বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, সুপ্রিয় শিক্ষকমন্ডলী ও অভিভাবকবৃন্দ এবং আমার স্নেহের শিক্ষার্থীরা। আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
আমি প্রথমেই অভিনন্দন জানাই সে সব কৃতি শিক্ষার্থীদেরকে যারা পিইসি ও জেএসসিতে বৃত্তিলাভ করেছে এবং সাথে সাথে তাদের পিতা-মাতা ও শিক্ষকমন্ডলীকে। ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকের সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই কেবল ভালো ফলাফল সম্ভব। সকলেরই চেষ্টা-সাধনায় এই ফলাফল। লেখাপড়ার কাজটি মোটেই সুখকর নয়। মাথার ওপরে ফ্যানের বাতাস ও চেয়ার-টেবিলে বসে লেখাপড়া করাটাকে বাহ্যিকভাবে বড় আরামদায়ক মনে হলেও কিন্তু তা নয়। তাই দেখা যায় লেখাপড়ার পরিবর্তে কোন কষ্টকর কাজ দিলে অনেক শিক্ষার্থী সেই কাজটি স্বতস্ফুর্তভাবে করে থাকে। লেখাপড়া করতে হলে জীবনে অনেক আরাম-আয়েশ ত্যাগ করতে হয়। কষ্ট সহ্য করতে না পারায় অনেকে মাঝপথে ঝরে পড়ে। দার্শনিক এরিস্টলের কথা যথার্থই ‘শিক্ষার শেকড়ের স্বাদ তেতো হলেও এর ফল মিষ্ট’। তাই যারা কষ্ট করে লেখাপড়া করে তারাই সফলকাম হয়। জীবনে সুখী হওয়ার জন্য জ্ঞান-বুদ্ধি প্রয়োজন। বুদ্ধিমানরাই জীবনে সুখ খুঁজে পেতে পারে। আর বুদ্ধি বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। এ প্রসঙ্গে আমরা বাট্রান্ড রাসেল-এর কথা স্মরণ করতে পারি-‘মানুষের সুখী হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার বুদ্ধির-এবং শিক্ষার মাধ্যমে এর বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব’। তাই আমি আমার স্নেহাষ্পদ শিক্ষার্থীদেরকে আহবান জানাবো বেশি বেশি করে পড়াশুনা করার জন্য। আজকাল মোবাইলে আসক্তি আমাদের তরুণ সমাজকে লেখাপড়া বিমুখ করে দিচ্ছে। তাই তোমাদেরকে মোবাইলে গেমখেলা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং আমি বিশ্বাস করি তোমরা বিরত ছিলে বলেই আজ এই সফলতা। তুমি বারবার চেষ্টা করো এবং তাতে ইনশা-আল্লাহ তুমি সফল হবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পরিশ্রমকে বৃথা যেতে দেন না। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন মেন্ডেলার উক্তিটা আমরা উল্লেখ করতে পারি-‘তুমি আমাকে আমার সাফল্য দিয়ে বিচার করো না, বরং বিবেচনা করো কতবার আমি ব্যর্থ হয়েছি কিন্তু আবার উঠে দাঁড়িয়েছি।’ এবারে যারা বৃত্তি পায়নি আগামীতে তারা পাবেনা-এটা কখনই মনে করো না। তোমরা যদি এখন থেকে নেলসন মেন্ডেলার মতে উঠে দাঁড়াও তাহলে আগামীতে ঠিকই পাবে। তোমাদের এই ভালো ফলাফলের পেছনে তোমাদের মা-বাবার অনেক কষ্ট ও অর্থব্যয় রয়েছে। নিজেদের কল্যাণ ও মা-বাবার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তোমাদেরকে একটু বাড়তি পরিশ্রম করতেই হবে। একটি শ্লোগান-‘আমি পারলেই মা জিতে যান।’ হ্যাঁ, এর মধ্যে সত্যতা রয়েছে। সন্তানকে নিয়েই মা-বাবার যত গর্ব ও আত্মতুষ্টি। আমি আমার কথাও একটু বলতে চাই। আমিও তোমাদের মত জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। আমার মনে পড়ে আমার আব্বা-আম্মা সে সময়ে আমার স্কুলের সকল শিক্ষককে বাড়িতে খাসি জবেহ করে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সে সময়ে আমরা মাসিক ৩৫/- টাকা করে বৃত্তি পেতাম এবং তা বেশ যথেষ্ট ছিল।
সম্মানিত অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, মা-বাবার জন্য আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে বড় নেয়ামত হলো সন্তান। আমরা আমাদের সন্তানদের মাঝেই বেঁচে থাকতে চাই। এই সন্তান যদি ভালো হয়, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাহলে ওরা আমাদের চোখকে শীতল করে, আমরা আনন্দিত হই; আর সন্তান যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে মা-বাবার কষ্টের সীমা-পরিসীমা থাকে না। আমরা ঐশীর কথা জানি। বড় আদরের মেয়ে। কিন্তু সেই আদরের মেয়েই নিজ হাতে আপন পিতা-মাতাকে হত্যা করে। এক ঐশী নয়, এমন হাজারো ঐশী রয়েছে যাদের কারণে বাবা-মা আজ অতিষ্ঠ, বাবা-মা আর সেই সন্তানের জন্য দোয়া করেন না। এ জন্য একাডেমিক লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের নৈতিক শিক্ষার প্রতিও সমভাবে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। নৈতিকতার উৎস হলো ধর্মীয় মূল্যবোধ। রসূল (সা) বলেছেন-‘উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেয়ার চেয়ে পিতা-মাতার পক্ষে সন্তানকে বড় কিছু দেয়ার নেই।’ আমি অভিভাবকদেরকে অনুরোধ করবো আপনার সন্তানদেরকে নামাযে অভ্যস্তকরণ ও কুরআনের কিছু জ্ঞান দানের জন্য। আল্লাহর বাণী-‘নিশ্চয়ই নামায মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে।’ যে ছেলে-মেয়ের মধ্যে কুরআনের জ্ঞান রয়েছে ও নামায আদায় করে সে ছেলে-মেয়ে অবশ্যই ভদ্র-নম্র ও পিতা-মাতার অনুগত হয়। আপনি আপনার সন্তানের জন্য বন্ধু হয়ে যান, তাকে প্রচুর সময় দেন এবং একসঙ্গে খানাপিনা ও গল্পগুজব করেন। কারণে-অকারণে মারপিট ও ঝগড়া-ঝাটি পরিহার করে চলুন। বর্তমান সময়ের শ্লোগানই হলো-‘বাচ্চাদের শুধু হ্যাঁ বলুন।’ আমাদের রসূল (সা)-এর প্রতি একটু দৃষ্টি দেন দেখি। রসূল (সা) সেজদায় গেলে তাঁর দুই নাতি নানাকে ঘোড়া বানায়ে খেলা করতো। আর রসূল (সা) বিরক্ত না হয়ে সেজদাটাকে আর একটু লম্বা করতেন। বাচ্চারা একটু হৈ-হুল্লোড়, ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি করবে এবং এটাই স্বাভাবিক। একটি সদ্যজাত শিশু যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ হাত-পা ছুঁড়ে এবং এটি তার সুস্থতারই লক্ষণ। তাই তাদের সাথে নম্র ব্যবহার করুন। সন্তানকে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখান, তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেন। ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মরহুম এপিজে আব্দুল কালাম কত সুন্দরভাবেই না বলেছেন-‘স্বপ্ন বাস্তবায়ন না পর্যন্ত তোমাকে স্বপ্ন দেখতে হবে। আর স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন হলো সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।’ আমাদের সন্তানদের মনে যদি প্রেরণা-উদ্দীপনা জাগাতে পারি তাহলে তারা নিজের থেকেই সচেষ্ট হয়ে উঠবে। সন্তানকে বাসায় লেখাপড়ার উপযুক্ত পরিবেশ করে দিতে হবে। বাবা-মা সর্বক্ষণ টেলিভিশনের সম্মুখে থাকলে সন্তানের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হ্রাস পাবে। বরং একটি নির্দিষ্ট সময় করে সন্তানসহ একত্রে টেলিভিশনের সম্মুখে বসেন। টেলিভিশনে মন্দের পাশাপাশি ভালোও অনেক কিছু রয়েছে। আর আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যেন সম্পর্কটা মধুর হয় এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে। সন্তানের সম্মুখে কখনই একে অপরের দোষ-ত্রুটি উচ্চারণ করবেন না, তাহলে আপনাদের প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হবে। আর আপনারাও মুরুব্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন করে সন্তানকে শিখিয়ে দেন।
আমি আমার সুপ্রিয় শিক্ষকদেরকে বলতে চাই যে, শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। আমাদের প্রিয়তম নবী (সা) বলেন-‘আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।’ শিক্ষকরা হলেন নবী (সা)-এর উত্তরাধিার। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদেরকে এখানে পাঠিয়েছেন। তারা আমাদের কাছে আমানত। নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে তাদের গড়ে তোলা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ ব্যাপারে অবহেলার কোন সুযোগ নেই। আমি জানি এখানে আপনারা পরিশ্রমের বিনিময়ে খুব সামান্যই পেয়ে থাকেন। আসলে এ সব প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত সম্মানী দানের সামর্থও নেই। নিজেদের স্বার্থেই পেশার প্রতি আপনারা আন্তরিক হন। এ প্রসঙ্গে মরহুম এপিজে আব্দুল কালাম-এর একটি উক্তি আমি আপনাদেরকে স্মরণ করে দিতে চাই- ‘তোমার কাজকে ভালোবাস, কিন্তু তোমার কোম্পানীকে নয়। কারণ তুমি হয়তো জানো না কখন কোম্পানীটি তোমাকে ভালোবাসবে না।’ হ্যাঁ, আপনারা যদি আপনাদের কাজকে যথার্থভাবে ভালোবাসতে পারেন ভবিষ্যতে একজন দক্ষ শিক্ষক বা প্রশাসক হতে পারবেন এবং আপনাদের গুরুত্ব তখন অনেক বেড়ে যাবে।
অভিভাবকদের সাথে এ জাতীয় মত-বিনিময় মাঝে-মধ্যেই হওয়া উচিৎ। আমি নিজেও সিফাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে অধ্যক্ষ থাকাকালীন অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময় করতাম। আর এ সব অনুষ্ঠানে শুধু শ্রশংসা নয়, বরং যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ঘাটতি আপনারা অনুভব করেন তা তুলে ধরলে কর্তৃপক্ষ সংশোধনের সুযোগ পায়। আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত দিয়ে এখানে কিছু বলার সুযোগ করে দেয়ায় আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি প্রাইভেট একাডেমিক কোচিং এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পরিচালক ও শিক্ষকমন্ডলীকে এবং ধৈর্যধারণ করে আমার বক্তব্য শোনার জন্য সম্মানিত অভিভাবকদেরকে। আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পরিচালক আমার অনুজ মোহনাকে (আমরা উভয়ই বাহাদুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী), ফেসবুকের মাধ্যমে তার সাথে পরিচয় এবং তারই আমন্ত্রণে আমার এখানে উপস্থিত হওয়া। আবারো সবাইকে ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।
Comments
Post a Comment