আমরা চেষ্টা করি মাসে বার চারেক পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটু বসতে। নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর সাথে সাথে পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদ স্বয়ং আল্লাহপাকের (সুরা তাহরিমের ৬)। এই একত্রে বসা অনেকখানি আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আব্বা বেঁচে থাকতে পরিবারের সদস্য এবং আশেপাশে তাঁর মেয়েদের নিয়ে নিয়মিত পারিবারিক বৈঠক করতেন। আব্বার অনুপস্থিতিতে এখন আর বাড়িতে সেভাবে হয় না। আমরা ঢাকায় আমাদের বাসায় করে থাকি। তারপরও বাড়িতে কেউ যদি উদ্যোগ নিয়ে করে তাহলে সে প্রভূত সওয়াবের অধিকারী হবে এবং আমরা আব্বা কবরে থেকে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পাবেন। বাড়িতে গেলে আমার স্ত্রী সবাইকে নিয়ে বৈঠক করে থাকে।
পিতা-মাতা, স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি দরদ প্রকৃতিগত (আল্লাহপাক প্রদত্ত)। পরিবারের কল্যাণচিন্তায় আমরা সবাই পেরেশান থাকি। সন্তানের মধ্য দিয়ে আমরা বেঁচে থাকতে চাই। আমাদের সকল শ্রম, কষ্ট ও ত্যাগ সবই পরিবারের জন্য। সেই পরিবারের সদস্যদের মাঝে কেউ যদি পথভ্রষ্ট হয় তাহলে আমাদের কষ্টের শেষ থাকে না। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, সন্তানকে নৈতিকতা (উত্তম চরিত্র) শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে পিতামাতার বড়ো কিছু দেওয়ার নেই। নৈতিকতার ভিত্তি হলো আল্লাহ তায়ালার ভয়। আল্লাহর ভয় সৃষ্টি বা নৈতিকতার উৎস হলো কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান। শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের উচিত পরিবারের জন্য সময় দেওয়া। একত্রে খাওয়া, ঘুরাঘুরি, খেলাধুলা, সাথে নিয়ে বসে কুরআন চর্চা, হামদ-নাত, ছড়া ইত্যাদি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হওয়া দরকার। পারিবারিক বৈঠকের ফলে পরিবারের সদস্যদের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বাড়ে এবং নৈতিক মান উন্নত হয়।
এই দুনিয়া একটি পরীক্ষাগার। পারিবারিক জীবনে শান্তি মানবজীবনে সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। আল্লাহপাক দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন, স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদের দ্বারা চোখের শীতলতা দান করো (সুরা ফুরকান ৭৪)। স্বামী- স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি সবসময় মনের মতো হয় না। লুত আ.-এর স্ত্রী ছিলেন তাঁর নবুয়ত অস্বীকারকারী পাপাচারীদের সঙ্গী, নুহ আ.-এর ছেলে কেনান পিতার নবুয়ত অস্বীকারকারী, ইব্রাহিম আ.-এর পিতা আজর নমরুদের সহযোগী এবং আছিয়া আ.-এর স্বামী ফেরাউন ছিল বিশ্বের সেরা স্বৈরশাসক ও নিকৃষ্টতম জালেম। কেউ তাদের স্বামী-স্ত্রী বা পিতা-পুত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। আল্লাহ চান তাঁর বান্দা-বান্দি ধৈর্যাবলম্বন করুক এবং ধৈর্যের পুরস্কার হিসেবে আল্লাহর কাছ থেকে জান্নাত লাভ করুক। আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কতিপয় শত্রু, তাদের থেকে সাবধান থেকো এবং ক্ষমা ও সহনশীল আচরণ করো। আল্লাহপাক ক্ষমাশীল ও করুণাময় (সুরা তাগাবুন ১৪)। আমরা পরিবারের প্রতি উদার ও ক্ষমাশীল হই এবং নিজেদের জীবনটাকে আনন্দময় করি। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি আমাদের স্বামী ফেরাউন নয়, স্ত্রীও লুত আ.-এর স্ত্রীর মতো নয় এবং ছেলেও কেনানের মতো নয়।
আমরা নয় ভাই-বোনের এক বড়ো পরিবার। আব্বা- আম্মা থেকে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৫ জনে এবং বলা যায় এরা সবাই রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে পরিবারে আমরা বই পড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলাম। বড়দের ৩০০ পৃষ্ঠা বই পড়লেই পুরস্কার। শিশু-কিশোরদের জন্য হালকা ছিল। তাতে ৫৪ জন রেজিস্ট্রেশন করেছিল। আমরা ২০জনকে পুরস্কৃত করেছি। আর একটি পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছি। রজব, শাবান ও রমজান তিন মাসে যারা অর্থসহ পাঁচ পারা কুরআন তেলাওয়াত করবে তাদের জন্য পুরস্কার এবং যারা অতিরিক্ত পড়বে তাদের মধ্য থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কার রয়েছে। শিশু- কিশোরদের জন্য রয়েছে কুরআন তেলাওয়াত, হামদ/নাত ও অঙ্কন প্রতিযোগিতা। এই গ্রুপে রয়েছে ১০২ জন। পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে বই।
গত ৩ তারিখে আমাদের একটি পারিবারিক বৈঠক হয়। সেখানে উপস্থিত সবাই কুরআন তেলাওয়াত এবং তেলাওয়াতকৃত আয়াত নিয়ে আলোচনা করে।
আমি সুরা বুরুজ ১-১২ আয়াত আলোচনা করি। আল্লাহপাক কসম খেয়ে বলেছেন, ধ্বংস হয়েছে গর্তওয়ালারা। ইমানদারদের ধরে ধরে আগুনের গর্তে নিক্ষেপ করে স্বৈরশাসক ও তার অনুসারীরা উল্লাস করেছে। আগুনে নিক্ষিপ্ত মুমিনরা নয় আল্লাহর ভাষায় ধ্বংস হয়েছে গর্তওয়ালারা। গর্তে নিক্ষিপ্ত মুমিনদের কোনো অপরাধ ছিল না- অপরাধ তাদের একটিই এবং সেটি হলো পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ইমান আনা। আল্লাহর প্রতি ইমান আনার পরিণতি হলো ইসলামের শত্রুদের কাছ থেকে জুলুম-নির্যাতন সহ্য করা। আল্লাহ জালেমদের হুশিয়ার করে দিয়েছেন, যারা ইমানদার নর ও নারীকে কষ্ট দেয়, অতপর তওবা করে না তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি। পক্ষান্তরে ইমান ও নেক আমলের অধিকারীদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত যার তলদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত। অর্থাৎ জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে যারা ইমানের উপর অবিচল থাকবে ও নেক আমল করবে আখেরাতে তাদের কোনো ভয় নেই, তারা মহাসুখে থাকবে। অতপর তওবা করে না- এ প্রসঙ্গে সবার কথা জালেমের কোনো ক্ষমা নেই কারণ এটি আল্লাহর বান্দাদের সাথে সম্পর্কীত। আমি বললাম, দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত উদার ও ক্ষমাশীল। গুম-খুন ও নানাবিধ জুলুমে জড়িত সেই জালেমও যদি তওবা করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে তাহলে সেও আল্লাহর ক্ষমা পেতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, মজলুমের কী হবে? আল্লাহপাক মজলুমকে এত পরিমাণ দান করবেন যা পেয়ে জালেমকে তিনি ক্ষমা করে দিবেন কারণ তিনি জানতে পারবেন, তার খুনি পরে তওবা করে পরিশুদ্ধ হয়েছে।
আমার স্ত্রী আলোচনা করেন সুরা আলে ইমরানের ১৫৯ আয়াত। সেখানে আল্লাহ তাঁর নবি সা.-কে কোমল হৃদয়ের উল্লেখ করে বলেন, তিনি (রসুল সা.) কঠোর হলে মানুষ তাঁর কাছ থেকে ছিটকে পড়তো। আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাথিদের ক্ষমা করা, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করার তাগিদ দিয়েছেন। আমরা নানাভাবে দায়িত্বশীল এবং আমাদেরকেও উদার ও ক্ষমাশীল হতে হবে।
আমার ছেলে সুরা কুরাইশ নিয়ে আলোচনা করে বলে, কাবার কারণে কুরাইশরা ছিল খুবই সম্মানিত ও নিরাপদ এবং এই সুযোগে শীত ও গ্রীষ্মে বাণিজ্য করে তারা সমৃদ্ধি অর্জন করে। আল্লাহর এই নেয়ামত স্মরণ করে তাদের উচিত এই ঘরের রবের অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদত করা। আমরা নানাভাবে আল্লাহপাকের নেয়ামত লাভে ধন্য। আমাদেরও উচিত আল্লাহপাকের ইবাদত করা।
আমার বৌমা (কুরআনে হাফেজ ও দাওরায়ে হাদিস) সুরা মায়ারিজ আলোচনা করে। প্রথমে কিয়ামতের বর্ণনা (সেসময়ের ভয়াবহ চিত্র) দেয়ার পর সেদিন কেউ কারো কোনো উপকারে আসবে না, আজাব থেকে বাঁচার জন্য স্বামী/স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ভাই জাতিগোষ্ঠী সবকিছু বিনিময় হিসেবে দিতে চাইবে কিন্তু কোনো কিছু আজাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না। জাহান্নাম সেদিন সত্যবিমুখ ও অর্থসম্পদ পুঞ্জিভূত কৃপণদের ডাকতে থাকবে। আজাব থেকে রক্ষা করা হবে সেসব নামাজিদের যারা নিয়মিত সালাত আদায়কারী, যারা মনে করে তাদের সম্পদে বঞ্চিত ও প্রার্থীদের হক রয়েছে, যারা সত্য স্বীকার করে ও প্রভুর আজাবকে ভয় করে, যারা লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, যারা সাক্ষদানে অবিচল ও নামাজের হেফাজতকারী। এরাই জান্নাতে সম্মানিত মেহমান। সুরা আল মুমিনুনের প্রথমে এবং এখানে জান্নাতি মুমিনদের গুণাবলি উল্লেখ করতে গিয়ে নামাজ দিয়ে শুরু এবং নামাজ দিয়ে শেষ করা হয়েছে।
আল্লাহপাক আমাদের সকল পরিবারে সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা দান করুন এবং ইমান ও আমলের বিনিময়ে জান্নাতে একত্রে অবস্থানের তৌফিক দান করুন। ০৫.০২.২০২৩
Comments
Post a Comment