বিসমিল্লাহির
রহমানির রহিম
আমল আরবি শব্দ। বাংলায় বলি কাজ। আমলে সালেহ অর্থ নেক কাজ। আমল বা কাজকে আমরা দুভাগে ভাগ করি। নেক কাজ ও বদ কাজ। দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আল্লাহপাক প্রায়ই বলেছেন ‘যারা ইমান এনেছে ও সৎ কাজ করেছে’। আমলে সালেহ সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই অস্পষ্ট। আমলদার লোক মানেই আমাদের স্মৃতিপটে ভেসে উঠে এমন কিছু বুড়ো মানুষ যাদের চুল-দাঁড়ি সাদা হয়ে গেছে, পোশাক-পরিচ্ছদও সাদা ধবধবে এবং অধিকাংশ সময় মসজিদে অতিবাহিত করেন; বলা যায় সংসার থেকে অবসরপ্রাপ্ত নির্ঝঞ্ঝাট ও নির্বিবাদ একজন মানুষ। আমাদের সমাজে কাজ না করার নাম আমল। সংকীর্ণ অর্থে আমল বলতে সাধারণের ধারণা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তাসবিহ-তাহলিল ও নফল ইবাদত-বন্দেগি এবং যারা এসব কাজে যত বেশি অগ্রণী তারা ততবেশি আমলদার। নিঃসন্দেহে এসবও নেক আমল। কিন্তু আল্লাহপাক যে নেক আমলের বিনিময়ে ব্যক্তিকে দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্য দান করবেন এবং একটি জাতিকে বিশ্বনেতৃত্বের আসনে সমাসীন করবেন তা কি শুধু এসব ইবাদত-বন্দেগি ও নফল আমলের বিনিময়ে। কক্ষণই না।
আমরা নামাজে প্রায়ই একটি ছোট্ট সুরা (আসর) পড়ে থাকি, যা মক্কায় প্রাথমিককালে অবতীর্ণ। আল্লাহপাক এই সুরায় সময়ের কসম খেয়ে বলেছেন, নিশ্চয়ই সকল মানুষ ধ্বংস ও ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত- তারা ছাড়া যারা ইমান এনেছে ও নেক আমল করেছে এবং পরস্পরকে হকের নসিহত করেছে ও ধৈর্যধারণের উৎসাহ জুগিয়েছে। মনে রাখতে হবে সেসময়ে নামাজ-রোজার মতো আমল ফরজ হয়নি। এখানে আল্লাহ তায়ালা নেক আমলের কোনো ফিরিস্তিও দেননি। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও প্রকৃতি যেসব কাজ ভালো বলে এবং যে ভালো সর্বজন স্বীকৃত সেগুলোই নেক কাজ। আল্লাহর বাণী, ‘আর আমি ভালো ও মন্দ উভয় পথ তার জন্য সুস্পষ্ট করে রেখে দিয়েছি’- সুরা বালাদ ১০। সুরা আল কিয়ামাহ ২য় আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে একটি নফসে লাওয়ামাহ (বিবেক) আছে। অসৎ কাজ করলে সে তাকে তিরস্কার করে’। মানুষের প্রকৃতিতে আল্লাহপাক ভালো-মন্দের ধারণা দিয়ে রেখেছেন এবং মন্দ কাজ করলে তার বিবেকই তাকে বাধা প্রদান করে। মানুষের প্রকৃতি যে কাজকে নেক বলে (যদি আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণার পরিপন্থি না হয়) সেটিই নেক কাজ। যেমন, সত্যকথা বলা, আমানত সংরক্ষণ করা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন করা, মাপে-ওজনে সঠিক পরিমাপ করে দেয়া, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা- জনহিতকর সকল কাজই নেক কাজ এবং জনকল্যাণ ব্যাহত করে সকল কাজ, আচরণ, লেনদেন সবই বদ কাজ।
আল্লাহপাক ইমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠীকে জমিনে খেলাফত দানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। তাঁর বাণী - ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ইমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খেলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দ্বীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক’- সুরা নুর ৫৫। এর মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। এ এমন নেক আমল যার অধিকারীকে আল্লাহ তায়ালা রাজত্ব দিতে চান এবং যেসব আমলের অধিকারী হওয়ার কারণে আজ ইউরোপ-আমেরিকা বিশ্ব শাসন করছে। ইমান না আনার কারণে তারা আখেরাতে কোনো বিনিময় পাবে না কিন্তু দুনিয়ায় তারা ভালো কাজের সুফল লাভ করছে। আল্লাহর বাণীও তাই, যারা দুনিয়ার সওয়াবের আশায় কাজ করে আমি তাদেরকে দুনিয়া থেকে দেই। আর যারা পরকালের সওয়াবের আশায় কাজ করে তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে পাবে।
আল্লাহপাক মানুষকে কেবল তাঁরই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এই ইবাদতের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় আল্লাহর হুকুম মেনে চলার নামই ইবাদত। অর্থাৎ আল্লাহ যা বলেছেন সেটা করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। আল্লাহর হুকুম মেনে চলা ও নিষেধ থেকে বিরত থাকার নামই নেক আমল। মানুষ সার্বক্ষণিক যাতে আল্লাহর গোলামী করতে পারে তার জন্য প্রস্তুতিস্বরূপ আল্লাহপাক কিছু মৌলিক ইবাদত ফরজ করেছেন। তন্মধ্যে নামাজ প্রধান এবং নামাজই বেহেশতের চাবী। বেহেশতের দরজা খোলার জন্য নামাজ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু নামাজ আমাদের কী শেখায়? নামাজ মূলত জিকির। ঘুম ভাঙ্গার পর একজন মুসলিমের প্রথম কাজ আল্লাহর স্মরণে মসজিদে হাজির হয়ে প্রমাণ করা যে, সে আল্লাহর গোলাম। প্রতি নামাজে প্রতি রাকাতে আল্লাহপাক তাঁর বান্দার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করেন, ‘আমরা তোমারই গোলামী করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।’ এই স্বীকারোক্তি প্রদানের সাথে সাথে বান্দা তার রবের কাছে হেদায়াত প্রার্থনা করে, ‘তুমি আমাদেরকে সরল সোজা পথ দেখাও।’ নামাজের মধ্যে হেদায়াত প্রার্থনার অর্থ হলো, নামাজ নিজে হেদায়াত নয় বরং নামাজের বাইরে সমগ্র জীবন আল্লাহর বিধান মতো চলার প্রশিক্ষণ। আবার সুরা জুমায় বলা হয়েছে, ‘নামাজ সমাপনান্তে তোমরা জমিনে বেরিয়ে পড়ো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো।’ মানুষ তার কর্মজীবনে আল্লাহকে স্মরণে রেখে হারাম-হালাল মেনে চলার তাগিদই এখানে দেয়া হয়েছে।
আল্লাহর গোলামী করা অর্থাৎ বেশি বেশি নেক আমল করা তখনই সম্ভব যখন মানুষের মাঝে আল্লাহর স্মরণ ও ভয় জাগরুক থাকে। আমরা যে আল্লাহর গোলাম সেটি বারবার নামাজ আমাদেরকে স্মরণ করে দেয়। নামাজ যেমন আল্লাহর স্মরণ তেমনি রোজা মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করে। সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার বর্জনের নাম রোজা নয় বরং এর মধ্য দিয়ে আল্লাহর হুকুম পালনে অভ্যস্ত করে তোলাই রোজার উদ্দেশ্য। আল্লাহ খুব গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কর্ম থেকে দূরে রাখে’- আনকাবুত ৪৫। যদি দূরে না রাখতে পারে তাহলে এমন নামাজে আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নেই। রোজা রেখে যদি মানুষ মিথ্যা, গিবত ও অন্যায় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে না পারে এমন রোজাতে ক্ষুধা ও পিপাসায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া তার ভাগ্যে কিছুই জুটে না।
তাকওয়ার কিছু আনুষ্ঠানিকতা এবং নিয়ম রক্ষা করা আল্লাহর কাছে বড় কিছু নয় বরং বড় বিষয় হলো মানুষের ব্যবহারিক জীবনে কতটুকু সে আল্লাহকে মান্য করে চলতে পারে। আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ ফেরাও তাতে কোনো পুণ্য নেই, বরং সৎকাজ হচ্ছে এই যে, মানুষ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব ও নবিদেরকে মনেপ্রাণে মেনে নেবে এবং আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রিয় ধন-সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও দাসমুক্ত কাজে ব্যয় করবে। আর নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত আদায় করবে। যারা প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করে, ক্ষুধা-দারিদ্র, বিপদে-আপদে এবং হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে পরম ধৈর্য অবলম্বন করে- এরাই হচ্ছে সত্যবাদী এবং এরাই হচ্ছে প্রকৃত মুত্তাকি’- সুরা বাকারা ১৭৭। এই হলো আল্লাহ প্রদত্ত মুত্তাকির যথার্থ ব্যাখ্যা।
আল্লাহপাক দাওয়াতের সূচনায় তাওহিদ, রেসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসের পাশাপাশি মানুষের নৈতিক চরিত্রের পরিশুদ্ধির জন্য তাগিদ দিয়েছেন। আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি সুরা আসরে আল্লাহপাক ইমান আনার সাথে সাথে নেক আমলের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। সুরা হুমাজায় বলেছেন, নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা সামনি গালাগাল করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে; সুরা মাউনে আখেরাতে অবিশ্বাসীদের চরিত্র উল্লেখ করা হয়েছে, যারা ইয়াতিমকে ধাক্কা দেয় ও মিসকিনকে খাবার দিতে উৎসাহিত করে না এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস অপরকে দেয়া থেকে বিরত থাকে; সুরা লাহাবে তার স্ত্রীর চরিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে কূটনী বুড়ি বলে যে লাগানো ভাঙানো চোগলখুরী করে বেড়ায়; সুরা তাকাসুরে বেশি পাওয়ার মোহ মানুষকে গাফেল করে রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে; সুরা আল কারিয়াহে পাল্লা ভারী ও হালকা হওয়ার কথা বলে তার পরিণতির কথা বলা হয়েছে। সে সময়ে অবতীর্ণ সুরা বা আয়াতসমূহে তৎকালীন সমাজের কদর্য চিত্র তুলে ধরে ইমানদারদের তা থেকে দূরে থাকার আহবান জানানো হয়েছে।
রসুলুল্লাহ সা. তাঁর উম্মতদের ব্যবহারিক জীবন ও আচার-আচরণ সুন্দর করার জন্য কতভাবেই না চেষ্টা করেছেন। হাদিসের বাণীসমূহ যদি উল্লেখ করা যায় মনে হবে সব সওয়াব রয়েছে উত্তম আচরণ ও নেক আমলের মধ্যে। আল্লাহপাক তাঁর রসুল সা.-এর জীবনাদর্শে রেখেছেন উম্মাহর জন্য উত্তম আদর্শ এবং তাঁকে অনুসরণ ও অনুকরণের মধ্যে রেখেছেন দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতের নাজাত। মুহাম্মদ সা. ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। মানবজীবনের সকল সৎ গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। আল্লাহ নিজেই সার্টিফাই করেছেন, ‘অবশ্যই তুমি সুমহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত’- সুরা আল কলম ৪।
সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা ও প্রতিশ্রুতি পালনের মতো মৌলিক মানবীয় গুণে ভূষিত মুহাম্মদ সা. ইসলামপূর্ব যুগে তাঁর জাতির কাছে ছিলেন আল আমিন ও আস সাদিক এবং তিনি ছিলেন সর্ব জনপ্রিয় একজন আদর্শ মানব। তিনি ছিলেন সকলের আশ্রয় ও কল্যাণকামী এবং সবার ধনমাল, মান-ইজ্জত তাঁর কাছে ছিল নিরাপদ। তাই মুহাম্মদ সা. নবুওয়াত লাভের পর হেরাগুহা থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় খাদিজা রা.-এর কাছে ফিরে আসলে মা খাদিজা রা. তাঁকে একথাই শুনিয়েছিলেন, আপনার কোনো ভয় নেই কারণ আপনি গরীব-দুখীর সহায় ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণকারী। সদাচরণ উত্তম চরিত্রের অন্যতম গুণ। ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘লোকদের মধ্যে সেই উত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর’- কানজুল উম্মাল।
আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন, 'তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠতম উম্মত হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে, তোমরা মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে' (সুরা আলে ইমরান ১১০)। এখানে আল্লাহপাক আদেশ দানের কথা বলেছেন। আদেশ দান তারাই করতে পারে যাদের হাতে সমাজের কর্তৃত্ব থাকে। উপলব্ধি করা যায়, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের সমাজে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে দেখতে চান। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হতে হলে উম্মাহকে হতে হবে উদার ও প্রশস্ততার অধিকারী এবং সকল সৃষ্টির কল্যাণকামী। এ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা.-এর বাণী উল্লেখ করতে চাই।
আব্দুল্লাহ রা. বর্ণনা করেন, ‘রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, সৃষ্টি হলো আল্লাহর পরিবার। সুতরাং আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি সে, যে তাঁর পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণ করেন’- বায়হাকি।
জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ তার প্রতি করুণা করেন না, যে মানুষের প্রতি করুণা করে না’- বুখারি।
আমরা যদি মুহাম্মদ সা.-এর জীবন ও হাদিসের দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখবো সৃষ্টির প্রতি সদাচরণ, মানুষের ব্যবহারিক জীবন ও লেনদেনে স্বচ্ছতা এবং জনকল্যাণ সাধনই ইসলামের মৌলিক দাবী। এই দাবী তখনই পূরণ হওয়া সম্ভব যখন আল্লাহর দ্বীন ইসলাম সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। মক্কায় মুসলমানরা যখন প্রচণ্ডভাবে নির্যাতিত হচ্ছিলেন এমন অবস্থায় সাহাবায়ে কেরাম রসুলুল্লাহ সা.-কে জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমরা তো আর পারি না, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? জবাবে তিনি বলেন, অতীতে যারাই ইমান পোষণ করেছেন তাদের কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, কাউকে করাতে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে, কারো শরীর থেকে গোশত আলাদা করা হয়েছে এবং এতো অত্যাচার-নির্যাতনের পরেও তারা ইমান ত্যাগ করেননি। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন একজন ষোড়শী স্বর্ণালঙ্কারসহ সানা থেকে হাজরা মাউত একাকী হেঁটে যাবে, তাকে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতে হবে না। রসুলুল্লাহ সা. তাঁর সাথীদের একটি নিরাপদ সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
আল্লাহপাক সকল নবি-রসুলকে একটি মাত্র দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন- ‘দ্বীন কায়েম করো’- সুরা আশ শুরা ১৩ অর্থাৎ অসৎ ও খোদাবিমুখ নেতৃত্বকে পরিবর্তন করে খোদামুখি নেতৃত্ব কায়েম করো। সর্বশেষ রসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য বলতে গিয়ে আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘তিনি আপন রসুলকে হেদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করতে পারেন যদিও শিরকবাদীগণ মোটেই বরদাশত করবে না’- সুরা সফ ৯, সুরা তওবা ৩২ ও সুরা ফাতহায় ২৮। সমাজে অসৎ ও খোদাবিমুখ নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত রেখে নিছক ওয়াজ-নসিয়তের মাধ্যমে যে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয় তার বড় প্রমাণ আল্লাহপাকের কিতাব ও নবি-রসুলদের জীবন-ইতিহাস। দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ এবং এটিই সর্বোত্তম আমল; এর সাথে কোনো কিছু তুলনীয় নয়। দ্বীন প্রতিষ্ঠায় যারা নিজেদেরকে নিয়োজিত করবে আল্লাহপাক তাদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে জান্নাতে দাখেলের প্রকাশ্য ঘোষণা দান করেছেন (সুরা আস সফ ১০-১২)।
আমাদের সমাজে প্রচলিত কয়েকটি সওয়াবের কাজকে দৃষ্টান্তস্বরূপ তুলে ধরে আল্লাহপাক বলেছেন আল্লাহর রাস্তায় প্রচেষ্টা (জিহাদ) চালানোর চেয়ে উত্তম আমল আর নেই। আল্লাহর ভাষায়- ‘তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো ও কাবা ঘর আবাদ করাকে সে ব্যক্তির কাজের সমপর্যায়ের মনে করো- যে ব্যক্তি ইমান এনেছে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে, এরা কখনো আল্লাহর কাছে সমান নয়; আর আল্লাহ জালেমদের পথ দেখান না। আল্লাহর কাছে অতি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী তারাই যারা আল্লাহর ওপর ইমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং জান-মাল দিয়ে জিহাদ করেছে। তারাই সফলকাম’- সুরা তওবা ১৯-২০।
উম্মাহর
জন্য দুর্ভাগ্য যে, তারা আমল নিয়ে এক বড় ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছে। দোয়া-দরুদ
ও নফল ইবাদত-বন্দেগিকে যতো প্রাধান্য দিচ্ছে তার এক শতাংশও ইসলামকে ব্যবহারিক
জীবনে মেনে চলার বাধ্যবাধকতা ও জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা নিয়ে
কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। ফলে অতি নামাজী, কালামী, হাজী দরবেশ প্রকৃতির লোকটিকেও
ইসলামের দুশমনদের সাথে দোস্তি করতে দেখা যায়। ইসলামের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব যে
তার সকল আমল বরবাদ হয়ে যাচ্ছে- এই উপলব্ধি তার নেই। এ যেন আব্দুল্লাহ বিন উবাই-এর
সার্থক উত্তরাধিকার- যার নামাজ, রোজা, তাসবিহ, তাহলিল সব কিছু থাকার পরও ইসলামের
বিজয় না চাওয়ার কারণে মুনাফিক সরদার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আমাদের আচরণও
অনেকখানি তাই। আল্লাহপাক আমাদেরকে হেফাজত করুন। ১৩.১১.২০২১।
Comments
Post a Comment