আল্লাহপাকের অজস্র সৃষ্টির মাঝে মানুষ হলো সেরা। মানুষকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির পাশাপাশি আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত দান করা হয়েছে। আদম আ. প্রথম মানুষ হওয়ার সাথে সাথে প্রথম নবি। তাঁর আদিবাস জান্নাত, যদিও পৃথিবীতে প্রেরণের লক্ষ্যেই তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে। জান্নাতে আদম আ. ও ইবলিসের পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে উভয়ই অকৃতকার্য হলেও আদম আ. নিজেকে দ্রুত সংশোধন করে নেন এবং তওবা করে তাঁর সন্তানদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে যান। আদম আ.-এর বংশধর হয়ে উপলব্ধি করতে হবে যে, ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ফিরে আসলে (তওবা) আর পূর্বে কৃত অপরাধের জন্য শাস্তিযোগ্য থাকে না। ক্ষমা করার পর আদম আ.-কে পৃথিবীতে আসতে বলা হলে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। সে সময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে অভয়বাণী শোনানো হয়, ‘আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই’- সুরা বাকারা ৩৮। তারই ধারাবাহিকতায় অসংখ্য নবি ও রসুলের আগমন ঘটে এই পৃথিবীতে এবং সর্বশেষ নবি ও রসুল হলেন মুহাম্মদ সা.।
মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির মাঝে পার্থক্য হলো জ্ঞান। মানুষকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি দান করার সাথে সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে ওহির জ্ঞান। ওহির জ্ঞান বলতে আমরা আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.-এর উপর অবতীর্ণ সর্বশেষ কিতাব আল কুরআনের জ্ঞানকেই বুঝে থাকি। এই কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ভুল জীবন যাপনের বিধান। এর মধ্যে কোনো সন্দেহ-সংশয়পূর্ণ কিছু নেই। রসুলুল্লাহ সা.-এর উপর প্রথম অবতীর্ণ ওহি হলো, ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ প্রিয়তম নবি সা. বলেছেন, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো। তিনি আরো বলেছেন, প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর উপর জ্ঞানার্জন ফরজ। কুরআন শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়। কুরআন ও হাদিসের বাণী থেকে আমরা সহজেই জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি।
জ্ঞানার্জন অত্যন্ত ব্যাপক। ধর্মীয় জ্ঞান এবং রুজি- রোজগারের লক্ষ্যে জ্ঞান সবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যে জ্ঞান সেটি মূলত নৈতিক জ্ঞান। এর বাইরে কর্মমুখি জ্ঞান, সামাজিক ও চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞানসহ নানাবিধ জ্ঞান রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের জ্ঞানের সূচনা হবে কোন্ ধরনের জ্ঞান দিয়ে। প্রথমত দেখতে হবে মানুষ একটি নৈতিক জীব। ভালো- মন্দ, ন্যায়-অন্যায়বোধ মানুষের প্রকৃতিকে দিয়ে রাখলেও সেটি যথেষ্ট পরিমাণে নয়। শয়তান প্রতিনিয়ত মানুষকে তাড়া করে এবং শয়তানের খপ্পরে পড়ে সে সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এটা মূলত শয়তানের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য শৈশব থেকেই সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে। নৈতিকতার উৎস হচ্ছে আল্লাহর ভয়। কুরআন-হাদিসের জ্ঞান ছাড়া আল্লাহর ভয় এবং নৈতিকতা শিক্ষা সম্ভব নয়। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া ছাড়া পিতা-মাতার বড়ো কিছু দেওয়ার নেই।
একটি শিশুর প্রথম শিক্ষক হলো তার মাতাপিতা। সন্তান আব্বা-আম্মা ডাকা শেখার সাথে সাথে তার স্রষ্টা আল্লাহ নামটিও তাকে শেখাতে হবে। অবচেতন মনেই সে তার রবকে জানবে এবং একসময় সে আল্লাহকে তার রব হিসেবে উপলব্ধি করবে। আমাদের নবির প্রতি ওহি নাজিল হয়েছে তাঁর মাতৃভাষা আরবিতে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আল্লাহকে চেনা ও জানার জন্য আমরা আলিফ, বা, তা শিখবো। কুরআনের ভাষা আরবি। মাতৃভাষায় কুরআনকে জানার জন্য বাংলা ও আরবি আমরা পাশাপাশি শিখবো। শিশুর বয়স ৭-৮ হলে রসুলুল্লাহ সা. সন্তানকে নামাজ শেখানোর জন্য তাগিদ দিয়েছেন। তাই নামাজ সহিহ করে পড়ার জন্য কুরআন শুদ্ধ করে পড়া অপরিহার্য। আমাদের প্রতিটি মহল্লায় মসজিদ রয়েছে এবং মসজিদ বাসার সন্নিকটে ও পরিচিত বিধায় একজন শিশুর প্রাক প্রাথমিক লেখাপড়া মসজিদ থেকে হয়ে যেতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত কুরআনকেন্দ্রিক হলে শিশুর মধ্যে নৈতিকতা জাগ্রত হবে। পিতামাতার জন্য সন্তানের চেয়ে বড়ো নেয়ামত আর নেই। কিন্তু সেই সন্তান যদি অবাধ্য হয় ও ভুল পথে পরিচালিত হয় তাহলে আর কষ্টের সীমা থাকে না। চেষ্টা-প্রচেষ্টার পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালার কাছে স্বামী/স্ত্রী এবং সন্তানদের সুপথে পরিচালনার জন্য আল্লাহর কাছে কাতরভাবে চাইতেও হবে। তাঁরই শেখানে ভাষায় আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি- ‘হে আমাদের রব! আমাদের নিজেদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদেরকে চোখ শীতলকারী বানাও এবং আমাদের করে দাও মুত্তাকিদের ইমাম’- সুরা ফুরকান ৭৪।
ওহির জ্ঞান না থাকায় একটি শিশু সভ্য ও ভদ্র হয়ে বেড়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছে না। তার মেলামেশা ও চলাফেরা হচ্ছে নৈতিকতা বিবর্জিত পরিবেশে। ফলে সহজেই সে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ছে। শিশুদের মাদকাসক্তি বর্তমানে অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুলেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ওহির শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিশু-কিশোর বয়সে এই শিক্ষা না দিতে পারলে তার চরিত্রগঠন ব্যাহত হবে। নিজেদের ঘরগুলোকে কবরখানায় পরিণত না করার জন্য রসুলুল্লাহ সা. তাঁর উম্মতদেরকে সতর্ক করেছেন। আমাদের পুরুষদের জানার অনেক সুযোগ থাকলেও মহিলাদের সুযোগ খুবই সীমিত। মসজিদে জুমার খুতবা, বিভিন্ন মাহফিল, নানাধরনের আলোচনা সভা ও সেমিনারে পুরুষের যতো সুযোগ রয়েছে, মহিলাদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে রয়েছে নানাবিধ বিধি-নিষেধ। অথচ এই মহিলারা চাকরি করছে ও বাজারঘাটে যাতায়াত করছে। শিক্ষামূলক নানা প্রোগ্রামে মা’দের অংশগ্রহণ না থাকায় সন্তানকে শিক্ষাদান ব্যাহত হচ্ছে। আজ যথার্থই আমাদের ঘরগুলো কবরখানায় পরিণত হয়েছে। সেখানে না আছে কুরআনের তালিম, না আছে নামাজের ব্যবস্থা আর না আছে ইসলামের ব্যাপক চর্চা। রসুলুল্লাহ সা. সুন্নাত ও নফল নামাজসমূহ ঘরে পড়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি জুমার দিনে চার রাকাত বাদাল জুমা ঘরে এসে আদায় করলে দু’রাকাতই যথেষ্ট। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। ঘরে বাবা- মার নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াত শিশুমনে দারুণ প্রভাব পড়ে এবং সেও অনুকরণ করে।
চরিত্র গঠনের উপযুক্ত সময় শিশু-কিশোর বয়স। এই বয়সে তাকে যেভাবে গড়ে তোলা হবে বয়োপ্রাপ্ত হলে সেটিই তার চরিত্রে প্রকাশ পাবে। মানুষের চরিত্র গঠনে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নামাজে অভ্যস্ত করা। আল্লাহপাকের বাণী, ‘নিশ্চয়ই সালাত অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে’- সুরা আনকাবুত ৪৫। হঠাৎ করে নামাজে অভ্যস্ত করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সন্তানকে প্রথমে ওহির জ্ঞান দান করা অর্থাৎ কুরআনের সাথে পরিচিত করা। শ্রেষ্ঠত্ব অর্থকড়ি, বাড়ি -ঘর, উচ্চ বেতনের চাকরি কোনো কিছুতেই নেই, শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে তাকওয়ায় এবং তাকওয়া অর্জনের উপায় হলো ওহির জ্ঞান অর্থাৎ কুরআনের জ্ঞান। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’ যেসব বাবা-মা সন্তানকে কুরআনের শিক্ষা দেন না তারা বড়ই হতভাগা এবং সহসাই সন্তানের অসদাচরণে তারা তাদের ভুল উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে শয়তানের নানা চক্রান্তে সন্তান সহজেই ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ইসলামকে জানার তেমন সুযোগ নেই। ফলে বাবা-মাকেই উদ্যোগী হয়ে তাদের সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানিতে মানুষের মধ্যে কুরআন জানার আগ্রহ বেশ জোরালে হয়েছে এবং দেশে প্রচুর উন্নত মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আমাদের বুঝতে হবে, জমিনে আগাছা বিনা যত্নেই বেড়ে উঠে। কিন্তু ফসল করতে হলে আগাছা পরিষ্কার করার পাশাপাশি ফসল উৎপাদনে নিবিড় পরিচর্চা প্রয়োজন। তাই সন্তানের পেছনে যত্ন না নেয়া হলে তারা সহজেই মাদকাসক্ত ও সন্ত্রাসী হয়ে বেড়ে উঠবে। সন্তানের পেছনে যে ব্যয় সেটি মোটেই অপচয় নয় বরং শ্রেষ্ঠতম বিনিয়োগ এবং শৈশাবস্থায় ব্যয় না করে পরবর্তীতে ব্যয় ততটা সুফল বয়ে নাও আনতে পারে। আমি এ কথা বলতে চাচ্ছি না যে শিশু কথা বলার সাথে তাকে কয়েকজন শিক্ষক দিতে হবে। শিশুর জন্য শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক তার মা এবং বাবাকে অবশ্যই সহযোগী হতে হবে। বাবা-মার মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক এবং একে অপরের সহযোগী হয়ে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করলে আশা করা যায় সেই সন্তান বিনয়ী ও অনুগত হবে। সন্তান যখন স্কুলে যাওয়ার মতো হয় দামি স্কুল ও সাধারণ শিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে যে পরিমাণ ব্যয় করা হয় তার খুব সামান্য অংশই ব্যয় হয় ওহির জ্ঞান অর্থাৎ কুরআনের শিক্ষা দানের লক্ষ্যে।
একজন মুসলিম হিসেবে আমরা আল্লাহর কাছে চাই দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ। দুনিয়ার জীবনটা খুবই সংক্ষীপ্ত এবং আখেরাতের জীবন অসীম। বুদ্ধিমান সেই যে দুনিয়া অপেক্ষা আখেরাতকে অগ্রাধিকার দেয়। যে ব্যক্তি আখেরাতকে অগ্রাধিকার দেয় আল্লাহপাক তাকে দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই দান করবেন। এটি আল্লাহপাকের ওয়াদা। দুনিয়ার জীবনে সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তায়ালার বড়ো নেয়ামত এবং আল্লাহপাক শিখিয়ে দিয়েছেন তাঁর কাছে দোয়া করতে এমন স্বামী/স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করতে যাতে তাদের চোখ শীতল হয়ে যায়। নেকসন্তান দুনিয়ার জীবনে যেমন কল্যাণকারী তেমনি মৃত্যুর পরে আখেরাতেও তারা বাবা-মার আমলনামা ভারি করে দিবে। তাই আমরা অতি শৈশব থেকে সন্তানকে আল কুরআনের সাথে পরিচিত করি তুলি এবং কুরআনের আলোকে তাদের চরিত্র গড়ে তুলি। তাহলে দুনিয়ার জীবনে তারা হবে আমাদের জন্য সম্পদ এবং আখেরাতেও।
Comments
Post a Comment