Skip to main content

যেখানে আল্লাহকে পাওয়া যায়

 নিজের ও স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য আমি ২/৩ দিন হাসপাতালে যাতায়াত করেছি। নিজের জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং স্ত্রীর জন্য icddr,b (কলেরা হাসপাতাল) মহাখালী। চিকিৎসা সেবায় স্বস্তি পাওয়ায় উভয় প্রতিষ্ঠান এবং সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার-নার্স ও অন্যান্যদের সম্পর্কে ফেসবুকে ইতিবাচক পোস্ট দিয়েছি। আমি আমার পোস্টের নিচে উল্লেখ করেছিলাম ‘যেখানে গেলে আল্লাহকে পাওয়া যায়’ শীর্ষনামে একটি পোস্ট দিব। হ্যাঁ, আজ সেটা নিয়েই লিখছি। 

আল্লাহকে পাওয়ার প্রশ্নে অনেকেই বলবেন, আল্লাহকে পাওয়ার সহজ উপায় হলো আজমীর শরিফ, শাহজালাল রহ.-এর মাজার, বায়েজিদ বোস্তামী রহ.-এর মাজার বা খান জাহান আলী রহ.-এর মাজারে গেলে আল্লাহকে পাওয়া যায়। নানাজন নানা কামনা-বাসনা নিয়ে সেসব জায়গায় গিয়ে থাকেন। অনেক রাজনীতিবিদকে দেখা যায়, সিলেটে শাহজালালের রহ. দরগা জিয়ারতের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। এসব জায়গায় জিয়ারত বা ধর্ণা দেওয়ায় কোনো কল্যাণ নেই, বরং রয়েছে কবিরা গুনাহ। আল্লাহকে পাওয়ার জন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই বা কাউকে ধরারও দরকার নেই। 

আল্লাহ বান্দার অতি নিকটে। তাঁর নিজের উক্তি, ‘হে নবি! আমার বান্দা যখন আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তখন বলে দাও, আমি তাদের অতি নিকটে। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই আমার আহবানে সাড়া দেওয়া ও আমার ওপর ঈমান আনা তাদের একান্ত কর্তব্য। এ কথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো তারা সত্য-সরল পথ পথের সন্ধান পাবে’- সুরা বাকারা ১৮৬। দ্ব্যর্থহীন কথা, আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। সকল প্রয়োজন তাঁরই কাছে পেশ করতে হবে। তিনি বান্দার ডাক কেবল শুনেনই না, তার জবাবও দেন অর্থাৎ সমাধান দেন। আল্লাহরও চাওয়া আছে এবং তা হলো বান্দা কেবল তাঁরই আনুগত্য (ইবাদত) করবে। আল্লাহপাক তাঁর রসুল সা.-কে বলে দিয়েছেন, তাঁর এ কথা প্রচার করে দিতে যাতে তারা শিরক থেকে মুক্ত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে সঠিক পথের সন্ধান পায়।

আল্লাহকে পাওয়ার সহজতম উপায় হলো তাঁর বান্দাদের সাথে সদাচরণ করা। মনে রাখতে হবে মানুষ শুধু আল্লাহর বান্দা নয়, সাথে সাথে তাঁর প্রতিনিধিও। আমরা প্রতিনিধির মর্যাদা বুঝি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই সরকারের প্রতিনিধি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজেকর্মে বাধা প্রদান সরকারের বিরোধীতা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। পুলিশ প্রায়ই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে থাকে। হাসপাতালে মানুষের অসহায়ত্ব লক্ষ করলাম। এই মানুষগুলো যদি যথাযথ সেবা পায় তাহলে প্রতিনিধির মাধ্যমে মূলত আল্লাহকেই সেবা দান করা হয়। আমরা স্কুলজীবনে পড়েছি, হাশরের দিনে বিচারে বসিয়া সুধাবে জগতস্বামী, তুমি মোরে করো নাই সেবা যবে রুগ্ন যে ছিলাম আমি। বেশ বড়ো কবিতা, আরো ছিল- ক্ষুধার্ত ছিলাম খাদ্য দাওনি, পিপাসার্ত ছিলাম পানি পান করাওনি। আসলে কবিতা নয়, হাদিসের বাণী। মানুষ বলবে, হে বিশ্বজাহানের মালিক এটি কেমন করে সম্ভব? আল্লাহ বলবেন, আমার বান্দা অসুস্থ ছিল, ক্ষুধার্ত ছিল, পিপাসার্ত ছিল তার প্রয়োজন পূরণ করলে আজ আমাকে পেতে। কত আবেগভরা কথা। যারা মানুষের প্রয়োজন পূরণ করে ও তাদের সাথে সদাচরণ করে তারা আল্লাহপাকের যথার্থ প্রতিনিধি। সাধারণত আল্লাহ তায়ালা  তাদেরকেই সমাজের নেতৃত্ব দান করেন।

শুধু হাসপাতাল নয় সকল সরকারি অফিসে যারা সেবা গ্রহণের জন্য যায় তারা সবাই আল্লাহর প্রতিনিধি। আবার যারা সেবা প্রদান করে তারাও আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এই দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিয়ে মর্যাদার অধিকারী করেছেন। আল্লাহ তায়ালা আল-মালেক (শাসক), আল-হাকিম (বিচারক) এবং মানুষ তাঁর প্রতিনিধি (আব্দুল মালেক, আব্দুল হাকিম) হয়ে সমাজে সুশাসন ও ন্যায়বিচার কায়েম করবে। যারা শাসক এবং শাসকের পক্ষে সমাজে ন্যায়বিচার ও সুশাসন কায়েম করে কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ার নিচে স্থানপ্রাপ্তদের তালিকায় তারা থাকবে এক নম্বরে।

সরকারি দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে রসুলুল্লাহ সা.-এর কঠোর হুশিয়ারী রয়েছে। তাঁর বাণী, ‘আমরা যাদেরকে দায়িত্ব প্রদান করি তারা যদি এক টুকরো সূতা বা তার চেয়ে ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে তাহলে সে খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে কিয়ামতের দিন উত্থিত হবে।’ সরকারি অফিস-আদালতে বা সরকারি কার্যক্রমে সীমাহীন দুর্নীতি হয়। একজন অর্থমন্ত্রীর উক্তি, পুকুর চুরি নয় সাগর চুরি হয়। কিয়ামতের দিন দেখা যাবে কারো মাথায় পর্দা ও বালিশ, কারো মাথায় কম্পিউটার আবার কারো মাথায় পদ্মাসেতু। অর্থাৎ যারাই চুরি বা খেয়ানত করে সেদিন তারাই ধরা খাবে। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আমরা যখন কাউকে কোনো দায়িত্ব প্রদান করি সে তার নিজের কাজ যতো নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করে আমাদের অর্পিত দায়িত্ব যদি সেভাবে পালন না করে তাহলে তাদেরকে উল্টা করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ ঘুষ দাবি করার প্রশ্নই উঠে না, কোনো কাজ যদি দশ মিনিটে সম্ভব হয় সেই কাজে আধাঘন্টা লাগানোও জুলুম এবং দায়িত্বহীনতার কারণে তাকে জবাবদিহি করতে হবে।

সদাচরণ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন। মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা তাদেরকে কষ্ট দেওয়া কতবড় গুনাহ মুসলমান যদি উপলব্ধি করতো তাহলে দেশ থেকে জুলুম চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত। আল্লাহর বাণী, ‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনাসামনি গালাগাল করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে’ (সুরা হুমাজা)। এদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে যে, তাদেরকে হুতামায় নিক্ষেপ করা হবে। আর হুতামার পরিচয় দেওয়া হয়েছে, আল্লাহর আগুন প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত-উৎক্ষিপ্ত। একটু গালি দিলে ও অসাক্ষাতে নিন্দাবাদ করলে যদি এই পরিণতি হয় তাহলে যারা গুম-খুন ও মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে মানুষকে জেল-জুলুম ও নানাভাবে কষ্ট দেয় তাদের পরিণতি কী হবে? 

আল্লাহর দয়া অনুগ্রহের শেষ নেই, তিনি অপেক্ষা করেন তাঁর বান্দারা ফিরে আসে কি না? ঈমানদার বান্দাদের কষ্ট দেওয়া আল্লাহর কাছে অসহনীয়। আল্লাহর বাণী, ‘যারা ঈমানদার নর ও নারীকে কষ্ট দেয়, অতঃপর তওবা করে না তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি’ (সুরা বুরুজ)। ‘অতঃপর তওবা করে না’- এই উক্তির মধ্যে একজন জালেম আল্লাহর ক্ষমা আশা করতেই পারে যদি সে যথার্থ ফিরে আসে। আল্লাহপাক জালেমের পক্ষ থেকে মজলুমকে এত পরিমাণ দেবেন যা পেয়ে মজলুম জালেমকে ক্ষমা করে দেবে।

মুসলিম কর্তৃক কেউ কষ্ট পাবে সেটি অকল্পনীয়। বরং মানবজাতির কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যেই মুসলিম জাতির উদ্ভব হয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা সর্বোত্তম জাতি, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের বের করে আনা হয়েছে, তোমরা দুনিয়ার মানুষদের সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা রাখবে’ - সুরা আলে ইমরান ১১০। এতে বোঝা যায়, আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের মূলে রয়েছে মানুষের কল্যাণ সাধন এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার মধ্যে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা তাদের পক্ষেই সম্ভব যারা নেতৃত্বের আসনে থাকে। এই আয়াতের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়, আল্লাহ তায়ালা তাঁর সর্বোত্তম বান্দাদের (মুসলিম) বিশ্বনেতৃত্বের আসনে দেখতে চান।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব আসে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আল্লাহ সকল নবি-রসুলকে সমসাময়িক রাজশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। কালিমা তাইয়্যেবাহ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এক বিপ্লবাত্মক স্লোগান। সকল নবি-রসুল একই কালেমার দাওয়াত দিয়েছেন। কালিমার দাবি হলো, আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো (আনিই বুদুল্লাহ ওয়াজতানিবুত তাগুত)। তাগুতকে অস্বীকার মানে জিহাদে জড়িয়ে পড়া। সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী নবি-রসুলদের কোনো তাগুতই সহ্য করেনি। নমরুদ সহ্য করেনি ইবরাহিম আ.-কে, ফেরাউন সহ্য করেনি মুসা আ.-কে, আর মুহাম্মদ সা.-কে সহ্য করেনি আবু জেহেল ও আবু লাহাবরা। দুনিয়ার ইতিহাস হলো হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব- সংগ্রামের ইতিহাস। আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘আর জিহাদ করো আল্লাহর পথে হক আদায় করে। তিনি (দুনিয়ার নেতৃত্বের জন্য) তোমাদের মনোনীত করেছেন এবং দীনের ব্যাপারে কোনো সংকীর্ণতা রাখেননি’- সুরা হজ ৭৮। কুরআনে অসংখ্য জায়গায় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে হক আদায় করে অর্থাৎ নিজের জান ও মালকে উজাড় করে দিয়ে জিহাদ করো। আবার ফি সাবিলিল্লাহ না বলে বলা হয়েছে ফিল্লাহ। অর্থাৎ নিজেকে পরিপূর্ণ আল্লাহতে সমর্পণ করে। 

রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, নামাজ হলো দীনের ভিত্তি আর জিহাদ হলো তার চূড়া। মানুষ একটি ঘরের ভিত্তি গাড়ে সেখানে একটি ছাদ করার লক্ষে। ঘরের ভিত্তি যতই মজবুত হোক ছাদ ছাড়া সেই ঘর থেকে কোনো সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ রৌদ্র- বৃষ্টি-ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। ইসলামি রাষ্ট্র (খেলাফত) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল সম্ভব জনকল্যাণ সাধন। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে মারা গেল অথচ না জিহাদ করলো আর না জিহাদের বাসনা পোষণ করলো, তার মৃত্যু হলো মুনাফিকের মৃত্যু।

সমাজে মান-ইজ্জত-সম্মান সবই রাজনৈতিক নেতৃত্বের কব্জায়। আল্লাহ মুসলমানদের সর্বোত্তম জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সর্বোত্তম জাতি হওয়া তখনই সম্ভব যখন তাদের হাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব থাকে এবং মানুষ সেখান থেকে কেবল কল্যাণটাই লাভ করে ও সমাজ থেকে সকল পাপাচার দূর হয়ে যায়। মুসলমান আল্লাহর বাছাইকৃত বা মনোনীত বান্দা। আল্লাহ তায়ালা সমাজের নেতৃত্ব (খেলাফত) তাঁর এই মনোনীত বান্দাদের হাতে দিতে চান সেখানে শর্ত হলো ঈমানের দাবিতে সত্যবাদি হতে হবে ও নেক আমলে ভূষিত হতে হবে (সুরা নূর ৫৫)। এখানে নেক আমল অর্থাৎ নফল ইবাদত-বন্দেগিতে কেবল পারদর্শী হওয়া নয় বরং সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা, প্রতিশ্রুতি পালন, মানুষের  প্রতি সদাচরণ। এগুলো হলো মৌলিক মানবীয় গুণা। এসব মানবীয় গুণাবলী কোনো একটি জাতিগোষ্ঠী অর্জন করতে পারলে তাদের রোখার সাধ্য কারো থাকে না। আল্লাহপাক বলেছেন, তাঁর দীনের মধ্যে কোনো সংকীর্ণতা নেই। দুর্ভাগ্য, আজ আমরা আমাদের উদার ও প্রশস্ত দীনকে সংকীর্ণ করে পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষে মেতে উঠেছি ও নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছি। আল্লাহপাক আমাদেরকে সঠিক উপলব্ধি দান করুন। ১৩.০৬.২০২৩।

Comments