(কুচিয়ামোড়া বাজার জামে মসজিদে ০৮.০৭.২০২২)
হজ মানুষকে সদ্যজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ করে দেয়
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া যে, তিনি দয়া করে আমাদেরকে তাঁর ঘরে উপস্থিত হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। আলহামদু লিল্লাহ। দরুদ ও সালাম প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.-এর ওপর।
আজ আমাদের এখানে ৮ জিলহজ। মক্কায় হাজিরা আরাফায় অবস্থান করছেন। আরাফায় অবস্থানই মূলত হজ। এইদিনে রসুলুল্লাহ সা. বড় কাতরভাবে আল্লাহর কাছে তাঁর ও তাঁর উম্মতের গুনাহ মাফের জন্য কান্নাকাটি করেছেন। দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে চেয়েছেন। তাঁর সকল প্রয়োজন তিনি তাঁর মহান মনিবের কাছে পেশ করেছেন এবং আল্লাহপাকও জিবরাইল আ. মারফৎ তাঁর বান্দাকে জানিয়ে দিয়েছেন, এই ময়দানে যারা হাজির হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হাজির হবে সকলের গুনাহ মাফ করা হবে। অর্থাৎ তারা সদ্যজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে। তবে যাদের উপার্জন অবৈধ এবং যারা জালেম তারা ব্যতীত। হজে মাবরুরের প্রধান শর্তই হলো হালাল উপার্জন এবং হজ হতে হবে কেবল আল্লাহরই উদ্দেশ্যে এবং তাঁর রসুল সা.-এর পন্থানুসারে। তবে কেউ যদি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ (তওবা) হয়ে আসে যে ভবিষ্যতে আর হারাম পথে পা বাড়াবে না বা কারো প্রতি জুলুম করবে না এবং যাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে তাদের সাথে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করবে তাদের বিষযটি স্বতন্ত্র। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করতে চান। শুধু প্রয়োজন আল্লাহর প্রতি বিনয়ী হওয়া এবং গুনাহ থেকে ফিরে আসা (তওবা করা)। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, হজে মাবরুরের প্রতিদান হলো জান্নাত।
রসুলুল্লাহ সা. আরাফার দিনের নানা ফজিলতের কথা বলেছেন। এইদিনে রোজা রাখার অনেক ফজিলত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আশুরার রোজার বিনিময়ে বিগত বছরের গুনাহ মাফ এবং জিলহজ মাসের ৯ তারিখের রোজা বিগত এক বছর এবং সামনের এক বছরের গুনাহ মাফের কথা উল্লেখ রয়েছে। এসবই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর নেক বান্দাদের জন্য বোনাস। তাই আমরা আগামীকাল রোজা রাখার চেষ্টা করি।
আরাফার এই ময়দান ও আরাফার এই দিন অতীব বরকতপূর্ণ। তাই সকল হাজি মনের সকল আকুতি নিয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে এবং জিকির- আজকারে ব্যস্ত থাকে। মূলত দোয়া, তাকবির ও তালবিয়া পাঠ হজের অন্যতম আমল। সর্বক্ষণ আল্লাহরই শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্ব ঘোষণা এবং তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং প্রশংসা কেবল আল্লাহরই ও রাজত্বও তাঁরই- চলতে ফিরতে উঠতে বসতে হাজি সাহেবের মুখ থেকে বারবার উচ্চারিত হয়। শিরকের মূলোৎপাটন করে নির্ভেজাল তওহিদের সবকদানই হজের মূল শিক্ষা। এজন্য হজ অনন্য, হজের সাথে কোনো ইবাদতের তুলনা নেই। হজরত ইমাম আবু হানিফা রহ. হজ করার পরে বলেন, এটিই সেরা ইবাদত। হাজি সাহেবরা আল্লাহর মেহমান। হজ করে যখন তাঁরা ফিরে আসবেন আমরা তাঁদের সাথে সাক্ষাত করবো এবং দোয়া নেব। উপস্থিত মুসল্লিদের প্রতি হজের নিয়ত করার কথা বলা হলে সবাই স্বতস্ফুর্তভাবে সাড়া দেন। বান্দার প্রতি আল্লাহর কতো অনুগ্রহ যে ভালো কাজের নিয়ত করলেই তার আমলনামায় নেকি লেখা হয় এবং আমল করার পর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার মানদণ্ডে তার সওয়াব দশ থেকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ মন্দ কাজের নিয়তে কোনো গুনাহ নেই এবং মন্দ কাজ করলে গুনাহ সমপরিমাণ লেখা হয়, বাড়িয়ে নয়। আবার তাৎক্ষণিক তওবা করলে গুনাহ মুছে দেয়া হয়।
বান্দাকে শাস্তি দেয়া আল্লাহর অভিপ্রায় নয়। তিনি তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করতে চান। শুধু প্রয়োজন বিদ্রোহাত্মক আচরণ পরিহার করে আল্লাহর অনুগত ও ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া। সারা জীবন নামাজ পড়েননি, তাতে কী? আপনি তওবা করুন এবং সিদ্ধান্ত নিন জীবনে আর নামাজ কাজা করবো না। শয়তান আমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে প্ররোচনা দেয়, কেবল বয়স ৫০ বছর, তোর বাপ বেঁচেছিল সত্তর বছর। এখনো সময় আছে। স্রেফ ধোঁকা। সে একা জাহান্নামে যেতে চায় না, সে চায় তার চিরশত্রু মানুষকে সাথে নিয়ে দলেবলে যেতে। যদি দেখেন নামাজ কাজা হয়ে যাচ্ছে বা আল্লাহর নাফরমানি হচ্ছে তাৎক্ষণিক তওবা করুন। আল্লাহপাক মুমিনের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, তারা বারবার তওবা করে।
আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। পরোয়ারদেগার! ভুল হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করুন- বান্দার পক্ষ থেকে এই ডাক আল্লাহর কাছে খুবই প্রীতিপূর্ণ। বিশেষ বিশেষ দিনক্ষণ বটেই যেকোন সময়ের ডাকে আল্লাহ সাড়া দেন। না চাইলেও বিশেষ বিশেষ দিনে আল্লাহ তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন। ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয় কেবল মুশরিক ও হিংসুকে। আল্লাহর ক্ষমা পেতে চাইলে শিরক ও হিংসা ছাড়তে হবে। ভাইয়ে-ভাইয়ে হিংসা, পাড়া-প্রতিবেশির সাথে হিংসা, নেতা-নেত্রীদের মাঝে হিংসা আবার একই দলের মাঝেও হিংসা। হিংসা নেই কোথায়? হিংসা সম্পর্কে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বলিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের সকল নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহপাক সুরা ফালাকে হিংসুকের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা বলেছেন। আসুন, আমরা হিংসামুক্ত হই এবং মানুষকে ক্ষমা করি। ক্ষমার বিনিময়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়া যাবে এবং ক্ষমার গুণ আমাদেরকে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
আমাদের জীবনটা খুবই সংকীর্ণ। প্রতিনিয়তই মৃত্যু দেখছি। যেকোন সময়ে ডাক চলে আসবে। তাই আর অবহেলা না করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসি। আল্লাহর দিকের পথ (ইসলাম) অত্যন্ত সহজ-সরল। সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু করেন আল্লাহপাক সাহায্য করবেন। আর অপেক্ষা নয়। নামাজ দিয়ে শুরু করুন। আর আল্লাহর বান্দাদের সাথে সদাচরণ করুন ও তাদের অভাব- অভিযোগে পাশে দাঁড়ান। আমরা স্কুলজীবনে কবিতা পড়েছি। হাশরের দিন বিচারে বসিয়া সুধাবে জগৎস্বামী, তুমি মোরে করো নাই সেবা যবে রুগ্ন যে ছিলাম আমি। হ্যাঁ, আল্লাহপাক হাশরের দিনে বলবেন, আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, আমি পিপাসার্ত ছিলাম, আমি অসুস্থ ছিলাম। সেদিন মানুষ বলবে, হে পরোয়ারদেগার! এটি কী করে সম্ভব? আল্লাহ বলবেন, আমার বান্দারা ক্ষুধার্ত ছিল, পিপাসার্ত ছিল, অসুস্থ ছিল। দুনিয়ায় তাদের প্রয়োজন পূরণ করলে আজ আমাকে পেতে। এটি কবির কবিতা নয়, এটি স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর কথা। আসলে মানুষ তো আল্লাহরই প্রতিনিধি। মানুষের কতো মর্যাদা। মানুষকে খাওয়ালে আল্লাহকেই খাওয়ানো হয়। আবার মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হলে আল্লাহরই সাথে করা হয়। যে সব কারণে মানুষ জাহান্নামে যাবে তার অন্যতম কারণ হলো নামাজ আদায় না করা ও মিসকিনকে খাবার না দেয়া (সুরা মুদ্দাসসির ৪৩-৪৪)। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে তাঁর পথে কবুল করুন। আমিন। সংক্ষেপিত।
Comments
Post a Comment