দারসুল কুরআন অধ্যয়ন করা কুরআন বুঝার জন্য জরুরি। এর মাধ্যমে সূরাটি নাজিলের প্রেক্ষাপট, ব্যাখ্যা ও শিক্ষা বুঝা যায়। দারসুল কুরআন নোট করে পড়লে কুরআন বুঝা সহজ হয়।
দারসুল কুরআন সূরা বাকারা ১৫৩
‘হে ঈমানদারগণ!
তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের
সাথে আছেন’- সূরা বাকারা
১৫৩
দারসুল কুরআন এর প্রথম ধাপ হচ্ছে শুদ্ধ তেলাওয়াত। অতপর সরল বাংলা অর্থ, নাজিলের প্রেক্ষাপট, ব্যাখ্যা ও শিক্ষা।
বিশ্বজাহানের
মালিক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন আল্লাহ। তাঁর ভান্ডার অফুরন্ত। সেই আল্লাহ তাঁর
বান্দাদের তাঁর কাছে চাওয়ার জন্য বলছেন এবং নিশ্চয়তা দিয়ে বলছেন তিনি তাঁর ধৈর্যশীল
বান্দাদের সাথে আছেন। প্রতিশ্রুতি পালনে তাঁর চেয়ে আর আর সত্যবাদী কেউ নেই।
এখানে
আল্লাহর কাছে চাওয়ার ক্ষেত্রে নামাযের কথা বলেছেন। অবশ্য বান্দাহ সকল সময়ে তাঁর মনিবের
কাছে তাঁর প্রয়োজন পেশ করবে এটিই স্বাভাবিক। চলতে ফিরতে সকল সময়ে বান্দার মুখ থেকে
উচ্চারিত হবে-‘আল্লাহ আমাকে সাহায্য করো, দয়া করো, অনুগ্রহ করো’।
রাস্তায়
বের হয়েছে সে তার রবের কাছে নিরাপত্তা চাইবে, পরীক্ষা হলে বসে আল্লাহর কাছে সাহায্য
চাইবে। মূলত এটিই হলো আল্লাহর স্মরণ। সর্বক্ষণ মনে করবে, ‘আমি আল্লাহর বান্দাহ
এবং তিনি আমার মনিব’। কোনো অবস্থায় যেন আল্লাহর নাফরমানি না
হয়ে যায় সেজন্য সে তটস্থ থাকবে।
নামায
মূলত যিকির। নামাযের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর খুব নিকটবর্তী হয়ে যায়। বিপদাপদ বা কোনো
সংকটে পড়লে রসুল (সা) নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। আল্লাহু আকবার বলে আমরা নামায শুরু করি
এবং সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামায সমাপ্ত করি।
এই
সময়ের মধ্যে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। বিশেষ করে সালাম ফেরানোর পূর্বে, দুই সেজদার মাঝখানে
এবং সেজদায় গিয়ে সকল চাওয়া আল্লাহর কাছে পেশ করতে হবে। মোনাজাত বা চাওয়ার বিষয়টি একান্তভাবে
আল্লাহ ও তাঁর বান্দার সাথে সম্পর্কিত।
মোনাজাত
অর্থ চুপি চুপি কথা বলা। বান্দাহ যখন একাকী সুন্নাত ও নফল নামাযে দন্ডায়মান হবে তখন
সে আল্লাহর সাথে কথা বলবে অর্থাৎ তার সকল প্রয়োজন পেশ করবে। মোনাজাত কবুল হওয়ার জন্য
হালাল রুজি শর্ত। আল্লাহপাক দেবেন-এই বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে এবং কোনো
মাধ্যমে নয় সরাসরি তাঁরই কাছে চাইতে হবে।
ধৈর্য
ও নামাযের মাধ্যমে চাওয়ার সাথে সাথে আল্লাহ বলেছেন তিনি ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। ধৈর্য
অর্থ কোনো কাজে লেগে থাকা, তাড়াহুড়া না করা, কাজে একাগ্র ও আন্তরিক হওয়া, প্রতিকূল
পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়া, মেজাজে ভারসাম্য বজায় রাখা, হাল ছেড়ে না দেয়া, হতাশ না
হওয়া ইত্যাদি গুণের সমষ্টি।
ধৈর্য
সাফল্যের চাবিকাঠি। জীবনে যারা সফল হয়েছে তাদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে অসীম ধৈর্য ও
ত্যাগ-তিতিক্ষা। হতে পারে সেটা খেলাধুলা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি,স্থুলদেহ বা হালকা-পাতলা
থেকে সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়া- সকল ক্ষেত্রে সবরের কোনো বিকল্প নেই।
আল্লাহকে
যে মানে না আল্লাহ তাকেও তার পরিশ্রমের মূল্য প্রদান করেন। অবশ্য সে আখিরাতে বঞ্চিত
হবে। আর মু’মিনকে আল্লাহ
দুনিয়া ও আখিরাত উভয় অবস্থায় দান করবেন। আল্লাহর বাণী-‘যে আল্লাহকে ভয়
করে চলে তাকে তিনি এমন অবস্থায় রিজিক দিবেন যা সে কল্পনাও করিনি’।
আসুন,
বান্দাহ হিসেবে আমরা সর্বাবস্থায় তাঁকে ভয় করে চলি এবং আমাদের সকল প্রয়োজন তাঁরই কাছে
পেশ করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
আশা করছি এই দারসুল কুরআন নোট থেকে কিছু শিখতে পেরেছেন। ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
দারসুল কুরআন সূরা ইনফিতার
‘‘যখন আকাশ ফেটে যাবে, যখন তারকাসমূহ চারদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে, যখন সমুদ্রসমূহ ফাটিয়ে ফেলা হবে, এবং যখন কবরগুলো খুলে ফেলা হবে, তখন প্রত্যেক ব্যক্তি তার সামনের ও পেছনের সবকিছু জেনে যাবে।
হে মানুষ! কোন্ জিনিস তোমাকে তোমার মহান রবের ব্যাপারে ধোঁকায় নিমজ্জিত করেছে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য করে গড়েছেন এবং যে আকৃতিতে চেয়েছেন তোমাকে গঠন করেছেন?
না, কখনো নয়, বরং (আসল কথা হচ্ছে এই যে) তোমরা শাস্তি ও পুরস্কারকে মিথ্যা মনে করছো। অথচ তোমাদের ওপর পরিদর্শক নিযুক্ত রয়েছে, এমন সম্মানিত লেখকবৃন্দ, যারা তোমাদের প্রত্যেকটি কাজ জানে।
নিশ্চয়ই নেক লোকেরা পরমানন্দে থাকবে আর পাপীরা অবশ্যি জাহান্নামে যাবে। কর্মফলের দিন তারা তার মধ্যে প্রবেশ করবে এবং সেখান থেকে কোনক্রমেই সরে পড়তে পারবে না।
আর তোমরা কি জানো, ঐ কর্মফল দিনটি কী? হ্যাঁ, তোমরা কি জানো, ঐ কর্মফল দিনটি কী? এটি সেই দিন যখন কারোর জন্য কোন কিছু করার সাধ্য কারোর থাকবে না। ফয়সালা সেদিন একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ারে থাকবে।’’ (সূরা আল ইনফিতার ১৯)
নামকরণ : প্রথম বাক্যের ইনফিতার শব্দটিকে নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, যার অর্থ ফেটে যাওয়া। সাধারণত অধিকাংশ সূরার মত এখানে চিহ্নস্বরূপ এই নামকরণ করা হয়েছে।
নাযিলের সময়কাল : মক্কী সূরা এবং প্রাথমিক অবস্থায় অবতীর্ণ। মক্কাবাসীদেরকে আখিরাত সম্পর্কে সচেতন করা প্রথম যুগের অবতীর্ণ সূরাসমূহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য : সূরাটির বিষয়বস্তু আখিরাত। হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত একটি হাদিস, ‘যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিনটি নিজের চোখে দেখতে চায় সে যেন সূরা তাকভীর, সূরা ইনফিতার ও সূরা ইনশিকাক পড়ে নেয়।’
এই সূরায় প্রথমে কিয়ামতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং সে সময়ে দুনিয়ায় কৃত ভালো ও মন্দ সকল কর্ম প্রত্যেকেই দেখবে। তারপর মানুষের সৃষ্টি এবং সকল সৃষ্টির মধ্যে অনন্য বৈশিষ্ট্য ও জ্ঞান-যোগ্যতা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বদানের পরও তার রবকে ভুলে থাকার কারণ যে আখিরাতে অবিশ^াস সেটি ব্যক্ত করা হয়েছে।
মানুষকে সতর্ক করে বলা হয়েছে যে, সম্মানিত লেখকবৃন্দ তার গতিবিধি, চালচলন ও কর্মকান্ড সব লিপিবদ্ধ করছেন এবং নেককারদের শুভ পরিণতি ও বদকারদের কঠিন শাস্তির কথা এই সূরায় বলা হয়েছে। সেদিনে কোন সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে না।
ব্যাখ্যা : প্রথম তিনটি আয়াতে কিয়ামত দিনের প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কুরআন মজিদে বিভিন্ন জায়গায় কিয়ামতের বর্ণনা রয়েছে। বর্তমানে যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার ভিত্তিতে এ বিশ্বজাহান পরিচালিত হচ্ছে, আল্লাহপাক নিজেই একদিন তা ভেঙ্গে দেবেন।
হাদিসে সিঙ্গায় তিনটি ফুৎকারের কথা বলা হয়েছে। প্রথম ফুৎকারে এক প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্প, তা কোন এক নির্দিষ্ট এলাকায় নয় সমগ্র বিশ্বব্যাপী সংঘটিত হবে। এখানে বলা হয়েছে যে আকাশ ফেটে যাবে, তারকাসমূহ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে এবং সমুদ্রসমূহ ফেটে যাব্ েকোথাও বলা হয়েছে সমুদ্রসমূহে আগুন জ¦লতে থাকবে।
কোথাও বলা হয়েছে পাহাড়সমূহ ধূলা পশমের মত উড়তে থাকবে। মোট কথা পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, খাল-বিল, সাগর-মহাসাগর সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এ জমীন এক সমতল ভূমিতে পরিণত হবে। মনে হবে যেন একটি দস্তরখানা বিছায়ে দেয়া হয়েছে।
পরবর্তী ফুৎকারে সব মানুষ কবর থেকে উঠে আসবে এবং সে তখন সামনের ও পেছনের ঘটে যাওয়া সকল কৃতকর্ম জানতে পারবে। অর্থাৎ সে তার জীবদ্দশায় ভালো-মন্দ যা করেছে তা যেমন জানতে পারবে তেমনি মৃত্যুর পরে তার রেখে আসা আমলের দ্বারা অন্যান্যরা প্রভাবিত হলে তারও ছওয়াব ও গুনাহের সে ভাগীদার হবে।
৬-১২ আয়াতে মানুষের সুন্দর গঠন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের সুসামঞ্জ্যকরণ ও বিভিন্ন আকৃতিতে সৃষ্টির বিষয় উল্লেখ করে তার মধ্যে সম্বিত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ময়ের গর্ভে পিতার শুক্রকীট নিক্ষেপ এবং ক্রমবিকাশের মাধ্যমে মানবশিশুর জন্ম আল্লাহর এক বিষ্ময়কর সৃষ্টি। মানবশিশুর বেড়ে উঠা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংযোজন, প্রাণের সঞ্চার আল্লাহর ইচ্ছার ফলেই সম্ভব হয়।
তারপর মানুষের আকার-আকৃতি, চেহারা, কন্ঠস্বর, এমন কী বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপের ভিন্নতাসহ প্রত্যেককে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি আল্লাহপাকের অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞারই পরিচায়ক। হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ এ দুনিয়ায় আসবে কারো সাথে কারো কোন মিল হবে না; সবাই স্বতন্ত্র দৈহিক কাঠামো, রুচি-পছন্দ নিয়ে এ পৃথিবীতে আগমন করবে-এ সব চিন্তা করলে আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত না হয়ে উপায় থাকে না।
কিন্তু মানুষ উল্টো তাঁর নাফরমানিতেই লিপ্ত রয়েছে। আল্লাহর ভাষায় এর মূলে কারণ একটিই এবং তা হলো আখিরাতের প্রতি অবিশ^াস। অথচ মানুষের ভালো-মন্দ সকল কাজই আল্লাহর নিযুক্ত ফেরেশতা কর্তৃক রেকর্ডভুক্ত হচ্ছে এবং তাঁরা হলেন সম্মানিত, অর্থাৎ তাঁরা এমন নন যে, কোন ধরনের পক্ষপাতিত্ব বা ঘুষ-দুর্নীতির বিনিময়ে মিথ্যা লেখার মত তাঁরা নন।
তাঁদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁরা দুনিয়ার সরকারসমূহের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের মত নন যারা হাজারো চেষ্টা করেও অনেক সময় প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হন। আল্লাহর ফেরেশ্তারা সকল বিষয়ে জ্ঞাত; কোন কিছুই তাঁদের অগোচরে নয়।
পৃথিবীতে মানুষের আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কর্মকান্ডে যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি আখিরাতে তাদের পরিণতিও ভিন্ন হবে। এখানে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করেছেন যে, বর্তমান দুনিয়ায় যারা নেক কাজ করবে তারা আখিরাতে পরমানন্দে থাকবে; পক্ষান্তরে পাপীদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ আযাব। যারা জাহান্নামে যাবে কখনই সেখান থেকে তারা সরে পড়তে পারবে না। সেদিনের অবস্থা ব্যাখ্যা করতে যেয়ে আল্লাহপাক বলেছেন, আখিরাতে কোন সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে না।
অতীতকালে মানুষের একটি ধারণা ছিল যে, নবী-রসূল বা আল্লাহর নেক বান্দারা বা তাদের উপাস্য দেবতারা সুপারিশ করে তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে দিবে। এ ভ্রান্তি বর্তমানেও রয়েছে, যার কারণে মানুষ বিভিন্ন মাজার ও দরবারে ঘুরাঘুরি করে। এখানে বলা হয়েছে, কারোর জন্য কোন কিছু করার সাধ্য কারোর থাকবে না। ফয়সালা সেদিন একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ারে থাকবে।
অবশ্য শিরকমিশ্রিত শাফায়াতের পরিবর্তে ইসলাম আমাদের সম্মুখে তাওহীদভিত্তিক সুপারিশের ধারণা প্রদান করেছে। সুপারিশ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার জন্য সুপারিশ পছন্দ করবেন কেবল তিনিই সুপারিশ করতে পারবেন। আল্লাহর ওপর প্রভাব বিস্তার করে বা সুপারিশের মাধ্যমে কাউকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে নেয়ার ক্ষমতা সেদিন কারো থাকবে না।
আল্লাহপাকের ক্ষমা করার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে সেদিন কিছু লোককে তিনি সুপারিশ করার সুযোগ দান করবেন (নবী-রসূল ও নেক বান্দারা) এবং এর মাধ্যমে তিনি তাঁর নেক বান্দাদের মর্যাদা উচ্চে তুলে ধরবেন ও কিছু গোনাহগার বান্দাকে শাস্তি থেকে রেহাই দান করবেন।
শিক্ষা : আখিরাতের প্রতি ঈমান আনায়নই এই সূরার মৌলিক শিক্ষা। সমাজে জুলুম-নির্যাতন ও নানাবিধ পাপাচারের মূল কারণ আখিরাতে অবিশ্বাস। প্রথমত কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে; এরপর মানুষের সৃষ্টি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন যে, আল্লাহর নাফরমানির পেছনে পরকাল অবিশ্বাস ছাড়া আর কোন কারণ নেই।
আল্লাহপাক আমাদেরকে পরকাল বিশ্বাসের মাধ্যমে সকল পাপাচার থেকে মুক্ত থেকে নেক আমল করার তাওফিক দান করুন।
দারসুল কুরআন নোট থেকে দর্শকের সামনে দারস পেশ করার অভ্যাস করুন।
দারসুল কুরআন সূরা আল মুতাফফিফীন
‘‘ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, আর যখন মানুষের কাছ থেকে নেয়, তখন পুরোপুরি নেয়। আর যখন নিজেরা ওজন বা পরিমাপ করে তখন কম দেয়।
এরা কি ভাবে না (বিচারের জন্যে) তাদের (একদিন কবর থেকে) তুলে আনা হবে? (আনা হবে) এক বড় দিবসের জন্যে, যেদিন সব মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।
কখনো না, গুনাহগারদের আমলনামা থাকবে ‘সিজ্জীনে’; তুমি কি জানো সিজ্জীনটা কী?
এটা একটা লিখিত কিতাব। যারা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়, সেদিন তাদের জন্য ধ্বংস অবধারিত। যারা শেষ বিচারের দিনটিকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে। আর সীমালঙ্ঘনকারী পাপী ছাড়া অন্য কেউ সে দিনটিকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয় না।
যখন তার সামনে আমার আয়াত পড়ে শোনানো হয় তখন সে বলে, এগুলো হচ্ছে নিছক আগের কালের গল্পগাথা; কখনো নয়, বরং এদের কৃতকর্ম এদের মনের ওপর ঝং ধরিয়ে রেখেছে।
কখনো নয়, অবশ্যই এসব পাপীদের সেদিন তাদের মালিকের দীদার থেকে মাহরুম রাখা হবে। অতঃপর তারা অবশ্যই জাহান্নামের আগুনে গিয়ে প্রবেশ করবে; তখন তাদেরকে বলা হবে, এটা ঐ জিনিস, যাকে তোমরা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে।
কক্ষণই নয়, অবশ্যই নেক লোকদের আমলনামা উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন লোকদের দফতরে রয়েছে। আর তোমরা কি জানো, এ উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন লোকদের দফতরটি কী?
এটি একটি লিখিত কিতাব। নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতারা এর দেখাশুনা করে। নিঃসন্দেহে নেক লোকেরা থাকবে বড়ই আনন্দে। উঁচু আসনে বসে দেখতে থাকবে। তাদের চেহারায় তোমরা স্বচ্ছলতার দীপ্তি অনুভব করবে। তাদেরকে মোহর করা বিশুদ্ধতম শরাব পান করানো হবে। তার ওপর মিশক-এর মোহর থাকবে।
যারা অন্যদের ওপর প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে চায় তারা যেন এ জিনিসটি হাসিল করার জন্য প্রতিযোগিতায় জয়ী হবার চেষ্টা করে। সে শরাবে তাসনীমের মিশ্রণ থাকবে। এটি একটি ঝরণা, নৈকট্যলাভকারীরা এর পানির সাথে শরাব পান করবে।
অপরাধীরা দুনিয়াতে ঈমানদারদের বিদ্রুপ করতো। তাদের কাছ দিয়ে যাবার সময় চোখ টিপে তাদের দিকে ইশারা করতো। নিজেদের ঘরের দিকে ফেরার সময় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ফিরতো। আর তাদেরকে দেখলে বলতো, এরা হচ্ছে পথভ্রষ্ট। অথচ তাদেরকে এদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়নি।
আজ ঈমানদাররা কাফেরদের ওপর হাসছে। সুসজ্জিত আসনে বসে তাদের অবস্থা দেখছে। কাফেররা তাদের কৃতকর্মের সওয়াব পেয়ে গেলো তো?’’ (সূরা আল মুতাফ্ফিফীন ১-৩৬)
নামকরণ : বাক্যে উল্লেখিত মুতাফ্ফিফীন শব্দকেই নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
নাযিলের সময়কাল : বর্ণনাভঙ্গি থেকে বোঝা যায় যে, মক্কীযুগের প্রাথমিক অবস্থায় সূরাটি অবতীর্ণ। মুসলমানদের প্রতি নিপীড়ন-নির্যাতন তখনও শুরু হয়নি। হাসি-ঠাট্টা-টিটকারী পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল। সূরার শেষের দিকের আয়াতসমূহে সেটিই বলা হয়েছে। কাফিররা মু’মিনদের দেখলে বিদ্রুপ করতো, চোখ টিপে হাসতো।
বিষয়বস্তু : মক্কী যুগে অবতীর্ণ সূরাসমূহে বেশি বেশি করে আখিরাতের প্রসঙ্গ এবং মানুষের নৈতিক ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আখিরাত অবিশ্বাসের ফলে মানুষের মধ্যে যে সব দোষ-ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় নমুনাস্বরূপ এখানে একটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ওজনে কম-বেশি করার মধ্য দিয়ে মানুষকে ঠকানো তৎকালিন সমাজের একটি বড় ধরনের ত্রুটি ছিল। সঠিক পাল্লায় ওজন করে দেয়া ও মাপে পূর্ণ করে দেয়ার কথা কুরআন মজিদে আরো অনেক জায়গায় বলা হয়েছে।
হযরত শোয়াঈব (আ)-এর জাতির মাঝে ওজনে কারচুপি করার দোষ মারাত্মকভাবে দেখা দিলে নবী বারবার সতর্ক করার পরও ফিরে না আসায় সে জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১-৬ আয়াতে এ প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে।
পরবর্তী ৭-১৭ আয়াত পর্যন্ত অবিশ্বাসীদের কালো তালিকাভূক্ত হওয়া এবং তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে। তৎপরবর্তী ১৮-২৮ আয়াতে মু’মিনদের শুভ পরিণতি প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে তাদের আমলনামা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন লোকদের রেজিস্টারে সন্নিবেশিত করা হচ্ছে।
পরিশেষে অবিশ্বাসীদেরকে সতর্ক ও মু’মিনদেরকে শান্তনা দিয়ে বলা হয়েছে যে আজ কাফিররা মুমিনদেরকে লাঞ্চিত-অপমানিত করছে ও তাদের প্রতি বিদ্রুপ করছে; এই আচরণের পরিণতি হিসেবে আখিরাতে তারা অপরাধী হিসেবে উত্থিত হবে ও ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হবে এবং মু’মিনরা কাফিরদের খারাপ পরিণতি দেখে তাদের চোখকে শীতল করবে।
ব্যাখ্যা : আরবী ভাষায় তাফীফ ছোট্ট, তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসকে বলা হয়। যারা ওজনে কারচুপি করে তারা বড় ধরনের কোন চুরি করে না বরং হাত সাফাইয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক ক্রেতার কাছ থেকে অল্প অল্প করে চুরি করে। ইসলাম সামাজিক জীবনকে অনেক বড় করে দেখে। বিক্রেতার কাছে ক্রেতার হক হলো সঠিক পাল্লায় সঠিকভাবে পরিমাপ করে দেয়া। সেখানে ওজনে কারচুপি করা, ভেজাল দেয়া বা কোন ধরনের ধোকা-প্রতারণার মাধ্যমে ক্রেতাকে ঠকানো তার অধিকারহরণ এবং ইসলামের দৃুষ্টিতে কবিরা গুনাহ।
মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান সবই পবিত্র; কোন না কোনভাবে তা ক্ষুণ্ন করা বড় ধরনের অপরাধ এবং আখিরাতে অবিশ্বাসীদের ফলশ্রুতি বলে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। এখানে শুরুই করা হয়েছে ‘তাদের ধ্বংস’ বলে, যারা ওজনে কম দেয়। এটা শুধু দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে নেয়া-দেয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়।
কোন মজুর তার মালিকের কাছ থেকে পুরো পারিশ্রমিক গ্রহণ করে তার মালিককে যদি কাজের ক্ষেত্রে ফাকি দেয় তাহলেও তার ধ্বংস অনিবার্য। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারের কাছ থেকে পুরো বেতন-ভাতা গ্রহণ করে সেবাদানের ক্ষেত্রে গাফেলতি করলে সেও হীন ঠকবাজদের পর্যায়ভুক্ত হবে। আখিরাতে আল্লাহর সম্মুখে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এমন বিশ্বাসী কারো পক্ষে ওজনে কম দেয়া বা মানুষকে ঠকানো কখনই সম্ভব নয়।
যে সব কারণে আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অধিকার হরণ-তা আল্লাহর হোক বা বান্দার হোক। তাই ওজনে কম-বেশি করার ক্ষেত্রে আখিরাতে বিশ্বাস-অবিশ্বাস বিশেষভাবে সম্পর্কিত এবং কোন বিশ্বাসী বান্দার পক্ষে ওজনে কারচুপি করা বা মানুষকে ঠকানো কখনই সম্ভব নয়।
পাপী-গুনাহগারদের আমলনামা সংরক্ষিত থাকবে সিজ্জিনে। এ শব্দটি এসেছে সিজন থেকে। সিজন অর্থ জেলখানা বা কয়েদখানা। বোঝা যায় এমন একটি রেজিস্টার যেখানে শাস্তিযোগ্য লোকদের আমলনামা লেখা হচ্ছে। আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাস কোন সাধারণ ব্যাপার নয়; আল্লাহ তায়ালার ভাষায় কেবল সীমালঙ্ঘনকারী পাপীরাই অবিশ্বাস করে।
কুরআনের মত এত উচ্চাঙ্গের ও নির্ভুল জীবন-যাপনের বিধানও তাদের কাছে মূল্য বহন করে না। বরং তারা নানাভাবে বিদ্রুপ করে এবং বলে যে আগের কালের লোকদের কিচ্ছা-কাহিনী বৈ আর কিছু নয়। আসলে পুনঃ পুনঃ গুনাহের কারণে তাদের অন্তরে মরিচা পড়েছে।
রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, বান্দাহ যখন গুনাহ করে তখন তার দিলে কালো দাগ পড়ে এবং সে যখন তাওবা করে তখন তা মিটে যায়। কিন্তু বারবার যখন গুনাহ করতে থাকে তখন তার দিলে মরিচা ধরে এবং এমতাবস্থায় ভালো কথা শোনার যোগ্যতা সে হারিয়ে ফেলে।
আখিরাতে আল্লাহর দিদার লাভ হবে বান্দার জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এবং এ সৌভাগ্য হবে কেবল ঈমানদারদের জন্য। অবিশ্বাসীরা আল্লাহর দিদার লাভ থেকে হবে বঞ্চিত এবং তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম যেটাকে তারা অবিশ্বাস করে থাকে।
‘কক্ষণই নয়’ বলে এখানে অপরাধীদের ধারণা-বিশ্বাসের প্রতিবাদ করা হয়েছে। এ দুনিয়ায় কৃত ভালো-মন্দ কাজের ফলভোগ করতে হবে-এমন বিশ্বাস না থাকার কারণেই মূলত অপরাধীদের বলগাহীন জীবন-যাপন এবং সমাজে যুলুম-নির্যাতন ও নানাবিধ পাপাচার। আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যারা সৎ জীবনযাপন করে তাদের অবস্থা হবে অপরাধীদের একেবারেই বিপরীত।
মানুষের আমলনামা সংরক্ষণ ও তাদের তালিকাভুক্তির বিষয়ে দু’টি দফতর রয়েছে। একটি অপরাধীদের ও অন্যটি নেককারদের। উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন লোকদের জন্য সংরক্ষিত দফতরে সকল নেক বান্দাদের আমলনামা সংরক্ষিত থাকবে এবং সেটা দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করছেন আল্লাহর নৈকট্যলাভকারী সম্মানিত ফেরেশতারা। এটা মূলত ঈমানদারদের একটি মর্যাদা।
এ দুনিয়ায় বিশ্বাস ও নেক আমলের বিনিময়ে ঈমানদাররা জান্নাতে অফুরন্ত নেয়ামত ভোগ করবেন। জান্নাতে সুখভোগের নানা বর্ণনা কুরআন মজিদে পেশ করা হয়েছে। সেখানে ঈমানদারদের যা দেয়া হবে তা এ দুনিয়ায় থেকে কল্পনা করাও কঠিন।
তারপরও নানা স্থানে নানাভাবে তার বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। তারা বড় আনন্দ-ফুর্তিতে থাকবে এবং উঁচু আসনে বসে আল্লাহর নেয়ামতরাজি অবলোকন করবে। আরাম কেদারায় আয়েশী ভঙ্গিতে দর্শন একজন সুখি লোকের পরিচায়ক এবং ঈমানদাররা সেদিন সেটিই করবেন। সেদিন ঈমানদারদের চেহারায় থাকবে আনন্দ-খুশির ঝলক।
শরাব যা নেশার উদ্রেগ করে এ দুনিয়ার জীবনে এক শ্রেণির মানুষের খুবই প্রিয়। ছিপি খোলার সাথে সাথে বিকট গন্ধ এবং পান করার সময়ও পচা গন্ধ অনুভূত হয়। কিন্তু সেদিন ঈমানদারদেরকে যে শরাব পান করানো হবে তা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তা হবে উৎকৃষ্টমানের পানীয়। সাধারণ ছিপি নয়, তার ওপর মিশকের মোহর থাকবে। উপর থেকে নেমে আসা ঝর্ণার পানির সাথে শরাবও তাদেরকে পান করতে দেয়া হবে।
মানুষ এ দুনিয়ায় বৈষয়িক উন্নতি (অর্থবৃত্ত, মান-ইজ্জত-সম্মান-কর্তৃত্ব) লাভের জন্য প্রতিযোগিতা করে থাকে; এখানে আল্লাহপাক আখেরাতের নেয়ামত লাভের জন্য দুনিয়ায় থাকতে প্রতিযোগিতা করার জন্য আহবান জানিয়েছেন।
এ পৃথিবীতে যারা নাস্তিক তারা নিজেদেরকে খুব বুদ্ধিমান ও চালাক মনে করে। আখিরাতে বিশ্বাসের কারণে স্বাভাবিকভাবে ঈমানদাররা দুনিয়ার জীবনে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা ও ভোগ-বিলাস থেকে দূরে থাকে। ঈমানদারদের বিশ্বাস ও নৈতিকতাভিত্তিক আচরণকে তারা নির্বুদ্ধিতা বলে মনে করে।
তাই তারা ঈমানদারদেরকে নানাভাবে বিদ্রুপ-কটাক্ষ করে। সুযোগ পেলেই দু’চার কথা শুনিয়ে দেয়। চলার পথে তাদেরকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে চোখ টিপে হাসে ও বন্ধুদের কাছ থেকে বাহবা নেয়ার জন্য বলে অমুক নাদানকে আচ্ছা করে জব্দ করে এসেছি; আক্কেল থাকলে আর এ পথে অগ্রসর হবে না।
ঈমানদারদের সৎ পথে চলার মাধ্যমে অভাব-অনটনে থাকা, ঈমানের পথে বিপদাপদকে বরণ করে নেয়াকে বোকামী এবং আখিরাতের বেহেশত-দোযখে বিশ্বাসকে তারা মনে করে যে এরা বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট। আল্লাহর জিজ্ঞাসা কে বিভ্রান্ত ও কে সঠিক-এ বলার অধিকার তাদেরকে কে দিয়েছে? তাদেরকে তো আর ঈমানদারদের তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়নি।
আখিরাতে আল্লাহপাক ঈমানদারদেরকে তাদের বিশ্বাস ও নেক আমলের পূর্ণ প্রতিদান প্রদান করবেন এবং প্রতিদান পেয়ে তারা মহা খুশি হয়ে যাবে। সাথে সাথে কাফিরদের দুরবস্থা ও সকল যুলুমের বদলা পূর্ণমাত্রায় পেয়ে জাহান্নামের শাস্তিভোগ দেখে তারা হাসতে থাকবে। জান্নাতের ব্যালকনিতে আরামকেদারায় বসে ঈমানদাররা পাপীদের শাস্তিভোগ দেখার সাথে সাথে বলবে- ‘তোমরা তোমাদের কাজের বদলা পেয়েছ তো?’ যা তাদের জন্য হবে বড় অপমানজনক ও কষ্টদায়ক।
শিক্ষা : এই সূরাটি আখিরাতে বিশ্বাসকেন্দ্রিক। আখিরাতে অবিশ্বাসের ফলে মানুষের মধ্যে যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেয় প্রথমের দিকে দৃষ্টান্তস্বরূপ ওজনে কমবেশি করার কথা বলা হয়েছে। নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় নেবে, অথচ দেয়ার সময় কম দেবে-নৈতিক দিক দিয়ে বড় ধরনের ত্রুটি যা সমাজে সর্বত্রই দৃষ্টিগোচর হয়। আজকে অফিস-আদালত সর্বত্রই বেতন প্রাপ্তির সাথে ঘুষ-দুর্নীতির সয়লাব বয়ে চলেছে।
এরা পূর্ণমাত্রায় বেতন ও সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে, অথচ বিনিময়ে জনগণকে সেবাদানে কার্পণ্য করছে। এর মূলে রয়েছে আখিরাতে বিশ্বাসের দুর্বলতা। আখিরাতে বিশ্বাসী সবারই আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থাকা উচিৎ। এখানে আখিরাতের যে চিত্র অংকন করা হয়েছে তাতে পাপীদের ভয়াবহ শাস্তি ও ঈমানদারদের মহা সুখ-স্বাচ্ছন্দের কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতই আখিরাতে বিশ্বাসীদের জীবনচরিত্র পাল্টে যেতে বাধ্য।
আল্লাহপাক তাঁর দেয়া নেয়ামত ভোগের জন্য তাঁর বান্দাদেরকে প্রতিযোগিতা করার আহবান জানিয়েছেন। প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে আল্লাহর পথে এগিয়ে যাওয়ার তাওফিক আমাদেরকে দান করুন।
দারসুল কুরআন সূরা হামিম আস সাজদা ৩৩-৩৬
‘‘তার চেয়ে ভালো কথা আর কার হতে পারে যে ব্যক্তি মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে নেক আমল করে এবং বলে যে, আমি একজন মুসলমান।
হে নবী ! ভালো ও মন্দ কখনো এক নয়। তুমি মন্দকে দূর কর সেই ভালো দ্বারা যা অতীব উত্তম। তাহলে দেখবে তোমার জানের দুশমনরা প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে।
এ গুণ কেবল তারাই লাভ করতে পারে যারা অতীব ধৈর্যশীল। এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা কেউ লাভ করতে পারে না। যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোন প্ররোচনা অনুভব কর তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর। তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন।’’
রসূল (সা.)-এর মক্কাজীবনের এমন একটি অধ্যায়ে অবতীর্ণ এই সূরা যখন চরম বিপদ-মুছিবত মুসলমানদের উপর আপতিত হচ্ছিল। মক্কায় টিকতে না পেরে অনেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন।
মুসলমানদেরকে শান্তনা দেয়ার সাথে সাথে সেই কঠিন মুহূর্তে তাদের করণীয়ও বলে দেয়া হয়েছে। ঠিক আগের আয়াতে ঈমানদারদের সাহায্যে ফেরেশ্তার আগমন ও জান্নাতের সুসংবাদ শোনানো হয়েছে।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ একান্তভাবে আল্লাহর এবং যারা এ কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকে তারা মূলত আল্লাহর সাহায্যকারী ও প্রতিনিধি। ফলে আল্লাহর দেখানো পথেই মু’মিনদেরকে অগ্রসর হতে হবে। ঈমান এনে নিজে নেক আমল করা নিঃসন্দেহে অতি উত্তম কাজ। নেক আমলের সাথে সাথে যারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে তাদের মর্যাদা অতি উচ্চে।
সে সময়ে নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়া অর্থই হলো হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের সামনে নিজেকে পেশ করা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামপন্থীদের অবস্থাও তেমনই। কলেজ-ইউনিভার্সিটি, মেস ও বাসাবাড়ী কোথাও তারা নিরাপদ নয়।
চারিত্রিক দিক দিয়ে এরা অন্য যে কোন দলের যেয়ে অনেক উন্নত-আচার-আচরণ ও লেন-দেনে তারা সবার চেয়ে সেরা; নামাজী এবং সকল ধরনের নেশামুক্ত। এ সব তরুণদের অপরাধ একটাই যে, ওরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে।
মক্কার সেই কঠিন অবস্থায় আল্লাহর রসূল (সা.) ও তাঁর সাথীদের সাথে আরবের কাফির-মুশরিকরা ভদ্রতা ও শালিনতার সব সীমা লঙ্ঘন করে অত্যন্ত নোংরা আচরণ করতো। মিথ্যা অপপ্রচার, অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ, শারীরিক নির্যাতন ও হত্যা পর্যন্ত করতে তারা পিছপা হত না; এমন কি তাদের জুলুম-নির্যাতন থেকে নারিরা পর্যন্ত রেহাই পেত না। সুমাইয়া (রা.) প্রথম শহীদের মর্যাদা লাভ করেন।
এমতাবস্থায় তাদের এই মন্দ আচরণের জবাব মন্দভাবে তো নয়ই বরং অতি উত্তমভাবে দেয়ার জন্য আল্লাহ বলেছেন। অর্থাৎ শুধু ক্ষমা করা বা উপেক্ষা করাই নয়, বরং তাদের কল্যাণ করার কোন সুযোগ পেলে তা করার জন্য তিনি বলেছেন। তাতে ফল হবে এই যে, যারা ইসলামের বিরোধীতার কারণে প্রচন্ড শত্রু হয়ে পড়েছিল তারা আবার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে।
অবশ্য এ কাজটা এত সহজ নয়। আল্লাহ নিজেই স্বীকার করে বলেছেন যে, এমন আচরণ কেবল তারাই করতে পারে যারা পরম ধৈর্যশীল ও অতি ভাগ্যবান। আল্লাহতায়ালা তাঁর পক্ষে দায়িত্ব পালনকারী নেক বান্দাহদের কত উচ্চমানের দেখতে চান এ আয়াত থেকে তা উপলব্ধি করা যায়।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা মন্দের জবাবে যখন নীরবতা অবলম্বন বা উত্তমভাবে দেয়ার চেষ্টা করে তখন শয়তান অস্থির হয়ে পড়ে। ‘তোমরা কি ভীরু কাপুরুষ হয়ে গেলে? ওরা পাঁচটা মারলে তোমরা একটাও পারো না! রাজনীতির ময়দান তোমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল!’
এমন হাজারো প্রচারণা শোনা যায়। শয়তান চায় ইসলামের দুশমনরা যে সীমালঙ্ঘন বা অনৈতিক কাজ করে, ঈমানদারেরাও যেন তাই করে বসে।
সর্বকালে সর্বযুগে শয়তানের অনুচররা মিথ্যা প্রচারণায় শীর্ষে ছিল এবং এখনো আছে। পরকাল অবিশ্বাসের কারণে মিথ্যা বলতে তাদের বাধা নেই। আল্লাহর রসূল (সা.) নিজেও মিথ্যা প্রচারণার শিকার হয়েছিলেন। তা আজও অব্যাহত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। শয়তানেরই এক শীষ্য গোয়েবলস-এর উক্তি :‘একটা মিথ্যা বারবার বললে তা সত্যে পরিণত হয়’।
ইসলামের দুশমনরা এই কৌশল অবলম্বন করে জয়যুক্ত হতে চায়। তবে মু’মিনদের শান্তনা এই যে, তাদের সাথে যা করা হচ্ছে তাদের মনিব মহান আল্লাহর তা অজানা নয়। তিনি সবকিছু জানেন, শোনেন ও দেখেন এবং কেউ তাঁর নাগালের বাইরে নয়।
তাই বদলা গ্রহণের চিন্তা বাদ দিয়ে ইসলামের শত্রুদেরকে আল্লাহর উপর সোপর্দ করে মু’মিনদের ঝামেলামুক্ত হয়ে যেতে হবে। মু’মিনদের অভিভাবক আল্লাহ এবং তিনিই যথেষ্ট। ০৭/১১/২০১৫
Comments
Post a Comment