং যুদ্ধ পরবর্তী স্পেনিশ ফ্লুতে মারা যায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। গত শতাব্দীতে এইচআইভি বা এইডস রোগে মারা যায় সাড়ে তিন কোটি। করোনা ভাইরাসে আজ সকাল পর্যন্ত আক্রান্ত মোট দেশের সংখ্যা ২০২, আক্রান্ত জনসংখ্যা ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২৭৯ জন, মৃত্যুর সংখ্যা ২৭ হাজার ৩৭৩ জন এবং সুস্থ হওয়ার সংখ্যা ১ লাখ ৩৩ হাজার ২২ জন। আক্রান্তের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে ১ লাখ ৪ হাজার ৪৬৩ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৬৯৫ জন। মৃতের হিসেবে শীর্ষে ইতালি ৯ হাজার ১৩৪ জন। বাংলাদেশে আক্রান্ত ৪৮ এবং মৃতের সংখ্যা ৫।
মহামারি বা বিপদাপদ যাই বলি না কেন, কোনো কিছু নিজ থেকে আসে না। এ সব কিছুর পেছনে রয়েছে মহাশক্তিধর আল্লাহতায়ালার ক্ষমতা। আমরা এমন এক আল্লাহতে বিশ্বাস করি, যিনি স্রষ্টা হওয়ার সাথে সাথে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। আল্লাহর বাণী- ‘কোনো বিপদ কখনই আসে না, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া’-সূরা তাগাবুন। সমাজের শক্তিমান মানুষগুলো পৃথিবীতে চরম সীমালঙ্ঘন করে যখন তাঁর বান্দাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলে তখন মজলুমের আহাজারির প্রেক্ষিতে আল্লাহপাক জালেমদের প্রতি ধ্বংসের ফয়সালা করে থাকেন। নমরুদ, ফিরাউন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ ছাড়া জাতিগতভাবে মানুষ যখন অশ্লীলতা ও পাপাচারে ডুবে যায়, তখনও আল্লাহর পক্ষ থেকে গজব নেমে আসে। সমকামিতার জন্য লুত (আ)-এর জাতি এবং ওজনে কারচুপির জন্য শোয়াইব (আ)-এর জাতিকে আল্লাহ সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আবার পরীক্ষা হিসেবেও অতীতকালে অনেক নবী-রসুল, মুহাম্মদ (সা) ও ঈমানদার জনগোষ্ঠীর ওপর নানাবিধ বিপদাপদ দিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা করেছেন। পরীক্ষা গ্রহণ আল্লাহতায়ালার এক স্থায়ী নিয়ম।
বিপদাপদ বা গজব যাই বলি না কেন-এর থেকে উত্তরণের জন্য ত্রিবিধ উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। ইউরোপ-আমেরিকা বা ধর্মনিরপেক্ষ জনগোষ্ঠী কার্যকারণ সম্পর্ক বিবেচনা করে। তাদের গবেষণা ও অভিজ্ঞতা বলে, যে কোনো ধরনের মহামারি (প্লেগ, স্পেনিস ফ্লু বা করোনা) সংক্রামক এবং করোনা যেহেতু বায়ু বা পানিবাহিত ভাইরাস নয়, এটা মানুষের মাধ্যমে ছড়ায় সেহেতু মানুষকে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার মধ্যে এর সমাধান রয়েছে। এজন্য তারা লকডাউন করে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে এবং এর মধ্যেই সমাধান খুঁজছে। আর একটি শ্রেণি যারা বিশ্বাসের বলে বলিয়ান হয়ে বলতে চায়, বিপদাপদ দেয়ার মালিক যিনি তিনিই তা দূর করবেন এবং তারা অনেক সময় বেপরোয়া ভাব দেখায়। তৃতীয় পক্ষ মধ্যমপন্থী, যারা বিপদ-মুসিবত থেকে মুক্তিলাভের সকল উপায়-উপকরণ গ্রহণের সাথে সাথে আল্লাহর উপর নির্ভর করতে চায়।
ইসলাম তৃতীয় মতের অনুসারী। মানুষ মূলত আল্লাহর প্রতিনিধি এবং প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আল্লাহপাক মানুষকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেক দানের সাথে কিতাব ও রসুল দান করেছেন। সকল বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে এবং যেখানে কোনো নির্দেশনা নেই সেখানে বিবেক, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, উদ্ভাবন, আবিষ্কার তাকে সমাধানে সহায়তা করবে। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, ছোঁয়াছে বা সংক্রামক বলে কিছু নেই আবার তিনি নিজেই বলেছেন, তোমরা মহামারি আক্রান্ত এলাকায় যাবে না, আবার আক্রান্ত এলাকা থেকে পালাবে না। এমতাবস্থায় আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভর করবে এবং উপদ্রুত এলাকায় অবস্থানের ফলে যদি তোমাদের মৃত্যু হয়, তা হলে শাহাদতের মর্যাদা লাভ করবে।
হাদিস সব সময় ঘটনাকেন্দ্রিক। বিশেষ কোনো রোগ-ব্যাধির কারণে কাউকে হেয় করা বা তার সেবাশুশ্রুষায় অবহেলা করা যাবে না। এখন আমরা লক্ষ্য করছি মহামারি আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা এবং মৃত ব্যক্তিদের দাফন-কাফনে বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ডাক্তার, নার্স ও সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন। বান্দা তার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের সাথে সাথে আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে এবং তার মধ্যে এই বিশ্বাস কাজ করবে, আল্লাহপাক না চাইলে মহামারিতে তার মৃত্যু হবে না।
করোনা রোগী শনাক্ত করার মতো যথেষ্ট উপায়-উপকরণের স্বল্পতা আমেরিকার মতো দেশেরও রয়েছে। আমাদের থাকা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের এখানে ৪৮ জনের সংখ্যাটি যাদের করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের মাত্র। হয়তো সংখ্যাটি বাড়তে পারে। অতীতে ভাইরাস সংক্রামিত হয়েছে জাহাজ ও ট্রেনের মাধ্যমে, কিন্তু এবারে ছড়িয়েছে প্লেনের মাধ্যমে। ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথম দিকে খুবই সীমিত পরিসরে হলেও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না নেয়া হলে আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। আমেরিকায় লক্ষাধিক লোক আক্রান্ত হয়েছে। এর প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হলো মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। সারা বিশ্বব্যাপী চলছে লকডাউন।
এই রোগটি বায়ু বা পানিবাহিত নয়, মানুষের সংস্পর্শে এই ভাইরাসটি বিস্তার লাভ করে। ফলে কয়টি দিন সবাই মিলে কষ্ট করে ঘরে অবস্থান করলে আমরা এর প্রকোপ থেকে রেহাই পেতে পারি। সন্দেহভাজন সবাইকে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, আবার অনেক সময় কোনো লক্ষণও প্রকাশ পায় না। এক হাজার লোকের মাঝে করোনা আক্রান্ত কেউ না থাকলে তাদের সাথে মেলামেশায় কোনো সমস্যা নেই। আবার বাজারে বা মসজিদে পাঁচ জন লোকের মাঝে একজন করোনা আক্রান্ত থাকলেই বিপদ ঘটতে পারে। অন্ধকার ঘরে সাপ, মনে হয় সারা ঘরেই সাপ। বাংলাদেশ বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আজকের পত্রিকায় দেখলাম যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে চায়। করোনা ভাইরাস কতোদিন চলবে তা কারো জানা নেই। তবে সতর্ক না হলে হয়তো অগণিত মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়বে এবং চিকিৎসা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করবে হাজারে হাজার।
আমরা একটি বিশ্বাসী জাতি। এই বিশ্বাস আমাদেরকে হতাশা ও আতঙ্ক থেকে রক্ষা করতে পারে। তকদিরের প্রতি বিশ্বাস আমাদেরকে সাহসী করে, তকদির আমাদের কাছে অজ্ঞাত এবং সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বনে তকদির কোনো বাধা নয়। কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়াই কোনো কিছু ঘটানো আল্লাহর পক্ষে সম্ভব। নারী-পুরুষের সংস্পর্শে সন্তান জন্ম সাধারণ নিয়ম। পিতা ছাড়াও সন্তান হওয়া সম্ভব, হযরত ইসা (আ) তার উদাহরণ। বিপদাপদ আসে আমাদের জন্য শাস্তি নয়তো পরীক্ষা হিসেবে। জাতি হিসেবে আমরা জুলুম-নির্যাতন, ঘুষ-দুর্নীতি, অশ্লীলতায় মেতে উঠেছি। এখন প্রয়োজন, সকল পাপাচার থেকে তাওবা করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নেয়া। আল্লাহর কাছে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা এবং তাঁর বান্দাদের সাথে সদাচরণ আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে। এখন প্রয়োজন জাতিগতভাবে তাওবা করা।
বান্দাহ হিসেবে সতর্ককতা ও সাবধানতা অবলম্বনের পাশাপাশি আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও তাঁর দিকে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে আমরা এই বিপদ থেকে রেহাই পেতে পারি। মু’মিনদের জন্য আল্লাহর আশ্বাসবাণী- ‘তোমরা দশ জন একশ জনের ওপর বিজয়ী হবে’। আমরা বিশ্বাসের বদৌলতে ইউরোপ-আমেরিকার যে পরিমাণ উপায়-উপকরণ রয়েছে তার ১০% ব্যবহার করে এই বিপদ থেকে রেহাই পেতে পারি। তবে অবশ্যই আল্লাহর দেয়া নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। এখানে আল্লাহর নিয়ম বলতে বান্দার করণীয় বুঝিয়েছি। অর্থাৎ ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরে অবস্থান করা। আল্লাহপাক আমাদেরকে এই মহামারি থেকে হেফাজত করুন। ২৮.০৩.২০২০
Comments
Post a Comment