বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেভাবে করা উচিত এবং মুসলমান না হয়ে কখনো মৃত্যুবরণ করো না। সুরা আলে ইমরান ১০২।
তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও মেহেরবানিতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো। তোমরা একটি অগ্নিকুণ্ডের কিনারে দাঁড়ানো ছিলে। আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের উদ্ধার করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলেন। হয়তো এ নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা সরল পথ দেখতে পাবে। সুরা আলে ইমরান ১০৩।
তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা কল্যাণ ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহবান জানাবে, ভালো কাজের নির্দেশ দিবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে। সুরা আলে ইমরান ১০৪।
তোমরা যেন তাদের মতো হয়ে যেয়ো না, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হিদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে তারা সেদিন কঠিন শাস্তি পাবে। সেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে। যাদের চেহারা কালো হয়ে যাবে তাদের বলা হবে, ইমানের নেয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফুরি নীতি অবলম্বন করলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এই নেয়ামত অস্বীকৃতির বিনিময়ে আজাবের স্বাদ গ্রহণ করো। আর যাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে, তারা আল্লাহর রহমতের আশ্রয় লাভ করবে এবং চিরকাল তারা এই অবস্থায় থাকবে। এগুলো আল্লাহর বাণী, তোমাকে যথাযথভাবে শুনিয়ে যাচ্ছি। কারণ দুনিয়াবাসীর প্রতি জুলুম করার কোনো এরাদা আল্লাহর নেই। আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশসমূহের সমস্ত জিনিসের মালিক এবং সমস্ত বিষয় আল্লাহর দরবারে পেশ হয়। সুরা আলে ইমরান ১০৫-১০৯।
নামকরণ : সুরার ভেতরে আলে ইমরান উল্লেখ থাকায় চিহ্নস্বরূপ এর নামকরণ করা হয়েছে আলে ইমরান।
নাজিলের সময়কাল :
এ সুরায় চারটি ভাষণ রয়েছে। প্রথম ভাষণ সম্ভবত শুরু থেকে ৪র্থ রুকুর প্রথম দুই আয়াত পর্যন্ত বদর যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে।
দ্বিতীয় ভাষণটি ৪র্থ রুকু থেকে ৬ষ্ঠ রুকু পর্যন্ত ৯ম হিজরিতে নাজরান প্রতিনিধি দলের আগমনের সময়।
তৃতীয় ভাষণটি ৭ম রুকু থেকে ১২শ রুকু পর্যন্ত। প্রথম ভাষণের সাথে সাথে নাজিল হয়েছে বলে মনে হয়।
চতুর্থ ভাষণটি ১৩শ রুকু থেকে শেষ পর্যন্ত ওহুদ যুদ্ধের পরবর্তীকালে।
বিষয়বস্তু :
আহলে কিতাব (ইহুদি ও খৃষ্টান) ও মুসলমানদের সম্বোধন করে কথা বলা হয়েছে। এই সুরায় মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি ঘটনা বদর ও ওহুদ যুদ্ধের পর্যালোচনা করা হয়েছে।
ব্যাখ্যা :
তাকওয়া শব্দের অর্থ বেঁচে থাকা বা বিরত থাকা। অর্থাৎ আল্লাহর নাফরমানি বা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। এর আর একটি অর্থ আল্লাহর ভয়। আল্লাহর ভয়ই মানুষকে গুনাহ বা তাঁর নাফরমানি থেকে দূরে রাখে। সব মানুষই আল্লাহকে কম-বেশি ভয় করে। এখানে বলা হয়েছে ভয় করার মতো ভয় বা যেভাবে ভয় করা উচিত। অন্যত্র বলা হয়েছে আল্লাহকে ভয় করো যতখানি সাধ্যে কূলায়। অর্থাৎ সর্বশক্তি দিয়ে আল্লাহকে ভয় করো। হ্যাঁ, সাধ্যের বাইরে আল্লাহর হুকুম মানা বা তাঁর নাফরমানি থেকে দূরে থাকতে না পারায় কোনো গুনাহ নেই।
আল্লাহর মর্যাদা, তাঁর বড়ত্ব, তাঁর ক্ষমতা-এখতিয়ার আমাদের উপলব্ধি করতে হবে এবং সেভাবেই তাঁকে ভয় করতে হবে ও মানতে হবে। আমাদের সমাজে কর্মচারী তার বসকে ভয় করে, সন্তান তার পিতা-মাতাকে ভয় করে এবং স্ত্রী তার স্বামীকে ভয় করে। এই ভয় করার পেছনে রয়েছে শ্রদ্ধাবোধ ও ক্ষমতা। কর্মচারী তার বসকে ভয় করে এ কারণে যে, তাকে অমান্য করলে চাকুরি হারানোর ভয় আছে; সন্তান তার পিতা-মাতাকে ভয় করে, কারণ অমান্য করলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে বা স্ত্রী তার স্বামীকে ভয় করে, কারণ সে জানে তার ভরণ-পোষণ বন্ধ করে দিতে পারে বা চরম পর্যায়ে পৌঁছলে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। দুনিয়ার জীবনে এই ভয় করার পেছনে কাজ করছে চাকুরি হারানোর, ঘর থেকে বের করে দেয়ার বা সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার।
আল্লাহর অবস্থানটা একটু উপলব্ধি করুন। আমাদের সুস্থতা, বেঁচে থাকা, আয়-উপার্জন, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি এবং পরিবার নিয়ে ভালো থাকা সবই নির্ভর করে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর। সর্বোপরি মৃত্যুর পর আখেরাতের অনন্ত জীবনের জন্য জান্নাত বা জাহান্নামও নির্ভর করছে একান্তভাবে আল্লাহর ওপর। দুনিয়ার জীবনের কল্যাণের পাশাপাশি আখেরাতে চিরস্থায়ী জান্নাত লাভ যে আল্লাহর মর্জির ওপর নির্ভর করে সেই আল্লাহকে কতখানি ভয় করা উচিত তা আমাদের উপলব্ধিতে আনা উচিত।
আল্লাহর ভয় মানুষের মধ্যে তার আচার-আচরণ, কথাবার্তা, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যবহারিক জীবনে প্রতিফলিত হয়। একজন মুত্তাকি বা আল্লাহভীরু ব্যক্তি কখনই মিথ্যা, ধোঁকা-প্রতারণা, শঠতা, ওজনে কম, ভেজাল প্রদান, ঘুষের আদান-প্রদান, মানুষকে কষ্ট দেয়া, এককথায় আল্লাহর নাফরমানির পর্যায়ে পড়ে এমন কোনো কাজের সাথে জড়িত হতে পারে না। এসবই তাকওয়ার সাথে সাংঘর্ষিক। রসুলুল্লাহ (সা) মিথ্যাকে সবচেয়ে ঘৃণা করতেন। তিনি বলেন, মিথ্যা সকল পাপের মা। আমার উম্মতেরা সব পারে, মিথ্যা বলতে পারে না ও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। আজ মিথ্যা আমাদের সমাজে জেঁকে বসেছে। মিথ্যার মধ্য দিয়ে সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। রসুল (সা) বলেছেন, একজন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটিই যথেষ্ট, সে যা শুনে সেটিই বলে বেড়ায়।
তাকওয়ার সাথে মুসলমান হওয়া অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তাকওয়ার দাবি ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। জীবনে কোনো এক সময় কালিমা তাইয়্যেবাহ্ উচ্চারণ করা বা মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করে সারাজীবন মুসলমান থাকা ফিকাহর কিতাবে বা সরকারি দপ্তরে ঠিক আছে। কিন্তু আল্লাহর দরবারে মুসলমান থাকা অর্থই হলো ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা বা আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থাকা। আল্লাহ হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, মুসলমান না হয়ে মরো না অর্থাৎ মুসলমান থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করো। আল্লাহর নাফরমানি (হুকুম অমান্য করা) অর্থই হলো ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া, আবার তাওবার মাধ্যমে ইসলামে ফিরে আসা। এটি এক নিরন্তর প্রচেষ্টা। ১৫ বছরের চাকুরি জীবনে একদিন বসের হুকুম অমান্য করলেই তার পেছনের সমস্ত অবদান নিঃশেষ হয়ে যায়। আবার স্বামী-স্ত্রীর ত্রিশ বছরের সংসার জীবনে একদিন স্বামীকে অমান্য করলেই দাম্পত্যজীবন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়।
আল্লাহর কাছে ব্যক্তির বংশ, সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা-দীক্ষা, সৌন্দর্য কোনো কিছুই গুরুত্ব বহন করে না। গুরুত্ব রয়েছে ব্যক্তির তাকওয়ায়। সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন যে তাকওয়ার অধিকারী অর্থাৎ নীতিবান। এই তাকওয়া কেবল পোশাক ও আনুষ্ঠানিক ইবাদত অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় ব্যক্তির সকল কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। নিজের ঘর থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বত্রই তার প্রতিফলন তাকওয়ার দাবি। মুত্তাকি ব্যক্তি থেকে তার স্বামী/স্ত্রী, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, প্রতিবেশি, সমাজের অন্যান্য মানুষ এমনকি ইতর প্রাণি ও বৃক্ষলতাও কল্যাণ লাভ করে।
(১০৩) আল্লাহপাক মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনের জন্য নির্দেশ প্রদান করে তাঁর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে দিয়েছেন। সুরাটি মাদানী, সেখানকার দু’টি প্রধান গোত্রের (আওস ও খাজরাজ) মধ্যে বংশ পরম্পরা মারামারি, ঝগড়া-ঝাটি ও খুনোখুনি লেগেছিল। তারা ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়েছিল। ইসলাম গ্রহণের ফলে তাদের মধ্যে গভীর ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হয়। তারা এখন আর পরস্পরের রক্তপিপাসু নয়, পরস্পরের কল্যাণে সবকিছু উজাড় করে দিতে রাজি। আল্লাহর রজ্জু অর্থাৎ দীন ইসলামকেই আসল গুরুত্বের অধিকারী মনে করে এর ভিত্তিতেই পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ প্রদান করা হয়েছে।
জামায়াতবদ্ধ জীবযাপনের জন্য আল্লাহর রসুল (সা) তাঁর উম্মতকে কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছেন। হারেস আল-আশআরী (রা) বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমি তোমাদের পাঁচটি কাজের নির্দেশ প্রদান করছি, আল্লাহ এগুলো আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এক. জামায়াত বা দলবদ্ধ হবে, দুই. নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে, তিন. তার আদেশ মেনে চলবে, চার. হিজরত করবে অথবা আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করবে এবং পাঁচ. আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। যে ব্যক্তি জামায়াত বা সংগঠন ত্যাগ করে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল সে যেন নিজের কাঁধ থেকে ইসলামের রশি বা বাঁধন খুলে ফেললো, যতক্ষণ না সে সংগঠনে ফিরে আসবে। আর যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের নিয়ম-নীতির দিকে লোকদের ডাকবে সে জাহান্নামের জ্বালানি হবে, যদিও সে রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে। আহমাদ, তিরমিযী।
জামাতবদ্ধ জিন্দেগি প্রসঙ্গে ওমর (রা) বলেন, ‘জামায়াত বা সংগঠন ছাড়া ইসলাম নেই, নেতৃত্ব ছাড়া সংগঠন নেই এবং আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্ব নেই।’
আবু সাইদ খুদরি (রা) থেকে বর্ণিত। নবি করিম (সা) বলেছেন, ‘সফরে একসঙ্গে তিনজন থাকলে তাদের মধ্য থেকে একজনকে যেন অবশ্যই আমির বা নেতা বানিয়ে নেয়’- আবু দাউদ।
আল্লাহপাক তাঁর ইমানদার বান্দাদের সুশৃঙ্খল ও আনুগত্যশীল জীবন যাপনের তাগিদ দিয়েছেন। তাঁর বাণী, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রসুলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের দায়িত্বশীলদের’- সুরা আন নিসা ৫৯।
রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমির বা নেতার আনুগত্য করলো সে যেন আমারই আনুগত্য করলো। আর যে ব্যক্তি আমির বা নেতাকে অমান্য করলো সে যেন আমাকেই অমান্য করলো’- বুখারি, মুসলিম, নাসাঈ, ইবনে মাজা, মুসনাদে আহমাদ।
(১০৪) মুসলমানদের মাঝে যে দলটি কল্যাণ ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহবান জানাবে এবং ভালো কাজের নির্দেশ দেবে ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখবে আল্লাহ তায়ালার স্পষ্ট ঘোষণা তারাই সফলকাম হবে। এখানে একটি বিষয় উপলব্ধি করার মতো, আল্লাহ ভালো কাজের নির্দেশ প্রদানের কথা বলেছেন। নির্দেশ দানের ক্ষমতা কেবল কর্তৃত্বশীলেরই রয়েছে। তাই ইমানদারদের সমাজে কর্তৃত্বের অধিকারী হতে হবে। সুরা বনি ইসরাইলে আল্লাহপাক নবি মুহাম্মদ (সা)-কে সার্বভৌম রাজশক্তির সহায়তার জন্য দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন।
(১০৫-১০৯) ইসলামের বিরুদ্ধে সকল কুফুরিশক্তি একাট্টা। তার মোকাবেলায় ইসলামের পক্ষের সকল শক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনের জন্য তাগিদ দিয়েছেন এবং দলাদলি করতে স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। তিনি মোমিনদের পরস্পর ভাই হিসেবে উল্লেখ করে পরস্পর বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার জোর তাগিদ দিয়েছেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত না হওয়া সম্পর্কে অন্যত্রও বলেছেন।
‘এবং তোমাদের এ জাতি একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক; অতএব আমাকে ভয় করো। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দীনকে বহুধা বিভক্ত করেছে, প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত’- সুরা মোমিনুন ৫২-৫৩।
আল্লাহ আরো বলেন,
‘যারা দীন সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করাবেন’- সুরা আনআম ১৫৯।
আল্লাহর রসুল (সা)-এর কঠোর হুঁশিয়ারি-
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা) বলেন, রসুল (সা) বলেন- ‘ইসরায়েল সন্তানগণ ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। এদের মধ্যে সকলেই জাহান্নামি, একটি মাত্র দল বাদে। সাহাবিগণ প্রশ্ন করেন : হে আল্লাহর রসুল (সা), এ মুক্তিপ্রাপ্ত দলটি কারা? তিনি বলেন- আমি এবং আমার সহাবিগণ এখন যার ওপর আছি’- তিরমিযী।
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস বা আকিদা এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ আল্লাহ, রসুল, কিতাব, আখেরাত, ফেরেশতা ও তকদিরের প্রতি বিশ্বাস এনেই একজন ব্যক্তিকে মোমিন হতে হয়। বিশ্বাসের সাথে সাথে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসুল (সা) যেসব বিষয় অত্যাবশ্যকীয় (ফরজ) করেছেন সেসব পালনের মাধ্যমে সে হয় মুসলিম (অনুগত)। উম্মাহর মধ্যে এ নিয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। কুরআন মজিদে নানাভাবে তার বর্ণনাও রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে- কেউ যদি তাওবা করে এবং নামাজ কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে তাহলে সে তোমার ভাই। রসুল (সা) এক বেদুইন যুবককে বিশ্বাসের সাথে নামাজ,রোজা আদায়ের স্বীকৃতির (যোগ্যতার ভিত্তিতে) মাধ্যমে বলে দেন, সে যদি তার কথায় আন্তরিক হয় তাহলে সে জান্নাতি। কুরআন ও হাদিসের আলোচনায় বোঝা যায় কেয়ামতের দিন একজন ব্যক্তিকে তার ইমান ও ফরজ-ওয়াজিব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। সুন্নাত-মুস্তাহাব পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। আল্লাহ বলেছেন- তোমরা বড় বড় গুনাহ থেকে বিরত থাকো, তাহলে ছোট গুনাহসমূহ আল্লাহ এমনিতেই মাফ করে দেবেন। বড় গুনাহর অর্থই হলো ফরজ-ওয়াজিব লঙ্ঘন।
নামাজ-রোজা-হজ-জাকাত আদায় না করা, সুদ-ঘুষ, জিনা-ব্যাভিচার, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও আমানতে খেয়ানত, ওজনে কম-বেশি, ধোকা-প্রতারণা সবই ফরজ লঙ্ঘন ও পরিণতি জাহান্নাম। এসব অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টদের কাফের বলে তেড়ে আসতে কাউকে দেখা যায় না বা এব্যাপারে কোনো ফতোয়াও দৃষ্টিগোচর হয় না (অবশ্য কবিরা গুনাহ করলেই কেউ কাফের হয়ে যায় না, বরং কেউ যদি অস্বীকার করে তবেই কাফের হয়)। কিন্তু আমিন জোরে না আস্তে, হাত বুকের ওপর না নিচে, ইফতার সঙ্গে সঙ্গে না একটু পরে- এসব নিয়ে ফেসবুকেসহ নানা জায়গায় দেখা যায় অনেক বিতর্ক এবং একে অপরকে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করতে।
রসুল (সা)-এর সুন্নাত মনে করে যে কেউ হুবুহু অনুসরণ করলে অনেক ছাওয়াবের অংশীদার হবেন, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব নিয়ে কাউকে গালি দিলে, কটাক্ষ করলে এবং দলাদলি করলে কুফুরিতে লিপ্ত হবে, সেটাও মনে রাখতে হবে। রসুল (সা) যেটা করেননি সেটাকে ইবাদত মনে করে করা (বিদয়াত) পরিহার করে সুন্নাত-মুস্তাহাবের অনুসরণে ভিন্নতায় কোনো দোষ নেই। এ আল্লাহরই হেকমত। এসব ভিন্নতা সত্ত্বেও উম্মাহর মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠবে- এটাই আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায়। মুসলিম উম্মাহ সর্বসম্মতভাবে যাদেরকে কাফের আখ্যায়িত করেছে (যেমন- কাদিয়ানি) তাদের বাদে আহলে হাদিসসহ চার মাযহাব এবং যারাই ইসলামের মৌলবিশ্বাস ও ফরজ-ওয়াজিব মেনে চলে বা চলতে প্রস্তুত সবাই সত্যাশ্রয়ী ও হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। দলাদলি না করে সবার প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ ইমানেরই পরিচায়ক।
ইসলামের দুশমনরা আমাদের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে আজ ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়ে মজা লুটছে, অথচ আমাদের চৈতন্য হচ্ছে না। অনৈক্যের কারণে আজ দুনিয়াতে আমরা ভোগ করছি সীমাহীন জিল্লতি- আখেরাতে রয়েছে আরো ভয়াবহ পরিণতি। ইসলামের দুশমনদের মোকাবেলায় কালেমাবিশ্বাসী (ইসলামের পক্ষে) সকল মুসলিমের ঐক্য আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
শিক্ষা : এই আয়াতসমূহের মৌলিক শিক্ষা হলো আল্লাহর ভয়, ঐক্যবদ্ধ জীবযাপন ও মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান এবং দলাদলি পরিহার করে চলা। ২৮.০৩.২০২১
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment