আমরা যখন স্কুলে পড়তাম সেসময়ে আমাদের প্রায়ই ভাবসম্প্রসারণ আসতো ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’। হ্যাঁ, পরিশ্রম ছাড়া কোনো কিছুই অর্জন করা যায় না। অলস ও কর্মবিমুখ মানুষ জীবনে সফল হতে পারে না। জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। জাতিগতভাবে যারা পরিশ্রমী বিশ্বে তারাই প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানের অধিকারী। পরিশ্রমের দিক দিয়ে আমাদের তেমন সুনাম নেই। আমরা আবার ধনী হতে চাই এবং ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে সবসময় সহজপন্থা অবলম্বন করি। ঘুষ-দুর্নীতি, ধোকা-প্রতারণা ও আত্মসাতের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো জুড়ি নেই। অথচ আমরা এক বিশ্বাসী জাতি। আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি ও বিশ্বাস করি পরকালে এবং এটাও জানি সকল অনৈতিক কর্মকাণ্ড কবিরা গুনাহ। আমাদের ধর্মের শিক্ষা- উপার্জনের ক্ষেত্রে নৈতিকতার সামান্য বিচ্যুতি জুলুম এবং এর পরিণতি জাহান্নাম। জুমার দিনে আমাদের মসজিদগুলোয় মুসল্লি উপচে পড়ে, হজ ও ওমরাহে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের কোনো কার্পণ্য নেই। আমাদের তুরাগ নদীর তীরে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় তাবলিগের বিশ্বইস্তেমা যেটাকে আমরা গর্বভরে বলি- পবিত্র হজের পরে এতবড় বিশ্বসম্মেলন দ্বিতীয় আর নেই। আমাদের নেতা-নেত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষের সেখানে ঢল নামে। এসবই ইতিবাচক দিক। ইতিবাচক বলছি একারণেই যে এসব করি আমরা ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়েই। অর্থাৎ আমরা বিশ্বাসহারা হয়নি। আমাদের গলদটা কোথায়? ইতিবাচক কার্যক্রমের পাশাপাশি আমাদের রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি, অবিচার, জুলুম এবং ফলশ্রুতিতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রয়েছে চরম ভোগান্তি।
আঠারো কোটি জনমানুষের মাঝে খুব স্বল্পসংখ্যক উচ্চতর জীবন নির্বাহ করে; তাদের অধিকাংশের উপার্জনে স্বচ্ছতা নেই এবং রয়েছে খেয়ানতের অভিযোগ। খেয়ানত ভয়ঙ্কর অপরাধ। খেয়ানত ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ কোনো মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়। সে নিরেট মুনাফিক। কোনো আমলই তাকে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারে না। তওবা করে পরিশুদ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো সমাধান নেই। কোনো এক যুদ্ধের ময়দানে বীরদর্পে যুদ্ধ করে শহিদ হওয়ার পর তার সম্পর্কে রসুলুল্লাহ সা. বলেন, লোকটি জাহান্নামি। সাহাবয়ে কেরাম তাজ্জব হয়ে যান। শেষে দেখা গেল, তার মালসামানের মধ্যে গনিমতের মাল। যুদ্ধলব্ধ মাল (গনিমতের) রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের পক্ষে বন্টনের পরই কেউ মালিক হয়। রসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে যুদ্ধ করে শহিদ হওয়া সত্ত্বেও এতটুকু খেয়ানতের কারণে যদি জাহান্নামে যেতে হয় তাহলে আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাষ্ট্রীয় কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ যেভাবে খেয়ানত করে তাদের পরিণতি কী হবে? রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আমরা যখন কাউকে কোনো দায়িত্ব প্রদান করি তখন সে যদি এক টুকরো সূতা বা তার চেয়ে কোনো ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে তাহলে খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে। কিয়ামতের দিন দেখা যাবে কেউ অফিসের আসবাবপত্র ঘাড়ে করে দৌড়াচ্ছে, আবার কেউ আস্ত সেতু ঘাড়ে করে জাহান্নামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন- দুর্নীতি ছাড়া কি সম্পদশালী হওয়া সম্ভব? হ্যাঁ, খুব সম্ভব এবং সেটি সম্ভব পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামে কোনো বাধা নেই বরং আল্লাহপাক আমাদেরকে দোয়া শিখিয়েছেন- ‘প্রভু আমাদের! তুমি আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ দান করো’। সৎ পথে জীবনযাপনের মাঝে আল্লাহপাক অনেক বরকত রেখেছেন। নামাজ সমাপনান্তে রুজির জন্য আল্লাহ বেরিয়ে পড়তে বলেছেন এবং সে অবস্থায় বেশি বেশি করে তাঁকে স্মরণ করতে বলেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, খেত- খামার যেখানেই থাকুক না কেন সেখানে যদি আল্লাহকে স্মরণ ও ভয় করে চলা যায় তাহলে আর তার দ্বারা অন্যায় হওয়া সম্ভব নয় এবং তেমন হলে যথার্থই আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আল্লাহর ভয় ও স্মরণই মানুষকে হালাল উপার্জনে সন্তুষ্ট রাখে।
ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য বা সম্পদ বন্টনে বৈষম্যের পেছনে অন্যতম কারণ হলো অসৎ পথে আয় ও ব্যয় এবং এর ফলে একদিকে পাহাড় পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে একদল মানুষ চরম ভোগবিলাসে মত্ত, বিপরীতে মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র নিয়ে চরম কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করছে। হালাম উপার্জনে যারা ধনী হয় তাদের সম্পদে উপার্জনে অক্ষমদের হক আল্লাহ তায়ালা রেখে দিয়েছেন।
মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্য আল্লাহ বলেছেন, কতো জন্তু-জানোয়ার না এমন আছে যারা তাদের রিজিক বহন করে চলে না, আমিই তাদের রিজিক দেই। আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির রিজিকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং এজন্যই তাঁর এক গুণবাচক নাম রাজ্জাক। রিজিক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পরিশ্রম করাকে তিনি শর্ত করেছেন। পাখি, জন্তু-জানোয়ার বা নদী-নালা-সমুদ্রে বিচরণশীল মাছ বা জলজপ্রাণি সবাই পরিশ্রম করে যাচ্ছে এবং পরিশ্রমের বিনিময়ে তাদেরকে আল্লাহপাক রিজিক পৌঁছে দিচ্ছেন। হ্যাঁ, মানুষকেও পরিশ্রম করতে হবে। চেষ্টা-সাধনা ও পরিশ্রম তাকে অনেক উচ্চে তুলে ধরতে পারে। আল্লাহর ভাণ্ডার অফুরন্ত এবং তিনি কৃপণ নন, তিনি বেহিসেবি দিতে চান। তাঁর বাণী, ‘হে ইমানদার লোকেরা! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’- সুরা বাকারা ১৫৩। এখানে আল্লাহপাক সবর ও নামাজের কথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু নামাজিদের সাথে আছেন না বলে বলেছেন সবরকারিদের সাথে আছেন। দুনিয়ার জীবনে উন্নতি- সমৃদ্ধি তিনি উন্মুক্ত করে রেখেছেন। আল্লাহকে না মানলেও তিনি তাকে রিজিক দেন। রিজিক বন্টনের ক্ষেত্রে কাউকে বঞ্চিত করেন না। অবশ্য একজন ইমানদার আশা করতে পারে যে রিজিক পাওয়ার ক্ষেত্রে সে আল্লাহর বাড়তি কৃপা পাবে। এটি তার বিশ্বাস ও মনিবের প্রতি বিনয় এবং চাওয়ার প্রতিদান।
রিজিক বা অনুগ্রহ বহুমুখী। অর্থকড়ি ও খাদ্যখানার পাশাপাশি সন্তান-সন্ততি ও সুস্থতা এবং নাম-যশ-খ্যাতি ও সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি সবই আল্লাহর অনুগ্রহ ও রিজিক। সবকিছু প্রাপ্তির পেছনে রয়েছে পরিশ্রম। সুস্থ থাকার জন্যও শারীরিক পরিশ্রম অবশ্যম্ভাবী। অলসতার সাথে অসুস্থতার যোগসূত্র রয়েছে। শুধু দুনিয়ার জীবনে সুখ-শান্তির জন্য নয় আখেরাতে সুখ- শান্তির জন্য পরিশ্রম অপরিহার্য। মৌলিক ইবাদতসমূহ পালনের ক্ষেত্রেও পরিশ্রম প্রয়োজন। অলস ব্যক্তির পক্ষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সঠিক সময়ে জামাতে আদায় করা সহজ নয়। রমজান মাসে রোজা পালন, হজের মতো লম্বা সফর ও কঠিন আনুষ্ঠানিকতা সবই দাবি করে পরিশ্রম ও ধৈর্য। মনোজগত থেকে আলস্য ঝেড়ে ফেলে একজন অধ্যাবসায়ী ও পরম ধৈর্যশীল ব্যক্তিই লাভ করতে পারে দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্য। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে পরিশ্রমী ও ধৈর্যশীল হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন। ১৭.০১.২০২৩
Comments
Post a Comment