ইসলাম আল্লাহপাক প্রদত্ত এক পূর্ণাঙ্গ দ্বীন (জীবনব্যবস্থা)। জীবনের পরিধি যতখানি ইসলাম ঠিক ততখানি। সমাজ, সামাজিকতা, বিনোদন কোনো কিছু ইসলামে উপেক্ষিত নয়। আমাদের ধারণায় যে ব্যক্তি সমাজ থেকে যতবেশি বিচ্ছিন্ন ও ধর্মীয় আচার-আচরণে নিষ্ঠাবান সে ততবেশি মুত্তাকি। দ্বীনের এই সংকীর্ণ ধারণার কারণেই আমাদের সমাজে অনেক ইমানদার ব্যক্তি আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগিতে যতটা নিষ্ঠাবান সেই তুলনায় ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি বা মানুষের সাথে আচার-আচরণ ও লেনদেনে ইসলামকে অনুসরণের ক্ষেত্রে ততটা নিষ্ঠাবান নন এবং সামাজিক জীবনে এত ঘুষ-দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচারের অন্যতম কারণও এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। এই শ্রেণির লোকদের দ্বারা সমাজ সামান্যই উপকৃত হয়।
রসুল সা.-এর জীবন তা বলে না এবং আল্লাহ তায়ালারও তাতে কোনো সমর্থন নেই। মুহাম্মদ সা. নবি হওয়ার পূর্বেই সমবয়সীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন হিলফুল ফুজুল। তাঁদের কাজ ছিল অসহায়দের সহায়তা, বিবাদ -বিসংবাদ মিটিয়ে ফেলা, দুর্বলকে সহায়তা দান এবং জালেমকে বিরত রাখা। সামাজিক কাজে অগ্রণী ছিলেন বলেই হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) সরানো বিবাদে সবাই তাঁকে ফয়সালাকারী মেনে নিয়েছিল। এটা আল্লাহপাকেরই সুন্নাত, সমাজের কল্যাণে যারা কাজ করে সামাজিক নেতৃত্ব তাদের হাতে দেয়া আল্লাহর নিয়ম। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো ধর্মপরায়ণ (?) জনগোষ্ঠী সামাজিক কাজেকর্মে সব সময় পশ্চাতে থাকতে চায়, ফলে সামাজিক নেতৃত্ব অসৎ ও ধর্মবিমুখ জনগোষ্ঠীর দখলে।
সমাজে যত অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন তার মূলে রয়েছে অসৎ নেতৃত্ব। সমাজের ভালো মানুষগুলো নিষ্ক্রিয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই নিষ্ক্রিয়তাকেই শয়তান ধার্মিকতা হিসেবে চালিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। অথচ এই মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেছেন, 'তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠতম উম্মত হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে, তোমরা মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে' -সুরা আলে ইমরান ১১০। এখানে আল্লাহপাক আদেশ দানের কথা বলেছেন। আদেশ দান তারাই করতে পারে যাদের হাতে সমাজের কর্তৃত্ব থাকে। উপলব্ধি করা যায়, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের সমাজে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে দেখতে চান।
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রসুল প্রেরণ করেছেন। রসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য বলতে গিয়ে আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘তিনি আপন রসুলকে হেদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করতে পারেন যদিও শিরকবাদীগণ মোটেই বরদাশত করবে না’- সুরা সফ ৯। সুরা তওবায় (৩২ নং আয়াত) একই ভাষায় বলা হয়েছে এবং সুরা ফাতহায় (২৮ নং আয়াত) বাক্যের শেষে বলা হয়েছে আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট।
একথা স্পষ্ট যে, তাগুতের অধীনে ধার্মিকতার (?) জীবন মুসলমানের নয়। বরং তাগুতকে অস্বীকার করে জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করে একনিষ্ঠভাবে তাঁর দাসত্ব করার মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ। এজন্য প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। সমাজে ভালো বা মন্দ কোনো কাজই একক চেষ্টায় হয়ে উঠে না। ফিতরাতের ধর্ম ইসলাম এ থেকে ব্যতিক্রম নয়। বিচ্ছিন্ন নয় ঐক্যবদ্ধতাই শক্তি। নানাভাবে তা ব্যক্ত করা হয়েছে। তিনজন ব্যক্তি সফরে গেলে সেখানে একজনকে দলনেতা নিয়োগ করে চলার তাগিদ দেয়া হয়েছে। জামায়াতের (দলবদ্ধতার) উপর রয়েছে আল্লাহর রহমত। তাই নিজেদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব ও কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে সকল পেশাজীবীর মাঝে রয়েছে সংগঠন। সামাজিক কাজেকর্মে প্রশংসার পাশাপাশি রয়েছে নিন্দাবাদ ও নানা ঝামেলা-ঝক্কি। এতে দুর্বলমনা মানুষ সহজেই ঝরে যায়। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা। 'নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’- সুরা বাকারা ১৫৩। হতোদ্যম না হয়ে যারা লেগে থাকে আল্লাহর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন তারাই লক্ষ করে।
সমাজে দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ অন্যায় করবে এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহপাক দেখতে চান তাঁর বান্দা ও খলিফাগণ দুষ্টামির মোকাবিলায় কতটুকু ভূমিকা রাখে। এই পৃথিবী ততক্ষণ ধ্বংস হবে না যতক্ষণ সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আল্লাহর কিছু বান্দা মানুষকে ভালোর দিকে ডাকতে থাকবে। আমরা হাদিস থেকে জানতে পাই, একটি জনপদ ধ্বংস করে দেয়ার জন্য আল্লাহ ফেরেশতা পাঠান। ফেরেশতা এসে আল্লাহর এক আবেদকে ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত দেখতে পান। তারা ফিরে গিয়ে আল্লাহকে জানালে তখন আল্লাহ সেই আবেদসহ জনপদকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এর উক্তি লক্ষণীয়, 'এই পৃথিবী কখনো খারাপ মানুষের খারাপ কর্মের জন্য ধ্বংস হবে না, যারা খারাপ মানুষের খারাপ কর্ম দেখেও কিছু করে না তাদের জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে।'
তাই নীরব না থেকে আল্লাহর খলিফা হিসেবে নিজেরা খারাপ চিন্তা ও কর্ম থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি সীমিত শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে সমাজ সংশোধন ও সামাজিক কল্যাণে এগিয়ে যেতে হবে। রসুলুল্লাহ সা. মক্কায় খুব নাজুক অবস্থায় ছিলেন। বিপুল পরিমাণ নৈতিক শক্তির অধিকারী হলেও ইসলামের দাওয়াত দানের কারণে মক্কায় তাঁর সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্ব কিছুই ছিল না। তারপরও আবু জেহেলের কাছ থেকে জনৈক ইয়াতিম বালকের সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য ইয়াতিমের অনুরোধে মুহাম্মদ সা. আবু জেহেলকে গিয়ে বলেন। আবু জেহেল তাৎক্ষণিক মুহাম্মদ সা.-এর আহবানে সাড়া দিয়ে ইয়াতিমের মাল-সামান ফিরিয়ে দেন।
মুহাম্মদ সা.-এর সততা-বিশ্বস্ততা-আমানতদারিতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন তাঁর সমাজের আস্থাভাজন ব্যক্তি। নিরাপত্তার জন্য জনগণ তাঁর কাছে টাকা পয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী আমানত রাখতেন। এ-কাজে তাঁর কোনো বিরক্তি বা অনাগ্রহ ছিল না। মক্কা থেকে যখন তিনি মদিনায় হিজরত করেন সে-সময়ে তিনি তাঁর কাছে গচ্ছিত মাল-সামান প্রকৃত মালিককে বুঝে দেয়ার জন্য আলী রা.-কে তাঁর ঘরে রেখে যান। এ-সবই সামাজিক কল্যাণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একজন দ্বায়ী ইলাল্লাহর দাওয়াত তখনই ফলপ্রসূ হয় যখন মানুষ তাকে সামাজিক কাজেকর্মে অগ্রসর দেখে।
মুহাম্মদ সা. ছিলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম সমাজ সংস্কারক এবং সামাজিক কল্যাণ সাধনকারী। এই পৃথিবীতে তাঁর আগমন হয়েছিল এমন এক যুগে ও সমাজে যে সময়ে তাঁর সমাজ ছিল সবচেয়ে অধপতিত ও মনুষ্যবাসের অনুপযোগী। সমাজে ছিল হাজারো সমস্যা। মারামারি, কাটাকাটি, হিংসা-বিদ্বেষ, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই, যিনা-ব্যাভিচার, হত্যা-লুন্ঠন এবং নারী জাতির অবস্থা ছিল বড় করুণ এমন কি কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। ধনী-গরীবের মধ্যে ছিল আকাশচুম্বি বৈষম্য। চালু ছিল দাসপ্রথা, হাটেবাজারে মানুষ কেনাবেচা হতো। এমনি সমাজে আবির্ভাব ঘটে মানবতার বন্ধু নবি মুহাম্মদ সা.-এর।
নবুয়ত লাভের পূর্বে দীর্ঘ ৪০টি বছর তিনি তাঁর সমাজে অতিবাহিত করেছেন। সমাজের অন্যান্যদের থেকে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। মানুষের জীবনের সকল সৎ গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। সর্বদা সত্য বলা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন, আমানত সংরক্ষণ, গরীব-দুখীর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ, ব্যবসায়ে সততা সবই ছিল তাঁর মাঝে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত পরিসরে সমাজের কিছু কল্যাণ সাধন করলেও সামগ্রিকভাবে সমাজ সংশোধন ও সমাজের মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি। কিন্তু তিনি সমাজ বিমুখ ছিলেন না। সততার মূর্ত প্রতীক এবং কল্যাণকামী হিসেবে নিজেকে সমাজের মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সমাজকল্যাণে রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রথমত কর্মসূচি ছিল ব্যক্তি উন্নয়ন এবং তাঁর দাওয়াত কবুলকারীকে একজন সমাজকর্মী হিসেবেই তিনি গড়ে তুলেন। তিনি এবং তাঁর সাথীরা ছিলেন যথার্থই এক একজন কল্যাণকামী। সমাজের মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী। রসুলুল্লাহ সা.-এর নিজের আচরণ ও বাণীসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিলে উপলব্ধি করা যায় যে, যত সওয়াব সবই রয়েছে মানুষের সাথে সদাচরণ ও তাদের প্রয়োজন পূরণের মধ্যে। অভুক্তকে খাদ্যদান, ইয়াতিমকে লালন-পালন, বিবাদ-বিসংবাদ মেটানো, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা, ব্যাপক সালামের প্রচলন সবই সওয়াবের কাজ। আবার সমাজের অকল্যাণ হয় এমন সকল অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার মধ্যেও রয়েছে সওয়াব।
মক্কায় সমাজটি ছিল অসৎ নেতৃত্বের অধীন। তাই সমাজের সামগ্রিক সংশোধন ও কল্যাণ সাধন মুহাম্মদ সা.-এর পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি। বরং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই ছিল কঠিন। ইসলাম আল্লাহপাক প্রদত্ত এবং নবি সা.-এর নেতৃত্বে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত। সেই সমাজে হাজারো সমস্যা ছিল কিন্তু আল্লাহপাকের নির্দেশক্রমে তিনি কোনো একটি সমস্যাকে ইস্যু করে অগ্রসর হননি। কী দাসমুক্তি বা নারীমুক্তি বা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা কোনো কিছু তাঁর আন্দোলনের ইস্যু ছিল না। তিনি সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত হয়ে মানুষের কাছে উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘হে দুনিয়ার মানুষ! তোমরা বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাহলেই তোমরা সফলকাম হবে’।
রসুলল্লাহ সা.-এর দাওয়াতের বিষয় ছিল তাওহিদ। আল্লাহর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা। সাথে সাথে রেসালাত ও আখেরাতকে বিশ্বাস করার জন্য তিনি মানুষের প্রতি আহবান জানান। সমাজে যত জুলুম- নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার তার মূলে রয়েছে পরকালের প্রতি অবিশ্বাস ও জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা থেকে নিজেকে মুক্ত ভাবা। রসুলুল্লাহ সা.-এর দাওয়াতে সমাজের অপেক্ষাকৃত নীতিবান লোকগুলো সাড়া দেন। সে-সময়ে না ছিল নামাজ, না ছিল রোজা না আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগি। মানুষকে নৈতিক চরিত্রে ভূষিত করার লক্ষ্যে ছোট্ট ছোট্ট সুরায় আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের সাথে সাথে চারিত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার পন্থা অবলম্বন করা হয়।
নবুয়তের প্রাথমিক অবস্থায় অবতীর্ণ সুরাসমূহে বারবার আহবান জানানো হয়েছে ইমানের সাথে নেক কাজ করার (সুরা আসর), নৈতিক ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত থাকা, যেমন মানুষকে হেয় করা, গালিগালাজ করা ও পেছনে দোষ প্রচার করা, কার্পণ্য করা (সুরা হুমাজা)। ইসলামে নেক কাজের কোনো ফিরিস্তি দেয়া হয়নি। বরং মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও প্রকৃতি যে কাজটাকে সমর্থন করে সেটিকেই নেক কাজ বলা হয়েছে। সত্য কথা বলা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন, আমানত সংরক্ষণ, আল্লাহর সৃষ্টির সাথে সদাচরণ, গরীব-দুখী ও অসহায়কে সহায়তা করা, সমাজে বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়ে ফেলা, অন্যায় দূর করা সবই নেক কাজের উদাহরণ। রসুলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাহাবিরা ছিলেন ইমানের সাথে নেক কাজে অগ্রগামী। সমাজে এ-সব ভালো লোকের প্রভাব অসাধারণ। তাঁরা কেউ ধার্মিকতার আড়ালে সমাজবিচ্ছিন্ন ছিলেন না। মুহাম্মদ সা. নবুওয়াত লাভের পর হেরাগুহা থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় মা খাদিজা রা.-এর কাছে ফিরে আসলে তিনি একথাই শুনিয়েছিলেন, আপনার কোনো ভয় নেই কারণ আপনি গরীব-দুখীর সহায় ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণকারী।
ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী অর্থাৎ একজন মুসলিম মাত্রই সমাজকর্মী। একজন মুসলমানের কাছে তার মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি শুধু নিরাপদই নয় বরং তাদের অভাব-অভিযোগ ও সকল সমস্যার সমাধানের সাথী। প্রতিবেশিকে অভুক্ত রেখে তৃপ্তিভরে পানাহারকারীকে রসুলুল্লাহ সা. মোমিন বলেননি। তরকারিতে একটু ঝোল বেশি দিয়ে প্রতিবেশিকে দেয়ার জন্য বলেছেন। আল্লাহর ইবাদতের সাথে সাথে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত, মুসাফিরদের প্রতি সদয় হওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ নিজেই। হাদিসের ভাষায় গোটা সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। আব্দুল্লাহ রা. বর্ণনা করেন, ‘রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, সৃষ্টি হলো আল্লাহর পরিবার। সুতরাং আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি সে, যে তাঁর পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণ করেন’- বায়হাকি।
জারীর
ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ তার
প্রতি করুণা করেন না, যে মানুষের প্রতি করুণা করে না’- বুখারি।
মুহাম্মদ সা. ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। মানবজীবনের সকল সৎ গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। আল্লাহ নিজেই সার্টিফাই করেছেন, ‘অবশ্যই তুমি সুমহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত’- সুরা আল কলম ৪।
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘লোকদের মধ্যে সেই উত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর’- কানজুল উম্মাল। একজন চরিত্রবান ব্যক্তি থেকে আল্লাহর সকল সৃষ্টি নিরাপদ। মানুষের সেবা করা সম্পর্কীয় অসংখ্য উক্তি রসুলুল্লাহ সা. থেকে জানা যায়।
আবু শোরাইহ্ আল খুযা’ঈ রা. থেকে বর্ণিত, ‘নবি সা. বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ইমান রাখে, সে যেন প্রতিবেশীর কল্যাণ করে, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ইমান রাখে সে যেন অতিথিকে সম্মান করে, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ইমান রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে’- সহিহ মুসলিম।
স্বামী-স্ত্রী
এবং ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধে উস্কানি দান জঘন্য অপরাধ। পক্ষান্তরে বিরোধ মিটিয়ে দেয়া
অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। এ-প্রসঙ্গে আবু দারদা রা. বর্ণিত একটি হাদিস। তিনি বলেন,
‘রসুলুল্লাহ সা. বলেন, মর্যাদার দিক থেকে নামাজ, রোজা ও সদকার চেয়ে উত্তম বিষয়ের
ব্যাপারে আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দেব না? সাহাবিগণ বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই হে
আল্লাহর রসুল সা.। তিনি বললেন, তাহলো পরস্পরের মধ্যে সন্ধি ও সমঝোতা স্থাপন করে
দেয়া এবং পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের অবনতিই হলো বিধ্বংসী’- আবু দাউদ।
মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ সম্পর্কীয় আরো কিছু কুরআন ও হাদিস উদ্ধৃত করা যায়।
ইয়াতিম-মিসকিনের সাথে অসদাচরণকারী ব্যক্তিকে আল্লাহপাক বিচারদিবসকে অস্বীকারকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর বাণী, ‘তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছ যে বিচার দিবসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে? সে হলো ঐ ব্যক্তি যে অনাথ ইয়াতিমকে গলাধাক্কা দেয় ও মিসকিনকে খাবার দানে উৎসাহিত করে না’- সুরা আল মাউন ১-৩।
‘(জাহান্নামের আজাব থেকে) দূরে রাখা হবে ঐ আল্লাহভীরু ব্যক্তিকে, যে নিজের পরিশুদ্ধির জন্য স্বীয় সম্পদ ব্যয় করে’- সুরা আল লাইল ১৭-১৮।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবি সা. বলেন, বিধবা ও দুঃস্থ লোকদের কল্যাণে কর্মরত ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী ব্যক্তির মতো অথবা ঐ ব্যক্তির মতো যিনি দিনে রোজা রাখেন এবং রাত্রি জাগরণ করে নামাজ পড়েন’- বুখারি।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, ‘রসুলুল্লাহ সা. বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে যেতে পথিমধ্যে একটি কাঁটাযুক্ত গাছের ডাল পেয়ে তা রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল। এতে আল্লাহ খুশি হয়ে তার গুনাহসমূহ মাফ করে দিলেন’- বুখারি।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা রহমানের ইবাদত করো, লোকদেরকে খাদ্য খাওয়াও এবং বেশি বেশি সালাম প্রদান করো, তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে’- তিরমিজী।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, আমি রসুলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের হক হলো পাঁচটি। সালমের জবাব দেয়া, রোগীর পরিচর্চা করা, জানাজার অনুসরণ করা, দাওয়াত কবুল করা এবং হাঁচির পর আলহামদু লিল্লাহ বললে তার জবাবে ইয়ার হামুকাল্লাহ (আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন) বলা’- বুখারি।
সমাজে অসৎ ও খোদাবিমুখ নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত রেখে নিছক ওয়াজ-নসিয়তের মাধ্যমে যে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয় তার বড় প্রমাণ আল্লাহপাকের কিতাব ও নবি-রসুলদের জীবন-ইতিহাস। কুরআন সাক্ষ্য দেয়, যত নবি-রসুলকেই আল্লাহপাক প্রেরণ করেছেন তাদের সবাইকে একই দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন- দ্বীন কায়েম করো (সুরা আশ শুরা ১৩) অর্থাৎ অসৎ ও খোদাবিমুখ নেতৃত্বকে পরিবর্তন করে খোদামুখি নেতৃত্ব কায়েম করো এবং এ প্রচেষ্টায় সকল নবি-রসুলদের সাথে সমসাময়িক রাজা-বাদশাহ ও কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মোকাবেলা হয়েছে। রসুল সা.-এর সাথেও একই আচরণ লক্ষণীয় এবং সমাজ পরিবর্তনের পদ্ধতিও সবার একই ছিল অর্থাৎ দাওয়াত প্রদান, তাদেরকে সংগঠিত ও পরিশুদ্ধিকরণ এবং গণভিত্তি গড়ে তোলা। সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য তিনি কোনো বাঁকা পথ গ্রহণ করেননি। ইসলামের দাওয়াত প্রদান থেকে সরে এসে সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য রসুল সা.-এর নিকট আরবের কাফের- মুশরিকদের প্রস্তাবও ছিল।
কুরাইশ নেতৃবৃন্দের প্রচণ্ড বিরোধীতার কারণে মক্কার সাধারণ জনগণের ইসলামের পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে মদিনার জনগণ রসুল সা.-এর দাওয়াত কবুল করে তাঁকে মদিনায় গ্রহণের জন্য প্রস্তত হয়ে পড়েছিল। সে মুহূর্তে রসুল সা.-কে আল্লাহপাক তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে নিয়ে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজসহ একটি ইসলামী সমাজ গড়ে তোলার জন্য ১৪টি মূলনীতি দান করেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে দোয়া শিখিয়ে দেয়া হয়- ‘হে আমার পরোয়ারদিগার! আমাকে যেখানেই তুমি নিয়ে যাও সত্যতার সাথে নিয়ে যাও এবং যেখান থেকেই বের করো সত্যতার সাথে বের করো এবং তোমার পক্ষ থেকে একটি সার্বভৌম শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও’। আর ঘোষণা করে দাও- ‘সত্য এসে গেছে এবং বাতিল নির্মূল হয়ে গেছে, বাতিলের তো বিলুপ্ত হবারই কথা’- সুরা বনি ইসরাইল ৮০-৮১। অর্থাৎ তুমি নিজেই আমাকে কর্তৃত্ব দান করো অথবা কোনো রাষ্ট্রক্ষমতাকে আমার সহায্যকারী বানিয়ে দাও, যাতে তার ক্ষমতা ব্যবহার করে দুনিয়ার বিকৃত জীবনব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে পারি, অশ্লীলতা ও পাপের সয়লাব রুখে দিতে পারি এবং তোমার ন্যায় বিধান জারি করতে পারি।
রসুলুল্লাহ সা.-এর মৌলিক কাজ ছিল দ্বীন কায়েমের লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে দাওয়াত প্রদান এবং সমাজ পরিচালনার উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য তাদেরকে পরিশুদ্ধকরণ। সমাজ থেকে অন্যায় দূরীকরণ ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা তখনই সম্ভব যখন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব অসৎ লোকদের থেকে সৎ লোকদের হাতে স্থানান্তরিত হয়। সমাজের কল্যাণে যতরকমের কাজ- হতে পারে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা, কোনো বোঝাবহনকারীকে বোঝা বহনে সহায়তা করা, ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান, অসুস্থকে সেবাদান, পরিচিত- অপরিচিতকে সালাম বিনিময় করা সবই আমলে সালেহ (নেক কাজ)।
কোনো জনপদে একদল মানুষ ইমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হয়ে যদি দ্বীন প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টা চালায় এবং তাদের গণভিত্তি রচিত হয় অর্থাৎ জনপদের মানুষ সক্রিয় বিরোধীতা না করে তাহলে আল্লাহর সুন্নাত হলো তাদেরকে খেলাফত (রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব) দান করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী -
‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ইমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খেলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দ্বীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক’- সুরা নুর ৫৫।
খেলাফত
বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব, আল্লাহপাকের হাতে। ইমানদারদের কর্তব্য হবে, নিয়মতান্ত্রিক
পন্থায় কর্মতৎপর হওয়া অর্থাৎ রসুল সা. প্রদর্শিত পন্থায় অনুকূল-প্রতিকূল
সর্ববস্থায় মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছানো ও দাওয়াতে সাড়াদানকারীদের পরিশুদ্ধ করা
অর্থাৎ নেক আমলে সমৃদ্ধ করা। বান্দা হিসেবে এই দায়িত্ব পালন করলে মহান আল্লাহও
তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূরণের লক্ষ্যে আমাদেরকে ইমান ও
নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।
Comments
Post a Comment