মুহাম্মদ সা. ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাঁর জাতির কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি, জাতির পক্ষ থেকে আল আমিন ও আস সাদিক খেতাবপ্রাপ্ত। কিন্তু নবুয়ত লাভের পর যখনই তিনি মানুষকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন তখনই তাঁর সাথে শত্রুতা শুরু হয়ে যায়। এটা শুধু তাঁর সাথে নয়, সকল নবি-রসুলের সাথেই হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে নবি-রসুলদের উত্তরাধিকার ও নমরুদ-ফেরাউনদের উত্তরাধিকারের মাঝে; এটা চিরন্তন, কেয়ামত পর্যন্ত। সকল নবি- রসুলের দায়িত্ব ছিল অভিন্ন ‘দীন প্রতিষ্ঠিত করো এবং এতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না’- সুরা আশ শূরা ১৩। নবি- রসুলের অনুসারিদেরও একই দায়িত্ব। পক্ষান্তরে সকল যুগের স্বৈরশাসকরা এই একই প্রশ্নে নবি-রসুলদের প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। দাওয়াত দানের সাথে সাথে রসুলুল্লাহ সা.-এর বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠে, তিনি যা নন তাঁকে তাই বলা হয়েছে। তাঁর ও তাঁর সাহাবিদের ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। টিকতে না পেরে অনেককে আবিসিনিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং একটি পর্যায়ে আল্লাহর নির্দেশে তিনি মদিনায় হিজরত করেন। জুলুম- নির্যাতনে জর্জরিত সাহাবায়ে কেরাম রা. বলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমরা তো আর সহ্য করতে পারি না। আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? জবাবে মুহাম্মদ সা. বলেন, বিপদ আর কী দেখেছ? অতীতে যারাই ইমান এনেছে তাদের কাউকে করাতে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে, কারো শরীর থেকে গোশত খসিয়ে নিয়েছে, কিন্তু কেউ ইমান ত্যাগ করেনি। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন একজন ষোড়শী স্বর্ণালঙ্কারসহ সানা থেকে হাজরা মাউত একাকী হেঁটে যাবে তাকে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতে হবে না।
রসুলুল্লাহ সা. তাঁর সাথিদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন এক নিরাপদ সমাজের যেখানে কোনো অন্যায়, জুলুম- নির্যাতন থাকবে না। থাকবে না ভয়-ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা, থাকবে কেবল আল্লাহরই ভয়। দীর্ঘ তেরো বছর অসহনীয় জুলুম নির্যাতন সহ্য করে অবশেষে হিজরতের পর মদিনায় গড়ে তুলেন একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এবং তিনি হলেন সেই নবগঠিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, প্রধান বিচারপতি ও সেনানায়ক- এককথায় তিনিই সব। মক্কায় তেরো বছরে কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহ নেই, একতরফা মার খেয়েছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে যুদ্ধের কোনো অনুমতিও ছিল না। আসলে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি বা দল যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না। মদিনায় একটি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হওয়ার পর আল্লাহর নির্দেশে তিনি তাঁর সাথিদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন এবং একের পর এক বদর, ওহুদ, খন্দক ও ছোট-বড়ো নানা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কুফরি শক্তিকে পর্যুদস্ত করে দেন। মাত্র আট বছরের ব্যবধানে তিনি দশ হাজার সৈন্য নিয়ে মক্কা আক্রমণ করে বিনাযুদ্ধে জয় লাভ করেন। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে আরবের কুফরি শক্তি নির্মূল হয়ে যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি ঘোষণা করেন, ‘সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত হয়েছে; মিথ্যা দূরীভূত হবেই- বনি ইসরাইল ৮১।
বিজয় লাভের পর কোনো বিজয়োল্লাস নেই, কাউকে আঘাত করা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, শত্রুকে বাড়িঘরে খুঁজে বেড়ানো বা আতঙ্ক সৃষ্টি কোনো কিছুই করলেন না বরং তিনি তাঁর রবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়েন, তাঁর মুখে শুধুই আল্লাহর প্রশংসা- সোবহান আল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহু আকবার ধ্বনি। তাঁর জানের দুশমন যারা তাকে তেরোটি বছর ধরে শান্তিতে বাস করতে দেয়নি, সামাজিকভাবে বয়কট করে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট দান করেছে, মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করেছে এবং মদিনায় হিজরত করার পরেও একটু স্বস্তি না দিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে অনেক সঙ্গী-সাথিকে শহিদ করেছে; তাদেরকে হাতের মুঠোয় পেয়ে প্রতিশোধ না নিয়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বললেন- যারা কাবায় আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ, যারা কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ এবং যারা নিজ ঘরে অবস্থান করবে তারাও নিরাপদ। তাঁর মহানুভবতা ও ক্ষমা ছিল এক বিস্ময়। এই উদারতা ও ক্ষমা ইসলামকে দ্রুত মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছিল এবং জাহেলি চিন্তা-চেতনা ঝেড়ে ফেলে সবাই একযোগে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাতে বাদ যায় না আবু জেহেলের ছেলে ইকরামা বা হামজা রা.-এর কলিজা ভক্ষণকারী হিন্দা। নঈম সিদ্দিকী তাঁর বিখ্যাত সিরাত গ্রন্থ 'মানবতার বন্ধু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সা.-এর ৩৭ পৃষ্ঠায় চমৎকারভাবে বিশ্বনবি মুহাম্মদ সা.-এর মহানুভবতা তুলে ধরেছেন।
‘রসুল সা. এর কাছে এ সত্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট ছিল যে, যে বিপ্লব প্রতিশোধ নিতে আরম্ভ করে তা আপনা থেকেই খতম হয়ে যায়। আর যে বিপ্লব ক্ষমা ও মহানুভবতা প্রয়োগ করে, তা শত্রুকেও বশীভূত করে এবং প্রতিরোধকারীদেরকে সেবকে পরিণত করে।’
মুসলিম উম্মাহ তাদের নবির সা. শিক্ষা উদারতা, প্রশস্ততা, ক্ষমাশীলতা ভুলে গিয়ে পরস্পর হিংসা- বিদ্বেষ ও হানাহানিতে লিপ্ত যা আইয়ামে জাহিলিয়াতকেও ছাড়িয়ে গেছে। মুসলিম জাহানে কোনো শান্তি-স্বস্তি নেই। শান্তি-স্বস্তি নেই তাও বুঝে না। আল্লাহপাক যাদেরকে বিশ্বশাসনের দায়িত্ব প্রদান করেছেন তারা আজ কাফের-মুশরিকদের পদানত, সবসময় ভয় ও আতঙ্কে দিন কাটে, শত্রু-মিত্রও চেনে না। মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহপাক যাদেরকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে বারবার তাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে ও একটু শান্তির জন্য সেদিকে তাকিয়ে আছে। তারা আমাদের মানবাধিকার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সকলকে সমান সুযোগ দানের জন্য নসিহত ও সতর্ক করছে। একটু চিন্তা করুন তো, সেই দেড়হাজার বছর পূর্বে প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা. বলে গেলেন, যে তার ঘরে অবস্থান করবে সে নিরাপদ। আজ আমাদের ঘর নিরাপত্তাহীন। রাতে ঘুমাতে পারে না। দোয়া-দরুদ পড়ে কাতরভাবে আল্লাহকেই বলে, পরোয়ারদেগার! আমাকে নিরাপত্তা দান করো। রাষ্ট্রের উদ্ভবই হয়েছে মানুষের নিরাপত্তা দানের লক্ষ্যে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! মানুষ আজ আর রাষ্ট্রের কাছে নিরাপদ বোধ করে না। আজ ইউরোপ-আমেরিকা তাদের নাগরিকদের জান- মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। অথচ মুসলিম জাহানে নিজের দেশ ও নিজের বাড়িতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে।
মানুষের জান-মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে রসুলুল্লাহ সা. কত সতর্ক ছিলেন। কোনো মানুষ যাতে কোনভাবেই হেনস্থা না হয় সেজন্য তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, মুমিন নয়, মুমিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট হতে অন্যরা নিরাপদ নয়। কারো কথা আড়িপেতে শোনা বা কারো ঘরে উঁকিমারা তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে কেউ যদি কারো ঘরে তাকাই বা উঁকি মারে রসুলুল্লাহ সা. তার চোখ ফুটো করে দিতে বলেছেন। দুজন মানুষ কথা বলতে থাকলে সেখানে কারো পক্ষে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করা অন্যায়। অর্থাৎ কারো চিঠি পড়া, মোবাইল দেখা ও কারো গোপনীয়তা ভঙ্গ করা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। খলিফা ওমর রা.-এর শাসনামলে তিনি রাতে প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য বের হতেন। একদিন তিনি একটি ঘর থেকে গানের আওয়াজ শুনতে পান। তিনি দেয়ালের ওপর থেকে দেখেন যে সেখানে একজন মহিলা ও সাথে মদের পাত্র। খলিফা বলেন, হে আল্লাহর দুশমন! তুই কি মনে করেছিস অপরাধ করবি আর কেউ জানবে না? লোকটি তাৎক্ষণিক বলে উঠে, হে আমিরুল মুমিনিন! তাড়াহুড়ো করবেন না। আমি অপরাধ একটি করলে আপনি করেছেন তিনটি। আল্লাহপাক সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে বলেছেন, অনুমতি গ্রহণ ও গৃহকর্তাকে সালাম দিয়ে প্রবেশ করতে বলেছেন; অথচ আপনি কিছুই করেননি। ওমর রা. লজ্জিত হয়ে ফিরে আসেন। এরই নাম মানবাধিকার।
ইসলামে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় অর্থাৎ কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানে বাধ্য করা বৈধ নয়। জনৈক মহিলা রসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে এসে জেনার শাস্তি তার ওপর প্রয়োগ করার জন্য নিবেদন করে। আসলে এসব মানুষগুলো আখেরাতকে এতটা ভয় পেয়েছিল যাতে দুনিয়ার জীবনটা তার কাছে একেবারে তুচ্ছ মনে হয়েছিল। পুরুষটাকে ডেকে আনা হলে সে অস্বীকার করে। যেহেতু চারজন সাক্ষী ছিল না সেহেতু পুরুষটাকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং মহিলার ওপর দণ্ড কার্যকর করা হয়। ইসলামে বিচারব্যবস্থা হলো স্বেচ্ছায় অপরাধের স্বীকারোক্তি অথবা দুজন ন্যায়বান সাক্ষীর (জেনার ক্ষেত্রে চারজন) সাক্ষ্যদানের ভিত্তিতে। কেউ কোনো মামলা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থা বা বিচারকের কাছে পেশ করলে তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে পড়ে ন্যায়বিচার করা। কারো অপরাধ গোপন রাখাকে সওয়াবের কাজ বলা হয়েছে। হাদিসের ভাষা হলো, যে তার ভাইয়ের দোষ গোপন রাখবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন। কোনো অপরাধী তার অপরাধ গোপন রেখে আল্লাহর কাছে তওবা করে পরিশুদ্ধ হতে পারে। শাস্তিদানের জন্য ইসলামে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। ইসলামে মটিভিশন খুব প্রশংসনীয় অর্থাৎ আখেরাতে শাস্তির ভিত্তিতে ইসলাম তার অনুসারীদের পরিশুদ্ধ করতে চায়।
আল্লাহপাক সুরা হুজুরাতে সুস্পষ্টভাবে ধারণা-অনুমান ও দোষ অন্বেষণ করতে নিষেধ করেছেন। অথচ আমাদের সমাজে এগুলো সব মামুলি বিষয় হয়ে পড়েছে। কত নিরীহ মানুষ যে নানাভাবে জুলুমের মুখোমুখি হয় তার হিসাব মেলানো ভার। আমাদের আদালত মিথ্যার ওপরেই চলে। আদালত মানে যেখানে আদল ও ইনসাাফ করা হয়। একজন মুসলিম সত্য সাক্ষ্য যেমন গোপন করতে পারে না তেমনি মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। মিথ্যা সাক্ষ্যদান শিরকের সমতূল্য বড়ো গুনাহ। বর্তমানে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মূলত মানুষের অধিকার হরণ করা হচ্ছে।
আমরা নিজেদের ভাগ্যের ফয়সালা আমাদের শত্রুদের হাতেই তুলে দিয়েছি। মতপার্থক্য থাকতেই পারে এবং সেই মতপার্থক্য দূর করার জন্য নানা পন্থাও রয়েছে। মুসলমানদের বিভিন্ন দলের মাঝে বিরোধ হলে পরস্পর সমঝোতা করার তাগিদ স্বয়ং আল্লাহপাকই দিয়েছেন। বিবদামান দলগুলির মাঝে সমঝোতা করে দেয়ার জন্য কাউকে না কাউকে উদ্যোগ নেয়ার কথাও বলেছেন (সুরা হুজুরাত)। রাজনীতির ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও সমঝোতার অভাবে কী পরিণতি হয় আমরা আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে চাক্ষুস দেখছি। এসব দুনিয়ার শাস্তি আখেরাতে যে কোনো প্রাপ্তি নেই (আল্লাহকে আংশিক মানার পরিণতি দুনিয়ার জীবনে জিল্লতি আর আখেরাতে রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি) আল্লাহ আগেই বলে রেখেছেন। কে কার কথা শোনে? অনর্গল মিথা বলার কারণে আমরা চরম আস্থাহীনতায় ভুগছি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। মিথ্যাবলা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা রাজনীতিক কৌশল হিসেবে মনে করা হয়। ঘনঘন দলবদল এবং নতুন নতুন দল ও জোটের সৃষ্টি সবই নাকি প্রতিপক্ষকে হারানোর কৌশল এবং বলা হয় রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বুঝলাম, সবই ঠিক কিন্তু পৃথিবীতে এত মিথ্যা কথা কেউ বলে? কোনো দেশে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এতটা কি বিতর্কিত? হে আল্লাহ! তুমি আমাদের মাঝে উপলব্ধি দান করো। আমাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য দেশটাকে নিরাপদ করে দাও। আমিন। ১৯.০১.২০২৩
Comments
Post a Comment