জুমা আলোচনা
গাছিয়া দৌলতপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ
তারিখ : ১৮.০৮.২০২৩
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
এই গ্রামেই আমার আদিবাস। আপনাদের মধ্যে যারা বয়স্ক, সবার সাথে আমার জানাশোনা রয়েছে। দীর্ঘদিন পর কয়েকটি জুমা পড়ার সৌভাগ্য আমার হলো। পূর্বের এক জুমায় দাদাডাকা একজনকে পেয়েছিলাম, আজকে তাঁকে দেখছি না। প্রায় ৫০ বছর পর অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনটা জুমা আদায় হলো। আমাদের এই মসজিদটি অত্যন্ত প্রাচীন এবং কতো প্রাচীন আমরা তা জানি না। তবে এতটুকু মনে আছে, আমার আব্বার (তিনি ছিলেন মসজিদের সেক্রেটারি ও ইমাম) নেতৃত্বে গ্রামবাসী সবাই মিলে ষাটের দশকে টিনের ঘর ভেঙ্গে পাকা মসজিদ তৈরি করেছিলেন এবং ৫০ বছর পরে আপনারা সবাই মিলে সেটি ভেঙ্গে এক দৃষ্টিনন্দন মসজিদ তৈরি করেছেন। মসজিদের সামনে বাগান ও অভ্যন্তরে টাইলস এবং অজুখান ও প্রস্রাব-পায়খানা সবই সুন্দরভাবে হয়েছে। আরো ৫/৬ টা মসজিদ গ্রামে হলেও এটিই সবচেয়ে প্রাচীন ও কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ হিসেবে পরিচিত। আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহ এই মসজিদ ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে কবুল করুন।
গ্রামের সব মসজিদেই মুসল্লিরা অনেক বিলম্বে আসেন। অথচ জুমার দিন আমাদের ঈদের দিন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠতম দিন। গোসল করে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে আজানের পরপরই আমাদের আল্লাহর ঘরে উপস্থিত হওয়া উচিত। আগমনের ভিত্তিতে ফেরেশ্তারা মুসল্লিদের আমলনামায় উট, গরু,ছাগল কুরবানির সওয়াব লিখে থাকেন এবং খতিব মহোদয় মিম্বরে আরোহণের পরপরই তাঁরা সওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে থাকেন। আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া যে, তিনি দয়া করে আমাদেরকে তাঁর ঘরে হাজির হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। বলতে পারেন, আমরা আল্লাহর বাছাইকৃত বান্দা, মনোনীত বান্দা। এজন্য আমরা তাঁর দরবারে শুকরিয়া আদায় করি। আলহামদু লিল্লাহ।
আপনারা সবাই জানেন, গত ১৪ই আগস্ট দেশবরেণ্য আলেম আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তাঁর মহান রবের কাছে ফিরে গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রজেউন)। আল্লামা সাঈদী শুধু দেশে নয়, তাঁর পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা সারা বিশ্বের ঈমানদারদের কাছে অতুলনীয়। সুমধুর কণ্ঠ এবং সাবলিল ভাষায় তিনি তাফসিরুল কুরআনের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে ইসলামকে চমৎকারভাবে পেশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অমুসলিমরাও তাঁর ভক্ত ছিলেন এবং তাঁর হাতে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছেন। দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি কাবাঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলেন। পাশে থেকে একজন জানালেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী দ্বিতীয় জন ছিলেন। স্রেফ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। তাঁর মতো একজন আলেমের পক্ষে খুন, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটন কি সম্ভব? সমস্বরে সবাই বলেন, না। আসলে ইসলামী আন্দোলনের কারণেই তাঁকে এই দণ্ড দেওয়া হয়েছে। অতীতেও অনেক নবি-রসুল ও ঈমানদার জনগোষ্ঠীর উপর নানাভাবে নিপীড়ন- নির্যাতন করা হয়েছে।
মৃত্যুর পরেও আমরা তাঁর সাথে ভালো আচরণ করতে পারিনি। ঢাকায় একটি জানাজা অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি এবং গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠানে নানাভাবে বাধা প্রদান করা হয়েছে। অথচ পার্শ্ববর্তী ভারতে মাইকিং করে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে তাঁর জানাজা হয়েছে। কাবাঘরের সম্মানিত ইমাম তাঁর জন্য দোয়া করেছেন।
আল্লাহপাক আলেমদের অনেক ইজ্জত দান করেছেন। এখন আর নবি-রসুল আসবেন না। তাঁদের অবর্তমানে নবিদের দায়িত্ব পালন করেন আলেম সমাজ। রসুলুল্লাহ সা. আলেমদের তাঁর ওয়ারিস হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘আলেমগণ হলেন নবিদের ওয়ারিস। নবিগণ কোনো দিনার বা দিরহাম মিরাসরূপে রেখে যান না; উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁরা রেখে যান শুধু ইলম। সুতরাং যে ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’- সুনানে আবু দাউদ ৩৬৪৩। আমার সন্তান আমার উত্তরাধিকার। নিশ্চয়ই আমার সন্তানের সাথে কেউ দুর্ব্যবহার করলে আমি কষ্ট পাবো। তাই কোনো আলেমকে যদি কেউ কষ্ট দেয় বা অসদাচরণ করে তাহলে বুঝতে হবে রসুল্লাহ সা.-এর প্রতি তার কোনো ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই। শুধু তাই নয়, তার অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসাও নেই।
একজন আলেম ছোট হোক বা বড়ো হোক বা দীন চর্চা করছে এমন সকলের সাথে নবির ওয়ারিস হিসেবে আপনারা মুহাব্বতের সম্পর্ক রাখবেন। আলেমদের প্রতি যদি ভক্তি-শ্রদ্ধা না করেন তাহলে দেশে আলেম তৈরি হবে না। ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর উক্তি, যে দেশে গুণীর কদর নেই সেদেশে গুণী জন্মায় না। গ্রামের মসজিদগুলোয় ইমাম-মুয়াজ্জিন হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদেরকে সামান্যই সম্মানী প্রদান করা হয়। আমরা আমাদের শৈশবে দেখেছি, বাড়িতে লাউ হয়েছে প্রথম লাউটি ইমাম সাহেবের, মুরগির ডিম, গরুর দুধ, নারিকেল যাকিছু বাড়িতে হয়েছে আল্লাহর ঘরের খেদমতে যারা নিয়োজিত তাদেরকে প্রদান করে তৃপ্তি লাভ করেছে। সাহবায়ে কেরাম রসুলুল্লাহ সা.-কে অন্তর থেকে মুহাব্বাত করতেন এবং তাঁকে নিজ বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে পরম তৃপ্তি পেতেন। অনেক সময় দেখা গেছে রসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে অনেক সাহাবি। সেময়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করার বিনিময়ে আল্লাহপাক সেই খাবারে প্রভূত বরকত দান করেছেন। এখন নবি নেই, কিন্তু নবির ওয়ারিস আলেমদের প্রতি উত্তম ব্যবহারের বিনিময়ে সেই সওয়াব লাভ করতে পারেন।
শুধু আলেমদের প্রতি ভালো ব্যবহার নয়, সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করা ইসলামের নির্দেশ। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ-আদর করে না, তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয় অর্থাৎ মুসলমান নয় এবং যে মুসলমান নয় তার আবার নামাজ- রোজার প্রয়োজন কী? রসুলুল্লাহ সা. আরো বলেছেন, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, মুমিন নয়, মুমিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়। তাহলে বোঝা যায়, কোনো দুরাচারী ব্যক্তি না মুমিন, না মুসলমান; একজন নিরেট কাফের বৈ আর কেউ নন। আমি আপনাদেরকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার জন্য অনুরোধ করছি। হিংসা-বিদ্বেষ কেবল কবিরা গুনাহ নয়, হিংসুক ব্যক্তি আমল শূন্য হয়ে পড়ে। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়, তেমনি হিংসা মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। বিশেষ বিশেষ দিনে আল্লাহপাক তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, সেই ক্ষমা থেকে বাদ পড়ে কেবল মুশরিক ও হিংসুক। সুরা ফালাকে হিংসুকের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহপাক তাঁর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য বলেছেন।
আমি আপনাদেরকে হতাশ করতে চাই না। আমাদের সবারই গুনাহ রয়েছে। গুনাহ থেকে তওবা করলে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। এমনকি ঈমানদারদের সাথে দুর্ব্যবহারকারীও ক্ষমা পেতে পারে। আল্লাহর বাণী, ‘যারা ঈমানদার নর ও নারীকে কষ্ট দেয় অতঃপর তওবা করে না তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি’- সুরা বুরুজ ১০। ‘অতঃপর তওবা করে না’- এ কথার মধ্যে জালেমের জন্যও ক্ষমার একটি সুযোগ রয়েছে। আমরা কখনো কাউকে কষ্ট দিব না বা কারো হক নষ্ট করবো না, তারপরও যদি হয়ে যায় তাহলে আল্লাহর কাছে তওবা করে নিজেকে সংশোধন করে নেব ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহপাক আমাদেরকে ইসলামের উপর টিকে থাকার তৌফিক দান করুন। ফরজ নামাজ শেষে ইমাম সাহেব আল্লামা সাঈদীসহ সবার জন্য দোয়া করেন।
Comments
Post a Comment