Skip to main content

দরসুল কুরআন

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

আর তার (নূহের) অনুগামীদেরই একজন ছিল ইবরাহিম। সে তার প্রভুর সামনে উপস্থিত হয়েছিল প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে। সে তার পিতা ও কওমকে বলেছিল, ‘আপনারা কিসের ইবাদত (উপাসনা) করছেন? আপনারা কি আল্লাহর পরিবর্তে মনগড়া ইলাহদের চান? রব্বুল আলামিনের (বিশ্বজগতের প্রভু) ব্যাপারে আপনাদের ধারণা কী?’ অতঃপর সে একবার তারকারাজির দিকে তাকালো এবং বললে, ‘আমি অসুস্থ।’ তখন তারা তাকে ফেলে চলে গেল। অতঃপর সে সতর্কভাবে তাদের ইলাহগুলোর (দেবতা) কাছে গেল। তাদের বললো, ‘তোমরা কি খাবে না?’ ‘তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা কথা বলো না কেন? তারপর সে তাদের আঘাত হানলো শক্তভাবে। তখন লোকেরা ছুটে আসলো তার দিকে। সে বললো, ‘তোমরা নিজেরা যেগুলোকে খোদাই করে তৈয়ার করো, তোমরা কি সেগুলোরই পূজা করো?’ অথচ তোমাদের তো সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ এবং তোমরা যা তৈরি করো সেগুলোকেও।’ তারা পরস্পর বললো, এর জন্য একটি অগ্নিকুÐ তৈরি করো এবং একে জ¦লন্ত আগুনের মধ্যে ফেলে দাও।’ তখন তারা তার বিরুদ্ধে এক চরম চক্রান্ত করে, কিন্তু আমরা তাদের নিচু করে দিয়েছি। সে বলেছিল, ‘আমি আমার প্রভুর দিকে চললাম, তিনি আমাকে সঠিক পথ দেখাবেন। হে আমার প্রভু! আমাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দান করো।’ (দোয়ার জবাবে) আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলাম। যখন সে তার পিতার সাথে কাজ করার বয়সে উপনীত হয় তখন সে (ইব্রাহিম) বলেছিল, ‘হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্ন দেখেছি, তোমাকে জবেহ করছি। এখন তুমি বলো, ‘এ বিষয়ে তোমার অভিমত কী?’ সে বলেছিল, ‘আব্বু! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আপনি তাই করুন। ইনশা-আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবেই পাবেন।’ যখন তারা দুজনই আত্মসমর্পণ করলো এবং ইব্রাহিম তার পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল, তখন আমরা তাকে ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি অবশ্যই স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। অতঃপর আমরা তাকে মুক্ত করেছিলাম একটি বড়ো কুরবানির বিনিময়ে। আর আমরা পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম। সালাম (শান্তি বর্ষিত হোক) ইবরাহিমের প্রতি। সৎকর্মকারীদের আমি এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চিতভাবে সে ছিল আমার বিশ্বাসী বান্দাদের একজন। সুরা সাফ্ফাত ৮৩-১১১।

নামকরণ : সুরার প্রথম আয়াতের সাফ্ফাত শব্দকেই চিহ্নস্বরূপ নামকরণ করা হয়েছে। অর্থ কাতারবন্দি।

নাজিল হওয়ার সময়কাল :  এই সুরাটি মক্কিযুগের মাঝামাঝি বা এর একটু পরে নাজিল হয়েছিল। রসুলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাথিদের ওপর প্রচণ্ড বিরোধীতা চলছিল। মুমিনদের মাঝে এক হতাশাজনক অবস্থা বিরাজ করছিল। রসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে স্বল্পসংখ্যক সাথি ছিলেন এবং অধিকাংশই আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন।

বিষয়বস্তু ও বক্তব্য বিষয় : রসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক তাওহিদ ও আখেরাতের প্রতি দাওয়াতের জবাবে কাফিরদের আচরণ ছিল অত্যন্ত ঘৃণ্য ও নিন্দনীয়। হাসি-তামাশা ও ঠাট্টা-বিদ্রুপতো ছিলই এবং সেইসাথে দুর্বল ঈমানদারদের প্রতি ছিল নানাবিধ অত্যাচার-নির্যাতন। মক্কাভূমিতে টিকতে না পারে অনেকেই আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য হন। আল্লাহপাক তাদেরকে সতর্ক করেছেন এবং বলেছেন, শীঘ্রই আল্লাহর সেনাদল (মুমিনগণ) তোমাদের আঙিনায় পৌঁছে যাবেন। ১৭১-১৭৯ আয়াতে যখন ভবিষ্যৎবাণী করা হয় তখন মুসলমানরা বিজয়ী হবে তার কোনো সম্ভাবনা দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না। সেসময়ে হিজরত করার পর রসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে মাত্র ৪০-৫০ জন ছিলেন। কিন্তু ১৫-১৬ বছরের মধ্যে মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালার ভবিষ্যৎবাণী কার্যকর হয়।

কাফিরদের সতর্ক করার পাশাপাশি কয়েকজন নবির নাম উল্লেখ করে তাঁদের সাথে কাফিরদের আচরণ তুলে ধরে পরম ধৈর্যধারণের উপদেশ প্রদানের সাথে সাথে সুসংবাদও শোনানো হয়েছে। বিশেষ করে ইবরাহিম আ.-এর সাথে তাঁর জাতির ঘৃণ্য আচরণ এবং নমরুদ কর্তৃক আগুনে নিক্ষেপের পরও দীনের ওপর অবিচল থাকার কথা এখানে পেশ করা হয়েছে।

ব্যাখ্যা : 

(৮৩-৯৮) আদম আ. থেকে শুরু করে সকল নবি-রসুল ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম (অনুগত)। আদম আ. থেকে নুহ আ.-এর পূর্ব পর্যন্ত একটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। আল্লাহর নাফরমানির চরম পর্যায়ে আল্লাহপাক হজরত নুহ আ.-কে নবি হিসেবে প্রেরণ করেন এবং সাড়ে নয়শো বছর ধরে দাওয়াত দানের ফলে খুব স্বল্প সংখ্যক লোকই ঈমান এনেছিল। এই স্বল্প সংখ্যক লোককে টিকিয়ে রেখে আল্লাহপাক নুহ আ.-এর কওমকে ধ্বংস করে দেন। হজরত ইব্রাহিম আ. ছিলেন সেই নুহ আ.-এরই অনুসারী। প্রশান্ত অন্তর নিয়ে রবের সামনে হাজির হওয়া অর্থ সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে একান্তভাবে আল্লাহর দিকে রজ্জু হওয়া। বিশ্বাস ও নৈতিক সবধরণের ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত হয়ে একান্ত আল্লাহর সান্নিধে পৌঁছে যাওয়া। শিরক ও কুফর এবং মানবচরিত্রে যেসব অনৈতিক দোষ-ত্রুটি থাকে হজরত ইব্রাহিম আ. ছিলেন সবকিছু থেকে মুক্ত। কালবে সালীম বলতে এমনটিই বোঝানো হয়েছে। এই সুরায় অনেক নবির কথা উল্লেখ রয়েছে। হজরত ইবরাহিম আ. ছাড়াও তাঁর ভাইপো লুত আ. এবং দুই ভাই মুসা ও হারুন আ.সহ ইউনুস আ. ও ইলিয়াস আ.-এর উল্লেখ রয়েছে। সকল নবির কাজ ছিল মানুষকে সত্যের দিকে ডাকা।

হজরত ইব্রাহিম আ.-এর সময়টায় তাঁর জাতির লোকেরা চরমভাবে শিরকে নিমজ্জিত ছিল। আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নানা দেবদেবির পূজা করতো। বর্তমান ইরাকে ইব্রাহিম আ.-এর জন্ম এবং নমরুদ ছিল সেই দেশের শাসক। নমরুদ নিজেকে নাম্মার (চন্দ্র) দেবতার প্রতিনিধি মনে করতো। ইবরাহিম আ.-এর পিতা নিজেও মূর্তিপূজায় নিমজ্জিত এবং সে ছিল নমরুদের প্রধান পুরোহিত। ইব্রাহিম আ. তাঁর জাতিকে তাওহিদের দাওয়াত প্রদান করেছেন এই বলে যে, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমাদের হাতেগড়া মিথ্যা মাবুদদের পূজা করছো? মহান আল্লাহ সম্পর্কেই বা তোমাদের ধারণা কী?

মূর্তিগুলোর অসারতা প্রমাণ করার জন্য ইব্রাহিম আ. সুযোগ খুঁজছিলেন। মনে হচ্ছে কোনো এক মেলা বা সমাবেশে সবাই একত্রিত হবে এবং ইব্রাহিম আ.-কে তারা সেখানে যাওয়ার জন্য আহবান জানায়। ইব্রাহিম আ. তারকার দিকে বা আকাশের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নিজেকে অসুস্থ দাবি করে তাদের সাথে যেতে অস্বীকার করে। সবাই চলে যাওয়ার পর তিনি মন্দিরে প্রবেশ করে লক্ষ করেন, মূর্তির সম্মুখে অনেক খাদ্যখানা। ইব্রাহিম আ. মূর্তিগুলোকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনাদের হয়েছে কি, খাদ্যখানা খান না কেন? আপনারা তো কথাও বলছেন না? এসব বলার পর প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানেন। বড়ো মূর্তিটাকে রেখে সবগুলো ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে ফেলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে খাদ্যখানা নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ায় বড়ো দেবতারই এসব কাজ। আসলে মাটির তৈরি এসব ভাস্কর্যের কোনো ক্ষমতা নেই, কথাও বলতে পারে না। পূজারিরা ভালো করেই জানে যে এসব ভাস্কর্য ক্ষমতাহীন, তারা তাদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেশ করে কেবল এ কারণেই যে, তাদের বাপদাদারা এসবের পূজা করেছে।

লোকজন মেলা থেকে ফিরে এসে মন্দিরে ঢুকে দেবতাদের এই করুণ পরিণতি দেখে তাদের মনে সন্দেহ জাগে যে, ইবরাহিম নামে এক যুবক তাদের দেবতাদের মন্দ বলে থাকে এবং এই কাজ ইবরাহিমই করেছে। তারা ইবরাহিম আ.-এর কাছে উপস্থিত হলে তিনি তাদেরকে মূর্তির অসারতা তুলে ধরে বলেন, আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যার পূজা করো অর্থাৎ এই কাঠ-খড়ি-মাটি তাও আল্লাহরই সৃষ্টি। বিষয়টি শাসক নমরুদকে অবহিত করা হলে ইবরাহিম আ.-কে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। মূর্তিপূজার পৃষ্ঠপোষক স্বয়ং রাষ্ট্রশক্তি এবং ইব্রাহিম আ.-এর মূর্তিভাঙ্গা রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিবেচিত হয়; ফলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড তাঁর জন্য নির্ধারিত হয়। এমন অপরাধ যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ করার দুঃসাহস দেখাতে না পারে সেজন্য তারা অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে এবং সেই আগুনে ইবরাহিম আ.-কে নিক্ষেপ করে। আল্লাহপাক তাঁকে রক্ষা করেন এবং বলেন বলেন, ‘হে আগুন! শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও ইবরাহিমের প্রতি’- সুরা আম্বিয়ায় ৬৯। আল্লাহ তায়ালা তাদের সকল চক্রান্ত ধ্বংস করে দেন। এতে তারা অপদস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু তাতেও তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ার ফলে হজরত ইবরাহিম আ.-এর শ্রেষ্ঠত্ব জাতির কাছে প্রমাণিত হয়ে পড়ে। কিন্তু নমরুদ ও তার দলবলের ভয়ে ইবরাহিম আ.-এর প্রতি ঈমান আনা জাতির লোকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। 

(৯৯) ইবরাহিম আ.-এর জাতি যখন ঈমান আনতে ব্যর্থ হলো তখন তিনি দাওয়াতের মিশন নিয়ে অজানা উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। কোথায় যাবেন, কী খাবেন- এসব চিন্তা নবি-রসুলদের জীবনে থাকে না, তাঁরা মূলত আল্লাহর নির্দেশিত পথেই চলেন। তিনি বলেন, আমি আমার রবের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি, তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন। এক স্ত্রী (হাজেরা আ.) এবং এক ভাইপো (লুত আ.)-কে সাথে নিয়ে তিনি দেশ ত্যাগ করেন। তখনো তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর অবর্তমানে তাঁর মিশন অব্যাহত রাখার জন্য তিনি আল্লাহর কাছে এক সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান কামনা করেন। সন্তান চাওয়ার সাথে সাথেই তাঁকে সন্তান দান করেছেন, এমনটি মনে করার কারণ নেই। ইবরাহিম আ.-এর ঘটনা কুরআন মজিদের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে। এখানে এরপরই কুরবানি প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। 

প্রসঙ্গক্রমে একটু বলে রাখি, হজরত ইব্রাহিম আ.-এর জীবনে পরীক্ষার পর পরীক্ষা; জালেম শাসকের পক্ষ থেকে পরীক্ষার পর স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকেও নানাবিধ পরীক্ষা। পরীক্ষার পেছনে আল্লাহপাকের হেকমত রয়েছে। পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহপাক তাঁর বান্দার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন এবং একপর্যায়ে তাঁকে মুসলিম জাতির পিতা ও নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করেন। পরীক্ষার মধ্যে সন্তান জন্মের পর নবজাত সন্তান ও তার মাকে সামান্য খাদ্যখাবারসহ মক্কার মরুপ্রান্তরে এক নির্জন জায়গায় রেখে আসেন। চলে যাওয়ার সময় ভীতসন্ত্রস্ত মা হাজেরা আ. জিজ্ঞেস করেন, এটি কি আল্লাহর হুকুম? জবাবে বলেন, হ্যাঁ। তখন তিনি জবাবে বলেন, আমি আল্লাহরই উপর নির্ভর করছি, তিনিই আমার জন্য যথেষ্ট। একসময় পানি শেষ হয়ে যায়, পানির জন্য সাফা ও মারওয়া দৌড়াদৌড়ি করেন, জমজমের উদ্ভব, সেখানে জনবসতি গড়ে উঠা সে এক ইতিহাস। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বান্দার ত্যাগ ও কুরবানি তাঁর খুবই পছন্দ। তাই হজের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ইবরাহিম আ.-এর পরিবারের স্মরণ আল্লাহ তায়ালা জারি করে দিয়েছেন। মানুষ যদি জমজম কূপ নিয়ে একটু চিন্তা করে তাহলে হেদায়াতের জন্য সেটিই যথেষ্ট হতে পারে। হজের মওসুমে একটি কুপের পানি লক্ষ লক্ষ মানুষ পান করে এবং সবাই নিজ নিজ বাড়িতে বহন করে আনে। কিন্তু সেই পানি আর শেষ হয় না। সবই আল্লাহর কুদরত।

(১০২-১১১) হজরত ইবরাহিম আ.-এর উপর উপর্যুপরি পরীক্ষা। মূর্তি ভাঙ্গার অপরাধে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়া। আগুনের কাজ জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেওয়া এবং ইবরাহিম আ. জানতেন তাঁর পরিণতি কী হবে? উনি কখনই নমরুদের কাছে ভুল স্বীকার বা ক্ষমাপ্রার্থনা করেননি। তিনি ভালো করেই জানেন যে আল্লাহর পথে মৃত্যু বান্দার জন্য সৌভাগ্যেরই ব্যাপার। এরপর তিনি মাতৃভূমির মায়া, আত্মীয় -পরিজন সবকিছু ছেড়ে দেশত্যাগ করেন এবং আল্লাহর নির্দেশক্রমে নবজাত সন্তান ও স্ত্রীকে মরুভূমির নির্জন স্থানে রেখে আসেন। বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায় ছিল সেই এলাকাটিকে আবাদ করা। হজরত ইব্রাহিম আ.-এর জীবনে সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা ছিল পিতা হয়ে কলিজার টুকরো ছেলেকে জবেহ করা। ছেলে ইসমাইল আ. যখন কাজকর্ম করার বয়সে উপনীত হন সেসময়ে তিনি ডেকে বলেন, ‘হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখলাম, তোমাকে জবেহ করছি, এখন তুমি বলো, তোমার মত কী?’ জবাবে ছেলে বলেন, ‘আব্বাজান! আপনি তাই করুন যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন। ইনশা-আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন পাবেন।’ আমিই একমাত্র ধৈর্যশীল এমনটি নয়, আমাকে তোমার ধৈর্যশীল বান্দাদের একজন পাবে। এর মধ্যে রয়েছে বিনয়। পিতাপুত্র বুঝেছিলেন, এ স্বপ্ন স্রেফ স্বপ্ন নয় এটি আল্লাহর নির্দেশ। তাই তিনি বিলম্ব না করে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দানের জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়লেন। কোনো ওজর-আপত্তি নয় বা কোনো অনুরোধও নয়, জীবনে তো অনেক পরীক্ষা দিলাম এই শেষ বয়সে পাওয়া একমাত্র ছেলেকে নিজ হাতে কুরবানি দেওয়া থেকে তুমি অব্যাহতি দাও। না, তিনি তা করেননি। তিনি জানেন, একজন মুসলিমের কথা হলো, শুনলাম ও মেনে নিলাম। 

পিতাপুত্র যখন রাজি হয়ে গেলেন অর্থাৎ পিতা ছেলেকে জবেহ করতে এবং ছেলে জবেহ হতে রাজি হলেন তখন ইব্রাহিম আ. পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন তখন আল্লাহপাক আওয়াজ দিয়ে বললেন, হে ইব্রাহিম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়ে দিয়েছো।’ আসলে আল্লাহপাক ইব্রাহিমকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন যে, তিনি তাঁর ছেলেকে জবেহ করছেন। জবেহ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। এই কাজে শয়তান নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে বারবার ব্যর্থ হয়েছে এবং ইবরাহিম আ. হাজেরা আ. ও ইসমাইল আ. থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তাঁরা শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরে শয়তানের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ হজের আনুষ্ঠানিকতার একটি অংশ। আল্লাহর প্রতি ইব্রাহিম আ.-এর নিঃশর্ত আনুগত্যে আল্লাহপাক দারুণভাবে খুশি হন এবং আল্লাহ বলেছেন, আমি সৎকর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি।

আল্লাহপাক নিজ থেকেই বলেছেন, এটা ছিল এক বড়ো ধরনের পরীক্ষা এবং তিনি সন্তুষ্ট হয়ে এক মহান কুরবানির বিনিময়ে শিশু পুত্রকে ছাড়িয়ে নেন। কিয়ামত পর্যন্ত স্মরণ হিসেবে তিনি পশু কুরবানিকে জারি করে দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম কুরবানি সম্পর্কে জানতে চাইলে রসুলুল্লাহ সা. বলেন, তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ.-এর সুন্নাত। কুরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। কুরবানির ফজিলত প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. নানাভাবে উল্লেখ করেছেন। এই কাজের বিনিময়ে আল্লাহপাক তাঁর খলিলের প্রতি শান্তি (সালাম) বর্ষণ করেছেন। তিনি তাঁকে সৎকর্মশীল ও মুমিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করে পুরস্কৃত করার কথা উল্লেখ করেছেন।

শিক্ষা : সুরা সাফ্ফাত ৮৩-১১১ পুরোটাই হজরত ইব্রাহিম আ. প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। হজরত ইব্রাহিম আ.-এর দাওয়াত ও রসুলুল্লাহ সা.-এর দাওয়াত অভিন্ন ছিল। ইবরাহিম আ. মুশরিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। শিরকের বিরোধীতার কারণে ইবরাহিম আ.-এর পিতা ও স্বজাতি তাঁর প্রচÐ বিরোধীতা করেছে এবং একপর্যায়ে হত্যা করতে উদ্যেত হয়েছিল। মুহাম্মদ সা.-এর জাতিও নানাবিধ শিরকে নিমজ্জিত ছিল এবং খোদ কাবাঘরেই নানা দেবদেবির মূর্তি রেখে তাদের পূজা-অর্চনা করতো। বর্তমানেও ভাস্কর্যের প্রতি প্রীতি একশ্রেণির মানুষের মধ্যে অত্যন্ত প্রবল। এছাড়াও কবরপূজা ও ব্যক্তিপূজা তো রয়েছেই। ইসলামের মৌলিক বিষয় তাওহিদ এবং কুরআন মজিদ খুললে যে শব্দটি প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় সেটি হলো ‘আলহামদু লিল্লাহ’। ব্যক্তিপূজা, সৃষ্টিপূজা সবধরনের বন্দনা বা পূজা উপেক্ষা করে কেবল আল্লাহরই বন্দনা, প্রশংসা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। 

যেসময়ে এই সুরাটি নাজিল হয় সেসময়ে মুসলমানরা এক হতাশাজনক অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছিলেন। অধিকাংশই হিজরত করার পরে স্বল্পসংখ্যক মক্কায় অবস্থান করছিলেন। মক্কাবাসীর কাছে হজরত ইবরাহিম আ. হজরত ইসমাইল আ. ও হজরত হাজেরা আ. অত্যন্ত সুপরিচিত। তারা কাবা তাওয়াফ করতো, সায়ী করতো, কুরবানি করতো। আল্লাহ তায়ালা সেই ঘটনা উপস্থাপন করে মুমিনদের সাহস-হিম্মত বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা কেবল দুনিয়ার জীবনে কল্যাণ লাভ নয় বরং আখেরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ ও আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনই মুখ্য উদ্দেশ্য। হজরত ইব্রাহিম আ. ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগ যুগে যুগে ঈমানদার জনগোষ্ঠীকে প্রেরণা যোগাবে। কুরবানি গোশত খাওয়ার উৎসব নয় বরং একজন মুমিন কুরবানিদাতা এ ঘোষণাই দান করে যে, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান এবং আমার জীবন ও মরণ কেবল আল্লাহরই জন্য। কতবড় স্পষ্ট ঘোষণা যে, আমি কেবল আল্লাহরই জন্য, আমার বেঁচে থাকা আল্লাহরই জন্য আবার মৃত্যুও আল্লাহরই জন্য। আল্লাহপাক উম্মাহর মাঝে ইব্রাহিমই চেতনা জাগ্রত করুন এবং দীনের জন্য সবকিছু উজাড় করে দেওয়ার মতো মনোবাসনা তৈরি করে দিন। আমিন। ০৮.০৬.২০২৩

Comments