Skip to main content

প্রতিকূল পরিবেশে দীন কায়েম

মানুষের হেদায়েতের জন্য আল্লাহপাক অসংখ্য নবি- রসুল প্রেরণ করেছেন। সকলের মিশন ছিল একই- মানুষকে শিরকমুক্ত করে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহবান জানানো। সকলেই একই কালেমার দাওয়াত দিয়েছেন- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই)। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়- আনিই বুদুল্লাহ ওয়াজতানিবুত তাগুত (আল্লাহর দাসত্ব করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো)। সকল নবি-রসুল ছিলেন তাঁর সময়কালের সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং জাতির সবচেয়ে কল্যাণকামী। তারপরও জালেম শাসক ও পাপাচারী জনগণ নবি-রসুলদের সহ্য করতে পারেনি। তাগুতকে অস্বীকার করে একান্তভাবে আল্লাহর আনুগত্য তখনই সম্ভব যদি আল্লাহর দীন জমিনে প্রতিষ্ঠিত থাকে। তাই আল্লাহপাক সকল নবি-রসুলকে দীন কায়েমের দায়িত্ব দিয়েই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য সেই বিধানই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নুহকে এবং যা আমি তোমার কাছে ওহি করে পাঠিয়েছি, উপরন্তু যার আদেশ আমি ইবরাহিম, মুসা ও ইসাকে দিয়েছিলাম, তোমরা এ দীন প্রতিষ্ঠিত করো এবং এতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না’- সুরা আশ শূরা ১৩। দীনকে বিজয়ী করে দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহপাক সর্বশেষ নবি মুহাম্মদ সা.-কে সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছেন। তাঁর বাণী, ‘তিনি তাঁর আপন রসুলকে হেদায়েত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দীন বা ব্যবস্থাপনার ওপর তাঁর দীনকে বিজয়ী করতে পারেন, মুশরিকরা যতই অপছন্দ করুক না কেন’- সুরা সফ ৯। একই কথা সুরা তওবা (৩৩ নং আয়াত) ও ফাতাহ (২৮ নং আয়াত) একটু হেরফের করে বলেছেন। আল্লাহপাকের স্পষ্ট উক্তি ‘দীন কায়েমের প্রশ্নে কাফের- মুশরিকরা কখনই ছাড় দিবে না’।

হেদায়েত দানের লক্ষ্যে সকল জাতিগোষ্ঠীর কাছে আল্লাহপাক নবি-রসুল পাঠিয়েছেন। তার মধ্যে স্বল্পসংখ্যক সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। নবি-রসুলদের শিক্ষা (আল্লাহর আনুগত্য) ছেড়ে মানুষ নিজেরাই তাগুত হয়েছে বা তাগুতের অনুসারী হয়ে সমাজে জুলুম-নির্যাতন ও অশ্লীলতার প্রসার ঘটিয়েছে। তেমন পরিস্থিতিতে হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তায়ালা নবি-রসুল প্রেরণ করেছেন। নবি প্রেরণ সত্ত্বেও তাঁদেরকে অমান্য করে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে আল্লাহপাক অতীতে অনেক জাতিগোষ্ঠী ও স্বৈরশাসককে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তন্মধ্যে নুহ আ.-এর জাতি, শোয়াইব আ.- এর জাতি, লুত আ.-এর জাতি অন্যতম এবং স্বৈরশাসকদের মধ্যে নমরুদ ও ফেরাউনের কথা বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম আ.-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করলে নমরুদের কথা আসে। এই পাষণ্ড ও নরপশু ইব্রাহিম আ.-কে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহপাক ইব্রাহিম আ.-কে রক্ষা করেন এবং নমরুদকে এক অতি ক্ষুদ্র প্রাণী মশার আক্রমণ দিয়ে ধ্বংস করে দেন। আর এক স্বৈরশাসক ফেরাউন তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বনি ইসরাইলের সকল পুরুষ সন্তানকে হত্যা করে এবং মুসা আ. ও তাঁর কওমের উপর চালায় সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন। তাঁর প্রতি ইমান আনয়নকারী যাদুকরদের নির্মমভাবে হত্যা করে। শেষ পর্যন্ত মুসা আ. টিকতে না পেরে তাঁর সঙ্গী- সাথি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ফেরাউন তার সৈন্য- সামন্ত নিয়ে ধাওয়া করলে সামনে সমুদ্র বাধে এবং আল্লাহপাকের নির্দেশক্রমে মুসা আ. পানিতে লাঠির আঘাত করলে রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। সেই রাস্তা দিয়ে মুসা আ. অতিক্রম করলেও ফেরাউন সদলবলে ডুবে মরে। এসবই আল্লাহপাকের নিদর্শন। কিন্তু জালেমরা শিক্ষা নেয় না।

আল্লাহপাক মুমিন ও কাফেরকে দুটি পক্ষ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘যারা ইমান আনে তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে আর যারা কুফরি করে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। তোমরা লড়াই করো শয়তানের বন্ধুদের সাথে। শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’- সুরা নিসা ৭৬। মাঝামাঝি কোনো পথ আল্লাহ রাখেননি। মাঝামাঝি যারা আছে তারা মূলত সুবিধাবাদী (মুনাফিক)। আল্লাহপাক আদম আ.-কে সৃষ্টি করে তাঁকে জান্নাতেই রেখেছিলেন এবং এটিই তাঁর আদিবাস। এই দুনিয়া একটি পরীক্ষাগার। দুনিয়ার জীবন বড়ো ক্ষণস্থায়ী। পক্ষান্তরে আখেরাতের জীবন অসীম। আল্লাহ তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের ওয়াদা করলেও আখেরাতকে অগ্রাধিকার দান করেছেন। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি ও আখেরাতে চিরশান্তি জান্নাত লাভের জন্য আল্লাহপাক তাঁর মুমিন বান্দাদের নানাবিধ পরীক্ষার মুখোমুখি করেন। পরীক্ষা প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। পরীক্ষা আল্লাহর পক্ষ থেকে (রোগ- শোক নানাবিধ পন্থায়) আবার মানুষের পক্ষ থেকেও। বিপদাপদ উপস্থিত হলে যারা ধৈর্য অবলম্বন করে এবং বলে যে আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাব (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রজেউন) তাদের জন্যই সুসংবাদ (বাকারা ১৫৩-১৫৬)। পরীক্ষা শুধু মুমিনদের নয় কাফেরদেরও রয়েছে। মুমিনদের পরীক্ষা বিপদ-আপদে ধৈর্যের আর কাফেরদের পরীক্ষা তার সীমালঙ্ঘনের। পুরস্কার ও শাস্তিদানের ক্ষেত্রে আল্লাহকে দেখে নিতে হবে। যারা আল্লাহর রাস্তায় চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় তারা যে আল্লাহর কত প্রিয়ভাজন তা কল্পনাও করা যায় না। আল্লাহর বাণী, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরই ভালোবাসেন যারা সীসাঢালা প্রাচীরের মতো সারিবদ্ধভাবে আল্লাহর পথে লড়াই করে’- সুরা সফ ৪। আল্লাহর সেই প্রিয়ভাজন বান্দাদের প্রতি যারা জুলুম করে তাদের পরিণতিও আল্লাহ বলে দিয়েছেন- ‘যারা ইমানদার নর ও নারীকে কষ্ট দেয়, অতঃপর তওবা করে না তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি’- সুরা বুরুজ ১০। অতঃপর ‘তওবা করে না’- এর মধ্যে জালেমদের ফিরে আসার সুযোগও রেখেছেন।

মানব জাতির শেষ নিবাস হয় জান্নাত অথবা জাহান্নাম। যারা আল্লাহর বিধান মেনে চলবে এবং দীন প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাবে আল্লাহপাক তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করাবেন পক্ষান্তরে যারা অমান্য (কুফরি) করবে ও শয়তানের অনুসারী হবে তাদের অবস্থান হবে জাহান্নামে। একামতে দীনের বৈশিষ্ট্যই হলো কুফরি শক্তির বিরোধীতা (‘মুশরিকরা যতই অপছন্দ করুক না কেন’- সুরা সফ ৯) এবং বিরোধীতার মোকাবেলায় দীনের পথে অবিচল থাকতে পারলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল গুনাহের ক্ষমা এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে (সুরা সফ ১২)। অবশ্য খেদমতে দীনের বিনিময়েও জান্নাতের ঘোষণা রয়েছে। কুরআন মজিদে বিভিন্ন জায়গায় ইমানের সাথে নেক আমল করলে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে। অবশ্য এমন অবস্থায় জান্নাতপ্রাপ্তি বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ দীন কায়েম না হলে পরিপূর্ণ ইসলাম মানা দুরূহ ব্যাপার। এজন্য দীন কায়েমে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও একটি কামনা- বাসনা থাকতেই হবে। এপ্রসঙ্গে একটি হাদিস উল্লেখ করতে চাই। যে লোক মারা গেল অথচ না জিহাদ করলো আর না জিহাদের বাসনা অন্তরে পোষণ করলো তার মৃত্যু হলো মুনাফিকের মৃত্যু। কুরআনের বর্ণনাভঙ্গিও তাই- ‘বলবো কি এমন একটি ব্যবসায়ের কথা যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আজাব থেকে রক্ষা করবে? তা হলো আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি বিশ্বাস এবং জান-মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করা; এটিই সবচেয়ে কল্যাণকর যদি তোমরা বুঝতে’- সুরা সফ ১০-১১।

নবি-রসুলদের কাজই ছিল জমিনে আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করে দেয়া। এজন্য তাঁরা স্বাভাবিক পন্থা অর্থাৎ মানুষের কাছে দাওয়াত প্রদান, তাদেরকে সংগঠিত করা এবং পরিশুদ্ধ করার পথ অবলম্বন করেছেন এবং কুরআনের বক্তব্যও তাই। এ প্রসঙ্গে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম আ.-এর দোয়া উল্লেখ করা যায়- ‘হে আমাদের রব! এদের (আমার বংশধর) কাছে এদের মধ্য থেকেই একজন রসুল পাঠাও, যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে (তোমার) কিতাব এবং হিকমা শিক্ষা দেবেন আর তাদেরকে পরিশুদ্ধ (তাজকিয়া) করবেন। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞানী’- সুরা বাকারা ১২৯। শেষনবি মুহাম্মদ সা. আমাদের আদর্শ এবং কিয়ামত পর্যন্ত সকলের জন্য আদর্শ। হেরা গুহায় ওহিপ্রাপ্ত হয়ে ভীত- সন্ত্রস্ত হয়ে ঘরে ফিরে আসলে মা খাদিজা রা. তাঁকে আশ্বস্ত করেন, আপনার কোনো ভয় নেই কারণ আপনি অসহায়ের সহায়, আত্মীয়-স্বজনের সহায়তাকারী, উত্তম চরিত্রের অধিকারী, আল্লাহ আপনার সঙ্গে রয়েছেন। মা খাদিজা রা. হলেন প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী মুসলিম। রসুল সা.-এর কাজ ছিল মানুষকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনানো ও তাদেরকে সেই আলোকে পরিশুদ্ধ করা। সে সময়ে অবতীর্ণ ছোট্ট ছোট্ট সুরা যা সহজে মুখস্থ রাখার মতো ও মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। সুরা আসরে বলা হয়েছে- ইমানের সাথে নেক আমল এবং হকের দিকে আহবান ও ধৈর্য অবলম্বন করলেই ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে বাঁচা যাবে। নেক আমলের কোনো ফিরিস্তি দেয়া হয়নি বরং মানুষের বিবেক-বুদ্ধি যা দাবি করে বা মানব কল্যাণ সাধন করে এমন আচরণ ও কর্ম সবই নেক আমল। সুরা হুমাজায় বলা হয়েছে নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনাসামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে। পরিণতি বলা হয়েছে আল্লাহর আগুন, প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত-উৎক্ষিপ্ত। একটু গালি দিলে বা অসাক্ষাতে নিন্দা (গিবত) করলে যদি এই পরিণতি হয় তাহলে গুম-খুনের পরিণতি কী হতে পারে? সুরা মাউনে বলা হয়েছে- পরকালে অবিশ্বাসী লোক তালাশ করছো? সে তো সেই লোক যে ইয়াতিমকে ধাক্কা দেয় ও মিসকিনের খাবার দিতে উৎসাহিত করে না। সে এতো ছোট লোক যে নিত্য ব্যবহার্য (মাউন) জিনিস অপরকে দেয়া হতে বিরত থাকে। কুরআনের আয়াত পড়ে পড়ে এভাবেই রসুলুল্লাহ সা. তাঁর উম্মতদের পরিশুদ্ধ করেছেন। পরিশুদ্ধ অর্থ আল্লাহপাক যে কাজ করতে আদেশ করেছেন সেটি সম্পন্ন করা এবং যেটি করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। মক্কায় মানুষকে দাওয়াত দান এবং যারা কবুল করেছেন তাদেরকে একত্রিত (সংগঠিত) করা ও পরিশুদ্ধ করাই ছিল রসুলুল্লাহ সা.-এর মৌলিক কাজ।

কুরআন-মজিদে যত নবি-রসুলকে উপস্থাপন করা হয়েছে সবাইকে নিপীড়িত-নির্যাতিত হিসেবেই পেশ করা হয়েছে। শেষনবি মুহাম্মদ সা. সুদীর্ঘ তেরোটা বছর একতরফা মার খেয়েছেন এবং কাউকেও পাল্টা মার দেননি। যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেই। যুদ্ধ ঘোষণা করবে রাষ্ট্রশক্তি বা সরকার। মদিনায় রসুলুল্লাহ সা. একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হলে দশটি বছর তিনি নানা যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। রসুলুল্লাহ সা. মক্কায় অধিকাংশ সময় গোপনে দাওয়াত দিয়েছেন এবং একটি পর্যায়ে হামজা রা. ও উমর রা.-এর মতো কিছু বাহাদুর ইসলামের ছায়াতলে আসার পর পরিবেশ কিছুটা উন্নত হয়। তারপরও সাধারণ সাহাবিরা খোলামেলা দাওয়াত দিতে পারেননি। রসুলুল্লাহ সা.-এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব ও তাঁর বংশধররা কাবার মুতাওয়াল্লি হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ্যে কাবায় তাঁর নামাজ আদায়ের সুযোগ ছিল না। বরং কোনো সময়ে আবু জেহেল বা এমন কোনো পাপিষ্ঠের নজরে পড়লে মুহাম্মদ সা.-এর উপরে উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিত। দেশে দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা চলছে তা মূলত রসুল সা.-এর মক্কিযুগের সাথেই তুলনীয়। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কি একতরফা আঘাত সহ্য করবে? হ্যাঁ, একতরফাই মার খাবে। ইতিহাস তো তাই বলে। সুযোগ থাকলে হিজরত করবে যেমন সাহাবিরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন অন্যথায় প্রতিপক্ষের আক্রমণে পালিয়ে যাবে যেমন মুসা আ. পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইসলামি আন্দোলনে জুলুম-নির্যাতনের বদলা হলো দীন কায়েমের জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা এবং পরম ধৈর্য অবলম্বন করে টিকে থাকা। প্রতিকূল পরিবেশে যারা টিকে থাকবে তারাই সফলকাম। সুযোগ আসলে বদলা গ্রহণের চিন্তা একেবারেই ছেড়ে দিতে হবে। বদলা গ্রহণ তখনই হতে পারে যখন কাজটি হয় নিজের বা দলের। কিন্তু দীন প্রতিষ্ঠা একান্তই আল্লাহর এবং ইমানদারগণ হলো আল্লাহর সাহায্যকারী (সৈনিক)। মনে রাখতে হবে, বদলা গ্রহণের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং সে শক্তি তাঁর রয়েছে। একামতে দীনের কাজের বিনিময়ে আল্লাহপাক মুমিনদেরকে জান্নাত দান করবেন এবং আল্লাহর ভাষায় এটিই সবচেয়ে বড়ো সাফল্য (সুরা সফ ১২)। আরো দেবেন, যা মুমিনরা পছন্দ করে, আল্লাহর সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয় (সুরা সফ ১৩)। এটি আল্লাহর অতিরিক্ত দান।

দীন কায়েম একান্তভাবে আল্লাহর। ইমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হলে আল্লাহপাক তাদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করবেন। তাঁর বাণী, ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ইমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দীনকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক’- সুরা নূর ৫৫। আল্লাহর পথে প্রচেষ্টাকারী জনগোষ্ঠীকে কোনো নেতিবাচক কাজ নয় শুধু ইতিবাচক কাজ অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকবে এবং নিজেরা নেক আমল করবে ও সাহসিকতার সাথে বলবে আমরা মুসলাম। আল্লাহর বাণী, ‘তার চেয়ে ভালো কথা আর কার হতে পারে যে ব্যক্তি মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে নেক আমল করে এবং বলে যে, আমি একজন মুসলমান’- হা-মীম আস্- সাজদা ৩৩। অর্থাৎ আচার-আচরণে, লেনদেনে ও কথাবার্তায় নিজেদেরকে সাচ্চা মুসলমান হিসেবে সমাজে উপস্থাপন করতে হবে। এমনটি সম্ভব হলে আল্লাহপাকের দায়িত্ব, এমন জনগোষ্ঠীর হাতে সমাজের কর্তৃত্ব দান করা। কীভাবে দেবেন, কখন দেবেন সে বিবেচনা আল্লাহর।

আল্লাহপাক নেতিবাচক কাজ থেকে তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের দূরে থাকার জন্য বলেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘হে নবি! ভালো ও মন্দ কখনো এক নয়। তুমি মন্দকে দূর করো সেই ভালো দ্বারা যা অতীব উত্তম। তাহলে দেখবে তোমার জানের দুশমনরা প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে। এ গুণ কেবল তারাই লাভ করতে পারে যারা অতীব ধৈর্যশীল। এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা কেউ লাভ করতে পারে না। যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো প্ররোচনা অনুভব করো তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো। তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন’। হা-মীম আস্-সাজদা ৩৪-৩৬। পরিবেশ- পরিস্থিতি অনুকূল-প্রতিকূল যাই হোক না কেন দাওয়াতে দীনের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। নিজ থেকে সংঘর্ষে জড়াতে না চাইলেও দাওয়াতে দীনের প্রকৃতিই হলো কুফরি শক্তি বাধা হয়ে দাঁড়াবে এবং নানা সমালোচনা ও নিন্দাবাদের ঝড় তুলবে। এক্ষেত্রে পরম ধৈর্য অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিপক্ষের মন্দের জবাব মন্দ দিয়ে নয় বরং সর্বোত্তম পন্থায় তার জবাব দিতে হবে। শয়তান প্ররোচনা দেয়, ওরা দশটি মার দিলে তোমরা একটিও পারো না, এমতাবস্থায় আল্লাহপাক তাঁর আশ্রয়ে চলে আসতে বলেছেন। অর্থাৎ দাওয়াতে দীন বা একামতে দীনের কাজ একান্তই আল্লাহর এবং জমিনে যারা এই দায়িত্ব পালন করে তারা আল্লাহর সাহায্যকারী। মুমিনদের অভিভাবক হলেন আল্লাহ এবং অভিভাবক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহর বাণী, মুমিনদের উচিৎ কেবল তাঁরই ওপর ভরসা করা। বিপদাপদ যা সবই পূর্ব নির্ধারিত। আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদ কখনই আসে না’- সুরা তাগাবুন ১১। ব্যক্তি সর্বোত্তম সতর্কতা অবলম্বন করবে এবং নির্ভর করবে তার অভিভাবক আল্লাহর ওপর। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আল্লাহপাক তাঁর অনুগত বান্দাদের অবিচল থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন। ১১.০১.২০২৩।

Comments