আজ সকালে ফেসবুকে জসিম ভাইয়ের এক পোস্টে দেখি আজাদ ভাই তাঁর রবের কাছে ফিরে গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রজেউন)। আমাদের এলাকা ভেড়ামারা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি এবং ইসলামের কারণে আমরা পরস্পর ভাই হয়ে গিয়েছিলাম। এই ভ্রাতৃত্ব ছিল অত্যন্ত মজবুত। তিনি ছিলেন আমার আব্বার অত্যন্ত স্নেহধন্য। বলা যায় আমাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ নয়। আমার আব্বাকে নিয়ে লেখার মধ্যে তিনি সেটি প্রকাশ করেছেন।
মাঝে একবার রাজশাহী গেলে আজাদ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। তিনি ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন এবং খুব পরিশ্রমী ছিলেন। আজাদ ভাই সরল ও উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। আমি জানি, ভেড়ামারার মতো রাজশাহী মহানগরীতেও তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন।
হে আল্লাহ! আমরা তোমার এই বান্দাকে নিকট থেকে জানি। আমাদের চেয়েও তুমি বেশি জানো। তুমি তোমার বান্দাকে ক্ষমা করে জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করো এবং পরিবারকে ধৈর্য ধারণের তৌফিক দান করো। তাঁর অবর্তমানে পরিবারের অভিভাবকত্ব তুমিই গ্রহণ করো।
আমার আব্বাকে নিয়ে আজাদ ভাইয়ের স্মৃতিচারণ
আমার বাবাজী
মো. আবুল কালাম আজাদ
সহকারী প্রকৌশলী (অব), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
রাত দশটা পার হয়েছে। বিছানার পরে আধা আধা ঘুম। হঠাৎ একটা মেসেজ আসার শব্দে জেগে উঠলাম। মেসেজ তো অনেক আসে। সব চেক করি না। কিন্তু এই মেসেজ চোখে পড়ার সাথে সাথে খুলে দেখলাম। পাঠিয়েছেন আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণপ্রিয় হিলালী ভাই। তাঁর পিতা সফল শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী মরহুম মো. লুৎফর রহমান স্মরণে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হবে। তখন থেকেই হৃদয় মাঝে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল, আমাকে কিছু লিখতেই হবে। কোথায় কখন কীভাবে তাঁর সাথে উঠেছি, বসেছি, খেয়েছি সবই মনের পর্দায় চলে আসলো। আমার সৌভাগ্য, আমি তাঁর বেশ সহচার্য পেয়েছি। স্মৃতির পাতায় সবকিছু ভাসতে লাগলো। সেদিন ঐসব চিন্তাভাবনা নিয়ে ঘুমিয়েও রাত্রিতে উঠতে সক্ষম হলাম। আল্লাহর নিকট করজোড়ে নিবেদন করলাম ‘হে আমার মালিক, যেই লোকটার চরিত্রে আমি কোনদিনও খারাপ কিছু পাইনি তাকে তুমি জান্নাতে দাখিল করো। তেমনিভাবে আমার বাপ-মাকেও জান্নাতে দাখিল করো’।
কিন্তু সমস্যা হলো জীবনে কোনদিন কোনো বিষয়ে কলম ধরিনি। কী লিখবো...কীভাবে লিখবো...কিন্তু আমাকে যে লিখতেই হবে। কারণ তাঁর জন্য লেখার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করা আর পাঠকগণকেও দোয়াতে শরীক করার মাধ্যমে আমার ঋণ কিছুটা লাঘব করতে পারি।
তাঁর সাথে আমার পরিচয় চাকরির সুবাদে। ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৩/৮/৯২ সালে বদলি হই। দুই একদিন এর মাঝে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়। প্রথম সাক্ষাতেই একজন শিক্ষাবিদ, দামুকদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমাকে আকৃষ্ট করলেন।
তিনি একজন সফল শিক্ষক। তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরেও স্কুল কমিটি তাঁকে দুই টার্ম নিয়োগ দেয়। যদি কমিটির ক্ষমতা থাকতো তবে হয়তো আজীবন তাঁকে রেখে দিতেন শুধু তাঁর সততা, যোগ্যতা, বিচক্ষণতা, অভিজ্ঞতা, মধুর ব্যবহার আর সকলের প্রতি আন্তরিকতার জন্য।
মুরুব্বির সাথে আমার চলাফেরা ১৯৯২ সালের শেষদিকে। তাঁর ওপর আল্লাহর দ্বীনের এক দায়িত্ব অর্পিত হয়। বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে আমাকে তাঁর সব প্রোগ্রামে সাথে নেয়ার দায়িত্ব দেন। তাঁর চলাফেরা, আচার ব্যবহার, সংগঠনের প্রতি প্রবল ভালোবাসা আর আন্তরিকতা আমাকে প্রচণ্ড মুগ্ধ করে। তিনিও আমার সাথে স্নেহের বন্ধন মজবুত করার লক্ষ্যে সবার সামনে ঘোষণা দেন, আজাদ সাহেব আমার আরেকটি ছেলে! আমিও সেই ঘোষণা শুনে প্রচণ্ড খুশী হই, তোহুর আহমদ হিলালীর মতো ব্যক্তি আমার ভাই! বিলাল, লুলু, ডাক্তার কামাল আমার ভাই!
দীর্ঘ পনের বছর আমি ভেড়ামারায় আল্লাহর দ্বীনের কাজ করি। কোনদিন তিনি আমার প্রতি কোনো জোরে কথা বলা তো দূরে থাক, আমিসহ সকল সহকর্মীর সাথে তাঁর আচরণ ছিল ঈর্ষা করার মতো। তাঁর জন্য মনের ভিতর থেকে মালিকের দরবারে দোয়া চলে আসে।
কিছু স্মৃতিঃ দ্বীনের কাজে আমার বাহাদুরপুর ও জুনিয়াদহ যাওয়ার প্রোগ্রাম হলেই তিনি বিলাল ভাইকে বলতেন 'আজাদ আজ আসবে, একটু ভালো বাজার করো।' খালাম্মা (মা)-কে বলতেন তোমার এক ছেলে আসছে। বউদের বলতেন (প্রথম দিকে বেলাল ভাই, পরে লুলু ভাইও বিয়ে করেন) ভালো রান্নাবাড়া করতে। আমি কখনো একা, কখনো দলবল নিয়ে তাঁর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করতাম। তিনি আমার কাছে বসে খাওয়াতেন আর বলতেন 'বিলালকে বাজার করতে বলেছিলাম। ছেলেটা আমার ভালো কিন্তু মাঝে-মধ্যে নামাজে গাফিলতি করে।' এই বলে আফসোস করতেন। আমাকে তার সাথে যোগাযোগ করতে বলতেন। বিলাল ভাই নরম প্রকৃতির লোক। মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনতেন।
তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য : বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় দ্বীনের কাজে বেশি ছুটাছুটি করতে পারতেন না। তবে কোন TC/TS. হলে তাঁর একটা বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ থাকতো। তিনি বক্তৃতাতে এমন হাদিস বা আয়াত উদ্ধৃত করতেন যা আমাদের অজানা থাকতো। যতটুকু বলতেন তারও অনেক প্রভাব পড়তো, কারণ তিনি নিজে তার ওপর আমল করতেন। ছেলে-মেয়ে সবাইকে সংগঠনভুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। তাঁর বড় ছেলে প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী ও তার স্ত্রী আফরোজা আপা তখন থেকেই দ্বীনের কাজে বেশ অগ্রসর ছিলেন। বিলাল ভাই, লুলু ভাই, ডাক্তার ভাই ও তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে মাসিক সহযোগিতা নিতেন। আমাদেরকে ছেলেদের পেছনে কাজ করার পরামর্শ দিতেন। এ ব্যাপারে এতো পেরেশান ছিলেন যে ‘কু আন ফুসাকুম আহলে কুম নারা’ (নিজে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো ও পরিবারকেও বাঁচাও) এর সফল অনুসারী।
ব্যক্তিত্বের ছাপ : এলাকার সবাই তাঁকে লুৎফর মৌলভী বলে ডাকতেন। কারণ তিনি কুরআন-হাদিস বোঝা সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সেদিক থেকেও তিনি তাঁর এলাকায় একজন সৎ মানুষ ছিলেন। নূর মোহাম্মদ মাস্টার তখনো সংগঠনে শরীক হননি। আমাদের সাথে উঠাবসা করেন, বই পড়েন আর লুৎফর রহমান সাহেবের ব্যক্তিত্বের কারণে দুর্বল হয়ে তিনি আন্দোলনে শরীক হন।
আল্লাহতা'লা পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ করেন : যতদূর জেনেছি ইসলামী আন্দোলন করার জন্য তিনি নানাভাবে নিগৃহিত হয়েছেন। লেখাপড়াতে হাই মাদ্রাসা (এসএসসি সমমান) পাস, এরপর প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে সকল ডিগ্রি অর্জন করেছেন। আইএ, বিএ ও এমএ পাস করেছেন এবং পরবর্তীতে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
তিনি এতো সময় ধরে শিক্ষকতা করেছেন যে এক ব্যক্তি, তার ছেলে ও নাতিও তাঁর ছাত্র। তিনি সবার শিক্ষক ছিলেন। সংগঠন-এর সমাজকল্যাণ ছাড়াও বাহাদুরপুর ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের মাধ্যমে দুস্থ মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। প্রতি বছর সবার কাছ থেকে এমনকি মেয়ে জামাই (কালু ভাই)-সহ এলাকার গণ্যমান্য লোকের নিকট থেকে টাকা, চাউল, কাপড় সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করতেন।
একটি কৈফিয়ৎ : তিনি যেমন আমাকে ছেলের মতো স্নেহ করতেন, আমিও আমার বাপ, মুরব্বী হিসেবে তাঁকে বাবাজী বলে ডাকতাম। কিন্তু তাঁর জানাযায় আমি যেতে পারিনি। জানাযার দুই-তিন ঘন্টা আগে আমি খবর পাই এবং সে সময়ে আমি রাজশাহী অবস্থান করছিলাম। যদি সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম যে মোটরসাইকেল নিয়েই যাবো তাহলে হয়তো জানাযা ধরতে পারতাম। এখন মনে হয় কেন যে সেদিন মোটরসাইকেল নিয়েই রওনা হলাম না! আফসোস!!
সকলের নিকট আমার আবেদন আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে আমি মরহুমের জন্য দোয়া করতে পারি এবং জানাযায় গিয়ে যেই দোয়া করতাম তা যেন পুষিয়ে নিতে পারি।
মহান প্রভুর নিকট বিনয় মস্তকে এই বলে দোয়া করছি, ‘হে রব! তুমি তাঁকে রাদিয়াল্লাহু আনকুম ওয়া রাদু আনহু (আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট) দলে শরীক করুন। আমিন।
Comments
Post a Comment