আমল থেকে মুয়ামেলাত। ভালো আমল ও মন্দ আমল। আমাদের আলোচনার বিষয় হলো ভালো আমল। কারো লেনদেন ও আচার-আচরণ ভালো হলে আমরা বলি তার মুয়ামেলাত সুন্দর। বাঁকি নিয়ে ঠিকমত পরিশোধ না করলে বলে থাকি মুয়ামেলাত ভালো নয়। যার মুয়ামেলাত সুন্দর সে যথার্থই মুসলিম। মূলত ইসলামের ব্যবহারিক জিন্দেগিই হলো মুয়ামেলাত।
সুরা আসরে আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে চারটি গুণের কথা বলেছেন। এ কথাগুলো বলার ক্ষেত্রে তিনি শপথ করেছেন। প্রথম হলো ইমান, দ্বিতীয়ত নেক আমল, তৃতীয়ত নসিহত করা ও চতুর্থত সবর করা। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজিদে নাজাত প্রসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ইমানের সাথে নেক আমল যোগ করে দিয়েছেন। আমরা সংক্ষিপ্ত পরিসরে এখানে মুয়ামেলাত সম্পর্কে আলোচনা করবো।
১. সকল কাজ আল্লাহর নামে শুরু করা। আল্লাহর নামে কোনো কাজ শুরু করলে সেখানে আল্লাহপাকের নাফরমানি করার সম্ভাবনা কম থাকে এবং কাজে বরকত হয়।
২. দোয়া করে ঘর থেকে বের হওয়া। রসুলুল্লাহ সা. আল্লাহর নামে কোনো কাজ শুরু করার পাশাপাশি দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তিনি বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহি লা হাওলা ওয়া লা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহি পাঠ করার কথা বলেছেন। এতে আল্লাহর উপর নির্ভরতা বাড়ে এবং বান্দা আশ্বস্ত হয়।
৩. নামাজের সময় স্মরণ রাখা। কর্মব্যস্ততার মাঝেও বান্দা নামাজ সম্পর্কে গাফেল হবে না। আগে নামাজ তারপরে কাজ। নামাজে অবশ্যই খুশুখুজু থাকতে হবে। নামাজ মানুষের মাঝে আল্লাহর স্মরণ ও ভয় জাগ্রত করে। নামাজে আন্তরিকতা ও ভয় থাকলে এই নামাজ আমাদের মুয়ামেলাত সুন্দর করবে। আর আল্লাহপাক বলেছেনও, নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে।
৪. বিনীতভাবে চলা। চলাফেরায় গর্ব-অহংকার নয়। অহংকার মানুষের পতন ত্বরান্বিত করে। অহংকার থেকে তারাই মুক্ত থাকতে পারে যারা অগ্রসর হয়ে সালাম দেয় বিশেষ করে অধীনস্থদেরকে এবং তাদের সাথে উত্তম আচরণ করে। দাওয়াতে দীনের ক্ষেত্রে এটা খুবই জরুরি।
৫. ধৈর্যশীল হওয়া। উত্তম গুণাবলির মধ্যে ধৈর্য বড়ো গুণ। আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন এবং নানাভাবে তাদের প্রশংসা করেছেন।
৬. রাগকে হজম করা। জান্নাতি লোকদের বড়ো গুণ হলো তারা রাগ হজম করে। হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকতে হবে। হিংসা সকল নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। পারিবারিক জীবনে কখনো গোলমাল হলে অবশ্যই চুপ করে থাকতে হবে।
৭. অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন অবস্থান থাকতে হবে। আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি হলো ভালো কাজের আদেশ করা ও অন্যায় কাজে বাধা দেওয়া। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে হক কথা বলা শ্রেষ্ঠতম জিহাদ।
৮. দান করা। দানের হাতকে প্রশস্ত করতে হবে। দানকারী আল্লাহর নিকটবর্তী হয়। বিশেষ করে দীন প্রতিষ্ঠার কাজে দানকে আল্লাহ তাঁকে কর্জ দেয়ার কথা বলেছেন এবং আল্লাহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন।
৯. ঋণমুক্ত থাকা। যে কোনো মূল্যে ঋণমুক্ত থাকতে হবে। নিজের প্রয়োজন সীমিত করে অল্প তুষ্ট ব্যক্তি ঋণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
১০. অসিহত করা। হাদিসে বলা হয়েছে, মানুষ আমার আমার করে আসলে আমার বলে কিছু নেই বরং মৃত্যুর সাথে সাথে সবকিছুর মালিকানা উত্তরাধিকারদের হয়ে যায়। মানুষ যা কিছু দান করে কেবল সেটিই তার। তার উচিত সম্পদ থেকে এক তৃতীয়াংশ অসিহত করে যাওয়া। জনকল্যাণমূলক ও দীন প্রতিষ্ঠার কাজে তার সম্পদ সদকায়ে জারিয়া হিসেবে মৃত্যুর পরে সওয়াব পৌঁছাতে থাকবে।
১১.আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করা। আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করার তাগিদ বারবার এসেছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না। আমাদের সমাজে আত্মীয় বিশেষ করে বোনের হক না দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এটি একটি মারাত্মক গুনাহ।
১২. ক্ষমা করা। ক্ষমা করার বড়ো লাভ কিয়ামতের দিন আল্লাহর ক্ষমা লাভ। যে সমাজে ক্ষমার পরিবর্তে প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবণতা তীব্র সে সমাজে শান্তি আসতে পারে না। মুমিনদের উচিত অপরকে ক্ষমা করে দেওয়া। ঘরেও ক্ষমা করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, ভাই-বোন সকল ক্ষেত্রে ক্ষমা করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
১৩. লজ্জাস্থানের হেফাজত করা। মুমিনদের একটি বড়ো গুণ তারা লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। আল্লাহ তায়ালার বাণী, জেনা ব্যাভিচারের ধারেকাছেও যেও না। মোবাইলে আসক্তি আমাদেরকে জেনায় লিপ্ত করে ফেলছে। ইচ্ছা না থাকলেও অনেক সময় অশ্লীল ছবি চলে আসে। অপ্রয়োজনে মোবাইল না চালানোই ভালো বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও যুবকদের বড়ো সর্বনাশ করছে মোবাইল।
১৪. আল্লাহর জিকিরে জিহবা সিক্ত রাখা। শুধু জিকির করা নয় বেশি বেশি জিকির করার তাগিদ রয়েছে। নামাজের সময় তো বটেই সর্বক্ষণ জিকিরে জিহবা সিক্ত রাখতে হবে। সুবহান আল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ ইত্যাদি জিকির সময় পেলেই মুখে উচ্চারণ করতে হবে।
ব্যবহারিক জীবনে সর্বক্ষণ আল্লাহর স্মরণ ও তাঁকে ভয় করে চললে ইনশা-আল্লাহ আমাদের মুয়ামেলাত বা আমল-আখলাক সুন্দর হয়ে যাবে। মুয়ামেলাত সুন্দর হলে পৃথিবীতে নেতৃত্ব আবার মুসলমানদের হাতে চলে আসবে ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের ব্যবহারিক জিন্দেগি সুন্দর করার তৌফিক দান করুন।
০৩.০২.২০২৩
Comments
Post a Comment