আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর ভারতে সম্প্রতি নবি মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি কটূক্তির প্রেক্ষিতে উম্মতের প্রতি নবির দরদ-ভালোবাসা, তাঁর মর্যাদা এবং তাঁর সম্মান হানির বিরুদ্ধে করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন।
আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা. সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরিত এবং কেয়ামত পর্যন্ত সকলেই তাঁর উম্মত। এর মধ্যে যারা তাঁকে মেনে চলবে তারা মুসলিম এবং যারা অমান্য করবে তারা কাফের। মানুষের কাছে তাঁর দ্বীন পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। মক্কায় নির্যাতিত হওয়ার পর বড় আশা নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন তায়েফে। তায়েফের মানুষ দ্বীনের দাওয়াত কবুল না করে তাঁর উপর চালায় সীমাহীন নির্যাতন। তিনি রক্তাক্ত হন এবং রক্ত যাতে জমিনে না পড়ে সেজন্য তিনি বারবার সেই রক্ত শরীরে মেখেছেন। রক্তে তাঁর জুতা আটকে যায় এবং খোলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। তায়েফবাসীদের ধ্বংস করে দেয়ার জন্য জিবরাইল আ. তাঁর অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি না দিয়ে আল্লাহর কাছে তাদের হেদায়াত কামনা করেছেন। আর তিনি শাস্তি চাইবেন বা কী করে? আল্লাহ যে তাঁকে জগৎবাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘(হে নবি) আমি তোমাকে সারা বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি’- সুরা আম্বিয়া ১০৭।
আল্লাহপাক তাঁর আনুগত্যের সাথে সাথে তাঁর নবি মুহাম্মদ সা.-এর আনুগত্য-অনুসরণ ফরজ করেছেন। আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাইলে রসুলুল্লাহ সা.-এর অনুসরণকে শর্ত করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘হে রসুল! আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেবেন, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’- সুরা আলে ইমরান ৩১। মুমিনরা তাদের নবিকে দুনিয়ার সবকিছু অপেক্ষা এমনকি নিজের জীবন অপেক্ষাও বেশি ভালোবাসেন। আনাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমাদের কেহই ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হই’- বুখারি ও মুসলিম। উহুদের প্রান্তরে প্রিয় নবি সা. রক্তাক্ত হয়েছেন, দন্তমুবারক শহিদ হয়েছে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে আগলে ধরে নিজেদের পিঠকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। তারপরও যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে দাঁড়াননি। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, নিজেদের জীবন অপেক্ষা আল্লাহর রসুল সা.-কে তারা বেশি ভালোবাসেন।
মুসলমানদের কাছে তাদের নবির মর্যাদা কতো উচ্চে তা সুরা হুজুরাতে আল্লাহপাক নিজেই বলেছেন। বেয়াদবি বা কটূক্তি অনেক পরের তাঁর সাথে কথা বলার সময় খুব সতর্কতা অবলম্বনের জন্য তাগিদ দিয়েছেন, নবির সাথে কথা বলার সময় অত্যন্ত বিনয় অবলম্বন করতে বলেছেন। আল্লাহপাকের বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! নিজেদের আওয়াজ রসুলের আওয়াজের চেয়ে উঁচু করো না এবং উচ্চস্বরে নবির সাথে কথা বলো না, যেমন তোমরা নিজেরা পরস্পর বলে থাকো। এমন যেন না হয়, তোমাদের অজান্তেই তোমাদের সব কাজ-কর্ম বরবাদ হয়ে যাবে’- সুরা হুজুরাত ২। যে নবির সাথে কথা বলার সময় সামান্য জোরে আওয়াজ করলে তার সকল আমল বরবাদ হয়ে যায় সেই নবির শান ও মর্যাদা কতো উচ্চে তা সহজেই অনুমেয়। নবির প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ঘাটতি থাকলে বোঝা যায় সে মুসলিম নয় পাক্কা মুনাফিক। তাদেরকে ধর্মত্যাগী মুরতাদ বলা যায় এবং শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ডের এই শাস্তি কোনো ব্যক্তি বা দল নয় রাষ্ট্র বা সরকার প্রদান করবে। বর্তমানে সংসদ চলছে। মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে সংসদে বিল উত্থাপনের জন্য খতিব মহোদয় সরকারের কাছে জোর দাবি জানান এবং তাঁর এই দাবির পক্ষে সমর্থন কামনা করলে মুসল্লিরা দু’হাত উঁচু করে সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
আল্লাহপাক নিজেও তাঁর নবির প্রতি কোনো কটূক্তি ও অসদাচরণ বরদাশত করেন না। আমরা জানি, রসুলুল্লাহ সা. তাঁর স্বজাতিকে এক পাহাড়ের পাদদেশে একত্র করে ইসলামের দাওয়াত দিলে তাঁর আপন চাচা আবু লাহাব বলে উঠে ‘তাব্বান লাকা ইয়া মুহাম্মদ’। তার এই আচরণের প্রেক্ষিতে আল্লাহপাক নাজিল করেন সুরা লাহাব। আবু লাহাব, তার স্ত্রী ও সন্তানদের করুণ পরিণতি ঘটে। বর্তমান সময়েও নবির প্রতি বেয়াদবির ফল অনেকেই ভোগ করেছে। সম্প্রতি ভারতে মুসলিম বিদ্বেষী বিজেপির দুইজন নেতা প্রিয়তম নবির প্রতি কটূক্তি করে আমাদের দিলে আঘাত দিয়েছে। নবির প্রতি বেয়াদবিতে কোনো মুসলমান চুপ থাকতে পারে না। ফলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে এবং ভারতের পণ্য বর্জনের হিড়িক পড়েছে। ভারতে একের পর মুসলমানদের উপর তারা জুলুম নির্যাতন করে থাকে। কখনো মসজিদে মন্দির খুঁজে, আবার কখনো গরুর গোশতের ধুয়া তুলে নানাভাবে হয়রানি করে। নবির প্রতি দরদ ও ভালোবাসা প্রকাশের স্বার্থে আমাদেরকে নিন্দা জানাতেই হবে। মুসলিম বিশ্বের সাথে একাত্ম হয়ে আমরাও ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে পারি। এতে তারা উপলব্ধি করবে, নবির প্রতি কটূক্তি করে মুসলমানদের দিলে আঘাত হানলে পরিণতি ভালো হয় না।
আল্লাহপাক তাঁর নবির চরিত্রের সাক্ষ্য দিয়েছেন এই বলে ‘ওয়া ইন্নাকা লা’আলা খুলুকিন আজিম’ অর্থাৎ এবং নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী- সুরা কলম ৪। আরবের মুশরিকরা কখনই আমাদের নবির চরিত্রের প্রতি প্রশ্ন তুলতে পারেনি। রসুলুল্লাহ সা. ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছরের এক বিধবা মহিলাকে বিয়ে করে দাম্পত্য জীবন যাপন করেছেন। অন্যান্য বিয়ে সবই মা খাদিজা রা.-এর ইন্তেকালের পরে। মা আয়েশা রা. তাঁর একমাত্র কুমারি স্ত্রী। তাঁর সকল বিয়ে হয় আল্লাহর নির্দেশে বা সামাজিক কোনো প্রয়োজনে। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশেই নবুয়তের দশম বছরে রসুলুল্লাহ সা. আয়েশা রা.-কে বিয়ে করেন। ছয় বছর বয়সে তাঁকে বিয়ে করলেও তাঁদের দাম্পত্য জীবন শুরু হয় তিন বছর পরে মদিনায় হিজরত করার পর। এই বিয়ে নিয়ে আরবে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। সম্প্রতি বিয়েতে বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। খতিব মহোদয় বলেন তাঁর মা’র বিয়ে হয়েছিল বারো বছর বয়সে। অতীতে অনেকের বিয়েই অল্প বয়সে সাধিত হয়েছে। ইসলামে বিয়েতে বয়স নয়, ছেলে-মেয়ের সাবালকত্ব প্রকাশ পেলেই বিয়ে দেয়া যায়। আসলে প্রশ্ন সেটি নয়, প্রশ্ন নবির চরিত্রের প্রতি আঘাত হেনে মুসলমানদের কলিজায় আঘাত দেয়া। মুসলমানদের সাথে শত্রুতায় মুশরিকদের যতো আনন্দ।
কাফের-মুশরিকরা সর্বদাই
ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণে একাট্টা এবং এরা সব সময়ই প্রিয়তম নবি সা.-এর
চরিত্রহননে সচেষ্ট। কোনো কোনো সময়ে মুসলমানদের মাঝেও নবিবিদ্বেষী লোকজনের অস্তিত্ব
লক্ষ করা যায়। এরা মূলত মুরতাদ। এমন পরিস্থতিতে অতীতেও প্রকৃত ঈমানদাররা জেগে
উঠেছে এবং বর্তমানেও সেটি লক্ষণীয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বস্তরের মানুষ
প্রতিবাদে শরীক হচ্ছেন। হাজারো চেষ্টা চালিয়েও কাফের-মুশরিক -মুনাফিক গোষ্ঠী
আমাদের নবির চরিত্রের উপর অতীতে কোনো কালিমা লেপন করতে পারেনি, এখনো পারবে না।
দেশে দেশে ইসলাম গ্রহণের স্রোত কুচক্রীরা বন্ধ করতে পারবে না ইনশা- আল্লাহ। এখন
প্রয়োজন সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে প্রকৃত মুসলমানদের নবিপ্রেমে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
আল্লাহপাক আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলার
তৌফিক দান করুন। আমিন। সংক্ষেপিত।
১০.০৬.২০২২ তারিখ
কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জুমার খুতবা।
Comments
Post a Comment