Skip to main content

দীনের প্রচার (তাবলিগ) ফরজে আইন

মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা একজন মুমিনের মৌলিক কাজ (ফরজে আইন)। জাহান্নাম থেকে দূরে অবস্থান এবং জান্নাতের প্রত্যাশী একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি কখনই এই দায়িত্ব পালন থেকে চুপ থাকতে পারে না। সে সর্বক্ষণের জন্য একজন দায়ী ইলাল্লাহ। রসুলুলল্লাহ সা.-এর ওপর সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর নবুওয়াত। বেশ কিছুদিন বিরতির পর সুরা মুদ্দাস্সিরের সাতটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মানুষকে সতর্ক করার কাজ। ‘ওঠো ও মানুষকে সাবধান করো’। হে কম্বল আবৃতকারী (মুদ্দাস্সির) বলে সম্বোধনের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে আরাম-আয়েশের দিন শেষ। গাফিলতিতে ডুবে থাকা মানুষকে সতর্ক করা নবি ও তাঁর অনুসারীর (মুমিন) প্রথম ও প্রধান কাজ। 

সুরা আসর রসুলুল্লাহ সা.-এর ওপর অবতীর্ণ প্রথম যুগের একটি সুরা। অল্প কথায় বিশাল তাৎপর্যপূর্ণ এই সুরাটি। আল্লাহপাক কসম খেয়ে মানুষের জীবনে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের কারণ এই সুরায় উল্লেখ করেছেন। সুরায় বর্ণিত চারটি গুণ ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির মাঝে না থাকলে সে বা তারা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। চারটি গুণই অবশ্যম্ভাবী। প্রথম গুণ হলো ইমান। ইমান বলতে মুসলমান হওয়ার জন্য যেসব বিষয়ে বিশ্বাস আনা শর্ত- সবগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। আল্লাহ, ফেরেশতা, রসুল, কিতাব, পরকাল ও তকদিরের প্রতি বিশ্বাসকে ইমান বোঝায়। দ্বিতীয়ত, ইমানের অনিবার্য দাবি নেক আমল। কারো মধ্যে ইমান বর্তমান থাকলে তার দ্বারা কখনো আল্লাহর নাফরমানি সম্ভব নয়, কেবলই ভালো কাজ তার দ্বারা সম্পাদিত হয়। সৃষ্টির জন্য হিতকর এমন সকল কাজকে নেক আমল বলা হয়। আল্লাহর সৃষ্টি বিশেষ করে মানুষ একজন মুমিনের (নেক আমলকারী) কাছ থেকে কখনই ক্ষতিগ্রস্ত বা জুলুমের শিকার হয় না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ’দুটি গুণ থাকতেই হবে। এর সাথে আরো দুটি গুণ জরুরি- মানুষের কাছে হকের দাওয়াত দান এবং এ ব্যাপরে ধৈর্য অবলম্বন।

মানুষের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে আল্লাহপাক মুসলিম উম্মাহকে সৃষ্টি করে তাদেরকে শ্রেষ্ঠতম জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, তাদের কাজই হলো মানুষকে ভালো কাজের আদেশ করা ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখা। একজন মুমিনের সম্মুখে কোনো অন্যায় হলে সে সেটা দূর করবে- হাত দ্বারা, কথা দ্বারা বা সম্ভব না হলে অন্তত ঘৃণা করে তা প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। একজন মুমিন সর্বদাই দায়ী। উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে সবসময় সে মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে। সে নিজেকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখার সাথে সাথে তার পরিবার (স্ত্রী-পুত্র-পরিজন), আত্মীয়-স্বজন, পাড়া- প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব সবার কাজে দাওয়াত প্রদান করবে। এটি তার জন্য ফরজ। আল্লাহর পথে ডাকার চেয়ে কল্যাণকর কাজ দ্বিতীয় নেই। আল্লাহ তায়ালা  অসংখ্য নবি-রসুল প্রেরণ করেছেন মূলত এই দাওয়াত দানের লক্ষ্যেই।

সকল নবি-রসুলের দাওয়াত ছিল তাওহিদের (আল্লাহর একত্ববাদ) দিকে। কালেমা তাইয়্যেবার দিকে, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্বের দিকে। সুরা মুদ্দাস্সিরে বলা হয়েছে, ওঠো মানুষকে সতর্ক করো এবং তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। সকল যুগে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার রাজা- বাদশা বা স্বৈরশাসকদের (তাগুত) সাথে নবি-রসুল ও তাঁদের অনুসারীদের প্রচণ্ড বিরোধীতা হয়েছে এবং এটিই স্বাভাবিক। নবি-রসুলগণ ছিলেন তাঁদের সময়কালে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী ও জাতির সবচেয়ে কল্যাণকামী। শাসকবর্গ সবসময় নবি-রসুলদের তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে ময়দানে দাওয়াতি কাজের সুযোগ না দিয়ে নানাভাবে জুলুম- নির্যাতন করেছে। অতীতে না তাকিয়ে আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.-এর ইতিহাস আমাদের সম্মুখে বর্তমান। সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ও জাতির পক্ষ থেকে আল আমিন ও আস সাদিক খেতাবপ্রাপ্ত হয়েও পাহাড়ের পাদদেশে সবাইকে একত্রিত করে যখনই আহবান জানান, ‘তোমরা বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাহলেই তোমরা সফলকাম হবে’। এই ঘোষণার সাথে সাথে আপন চাচা আবু লাহাব বলে উঠে, হে মুহাম্মদ! তুমি ধ্বংস হও (তাব্বান লাকা ইয়া মুহাম্মদ)। এই কালেমা একটা বিপ্লবাত্মক ঘোষণা। এই বাক্যটি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সকল স্বৈরশাসককে (তাগুত) অস্বীকার করা হয়। কুরআনের ভাষায়- তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও তাগুতকে অস্বীকার করো (আনিবুদুল্লাহ ওয়াজ- তানিবুত তাগুত)।

সকল নবি-রসুল মানুষের কাছে কালেমার দাওয়াত দান করেছেন এবং যারা কবুল করেছেন তাদেরকে সংগঠিত করেছেন। সংগঠিত এই জনশক্তিকে পরিশুদ্ধ করার কাজই মুহাম্মদ সা. করেছিলেন এবং সেটি করেছিলেন আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে। মানুষের আচার-আচরণ ও ব্যবহারিক জিন্দেগি সুন্দর করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ছোট্ট ছোট্ট সুরায় নানাভাবে আখেরাতের বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। কুরআনের মাধ্যমে পরিশুদ্ধি প্রসঙ্গে আল্লাহপাকের বাণী- ‘হে আমাদের রব! এদের (আমার বংশধর) কাছে এদের মধ্য থেকেই একজন রসুল পাঠাও, যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে (তোমার) কিতাব এবং হিকমা শিক্ষা দেবেন আর তাদেরকে পরিশুদ্ধ (তাজকিয়া) করবেন। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞানী’- সুরা বাকারা ১২৯। কিতাবের তালিম মানেই বুঝতে হবে কিতাবুল্লাহ (আল কুরআন) থেকে তাঁর আদেশ-নিষেধ মানুষের সামনে তুলে ধরা এবং তা মেনে চলার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।

যারা জান্নাতের প্রত্যাশী তাদেরও পথ একটিই- সংগঠিতভাবে মানুষের কাছে দীনের দাওয়াত তুলে ধরা। সংগঠিতভাবে জীবন-যাপনের তাগিদ আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা. নানাভাবে প্রদান করেছেন। নামাজটাই দলবদ্ধ জীবন-যাপনের বড়ো প্রশিক্ষণ। নামাজে মুক্তাদির কোনো কাজ নেই এবং তার কোনো ভুলও নেই। মুক্তাদির কাজ ইমামের আনুগত্য ও অনুসরণ করা। আনুগত্যের ক্ষেত্রে একটু অবহেলা তার নামাজ ধ্বংস করে দেয়। এই পথে চলার ক্ষেত্রে নবি-রসুলদের মতো বাধা-বিপত্তি আসবেই এবং সকল বাধা-বিপত্তি ও জুলুম-নির্যাতন মাড়িয়ে পরম ধৈর্যাবলম্বন করে টিকে থাকতে পারলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল গুনাহের ক্ষমা ও জান্নাতের প্রকাশ্য ঘোষণা রয়েছে এবং দুনিয়ার জীবনে রয়েছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় (সুরা সফ ১২-১৩)। হক ও বাতিলপন্থী চেনার সহজ উপায় হলো বাতিলের পক্ষ থেকে আসা জুলুম-নির্যাতন এবং যদি বাধা আসে তাহলে বোঝা যাবে তারা যথার্থই নবি- রসুলদের পথে রয়েছেন এবং তারাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহপাক মুসলিম উম্মাহকে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য দায়ী ইলাল্লাহ হিসেবে কবুল করুন। আমিন। ১৫.০১.২০২৩

Comments