শুরু থেকেই করোনা নিয়ে প্রচুর লিখেছি। করোনাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলেছে ও চলছে। গবেষক ও বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল এশিয়া-আফ্রিকা ও যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশগুলোয় চরম মানবিক বিপর্যয় ঘটবে। তারা মনে করেছিল, অপ্রতুল চিকিৎসা সুবিধা, ঘনবসতি, অসচেতন জনগোষ্ঠী, পুষ্টিহীনতা ও নানাবিধ কারণে করোনায় এসব দেশে প্রচুর প্রাণহানি ঘটবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছিল, আট কোটি লোক করোনায় আক্রান্ত হবে এবং বিশ লক্ষ মারা যাবে। চিকিৎসা নয়, লাশ দাফনেই যেন তারা অপারগ হয়ে উঠবে। কিন্তু না, তা হয়নি। বিশ্বের পরাশক্তিদের তুলনায় বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু দুই-ই উল্লেখ করার মতো নয়। যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা আমেরিকায় ৫ লক্ষ ৫৬ হাজার, বৃটেনে ১ লক্ষ ২৬ হাজার, ফ্রান্সে ৯২ হাজার, জার্মানিতে ৭৫ হাজার, ইতালিতে ১ লক্ষ ৫ হাজার, ভারতে ১ লক্ষ ৬০ হাজার সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ৮,৭৩৮ জন। শুধু বাংলাদেশ নয় অন্যান্য মুসলিম দেশসমূহেও করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু দুই-ই কম। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
করোনা নিয়ে আমি যা বলতে চেয়েছি, করোনা মুসলিম (আল্লাহর সকল সৃষ্টিই মুসলিম), সে আল্লাহর হুকুম মেনে চলে। কুরআন ও হাদিস পাঠে আমার উপলব্ধি, করোনা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এক গজব যা মানবজাতিকে সতর্ক করার জন্য পাঠানো হয়েছে। করোনার উদ্ভব চীনে এবং খোদ চীন ও নিকটবর্তী দেশসমূহকে বাদ রেখে বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে খ্যাত ইউরোপ-আমেরিকাকে একযোগে আঘাত হেনেছে। তাদের অস্ত্রভাণ্ডারে এতো মারাত্মক অস্ত্র মজুদ রয়েছে যার প্রয়োগ মুহূর্তে সমগ্র বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও চিকিৎসা শাস্ত্রে অভাবনীয় উন্নতি এবং প্রতাপ কোনো কাজেই লাগেনি বরং অতি ক্ষুদ্র এক জীবাণুর কাছে তারা ধরাশায়ী হয়ে পড়েছে। আল্লাহর মোকাবেলায় মানুষের অসহায়ত্বই এখানে প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বের সেরা জাতিসমূহের ধ্বংসের কাহিনী কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। তারা ছিল চরম সীমালঙ্ঘনকারী ও পাপাচারী। আল্লাহ তায়ালা তাদের সংশোধনের জন্য নবি-রসুল পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারা হেদায়াত গ্রহণ না করে উল্টো নবি-রসুল ও ইমানদারদের প্রতি সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে। আল্লাহপাক তাদের শায়েস্তা করে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন।
পৃথিবীতে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন চলছে এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ দেশে দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহে লক্ষ লক্ষ আল্লাহর বান্দা মৃত্যুবরণ করছে বা অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে। এসব যুদ্ধ-বিগ্রহের যারা হোতা ও দেশে দেশে স্বৈরশাসকদের যারা পাহারাদার করোনার আঘাত যেন তাদেরই ওপর। কুরআনে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের যা বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে বোঝা যায় তারা ছিল তৎকালে সেরা এবং জুলুম-নির্যাতন ও পাপাচারেও অগ্রগামী। আল্লাহর মোকাবেলায় তাদের শক্তিমত্তা কোনো কাজে আসেনি। আল্লাহপাক যখন কাউকে ধরেন তখন বড় শক্ত করেই ধরেন। এই করোনা কোনো একক দেশ নয়, সমগ্র বিশ্বকে আঘাত করেছে। দেশে দেশে যুদ্ধের যে দাবানল জ্বলে উঠেছিল করোনা তা স্তিমিত করে দিয়েছে। এই দৃষ্টিতে বলা যায়, করোনা বিপন্ন মানুষের জন্য আশীর্বাদই।
সাধারণত রোগ-ব্যাধি বিশেষ করে মহামারি সবচেয়ে বিপজ্জনক হয় শিশুদের জন্য। এজন্য রোগী দেখার ক্ষেত্রে হাসপাতালে সাধারণত শিশুদের নেয়া হয় না। কিন্তু শিশুদের সাথে করোনার সাংঘাতিক সখ্যতা, তারা আক্রমণের লক্ষবস্তু নয়। আবার যারা ফুটপাতে দিন যাপন করে বা বস্তিতে বাস করে বা কুলে-মুটে-মজুর কঠোর পরিশ্রমে নিয়োজিত, হাটে-বাজারে গিজ গিজ করা শ্রমিক, ভ্যানচালক, ক্রেতা-বিক্রেতা বা চিকিৎসা সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্ররাও করোনার থাবা থেকে মুক্ত। করোনাকালে কয়েকবার গ্রামে গিয়েছি। করোনাভীতি তাদের মাঝে নেই। অথচ তাদের না আছে চিকিৎসা সম্পর্কীয় কোনো জ্ঞান বা সচেতনতা বা চিকিৎসা নেয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা। তাদের করোনায় আক্রান্ত না হওয়ারও কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এর জবাব একটিই, সেটি হলো আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায়। আমরা এমন এক আল্লাহকে বিশ্বাস করি যিনি কর্ম সম্পাদনে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মালিক এবং যাঁর ইচ্ছা ছাড়া কোনো কিছু ঘটে না। প্রয়োজন ছিল আল্লাহর দিকে ফিরে আসা। ২/১ জন সরকারপ্রধানকে অবশ্য বলতে শুনেছি, আমরা আসমানের দিকে তাকিয়ে আছি।
ইতিহাসে এতো দৃষ্টান্ত রয়েছে কিন্তু তা থেকে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় না। নমরুদ একজন প্রতাপশালী শাসক, মশার আক্রমণে নিহত হয়েছিল। ফেরাউন অত্যাচারী শাসক, সমুদ্রের মাঝ দিয়ে রাস্তা হয়ে গেলে সেই রাস্তায় মুসা (আ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিরা পার হয়ে যান আর ফেরাউন সদলবলে ডুবে মরে। আবার নমরুদের অগ্নিকুণ্ডলি থেকে ইবরাহিম (আ) অক্ষত বেরিয়ে আসেন। এসব ঘটনারও কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, তেমনি শিক্ষা-দীক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা বঞ্চিত ১৮ কোটি জনঅধ্যুষিত দরিদ্র বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু মাত্র ৮,৭৩৮ জন এবং পৃথিবীর সবচেয়ে শত্তিমান ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সেরা আমেরিকায় মৃত্যু ৫ লক্ষ ৫৬ হাজার ও বৃটেনে ১ লক্ষ ২৬ হাজার। এরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। সবই আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায় ও হুকুম।
উন্নত দেশের তুলনায় করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুহার আমাদের অনেক কম। এতে আমাদের কারো কোনো কৃতিত্ব নেই। এটি মহান আল্লাহপাকের একান্ত দয়া ও অনুগ্রহ। তাই আমাদের উচিৎ, আল্লাহ তায়ালার দরবারে বেশি বেশি শুকরিয়া আদায় করা। হ্যাঁ, আল্লাহর অনেক বান্দা নাফরমানির পথ পরিহার করে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছেন। এই ফিরে আসাটা করোনায় নিট লাভ। প্রশ্ন উঠতে পারে, আল্লাহ তায়ালার দয়া ও অনুগ্রহ তো তাঁর নেক বান্দাদের ওপরই বেশি আপতিত হওয়ার কথা। হ্যাঁ তাই, করোনায় আল্লাহর যেসব নেক বান্দা ইন্তেকাল করেছেন তারা শহীদী মর্যাদা নিয়ে জান্নাতে অফুরন্ত সুখ ভোগ করবেন। কারণ নেক বান্দারা এই বিপদে নিজেদেরকে তাদের মনিবের ওপর সোপর্দ করে পরম ধৈর্য অবলম্বন করেছেন। পক্ষান্তরে যারা জালেম তারা আল্লাহর নাফরমানি ও জুলুমের শাস্তি কিছুটা উপলব্ধি করে আল্লাহর দরবারে ফিরে গেছে।
দুনিয়ার জীবনে বালা-মুসিবত ও বিপদাপদ কোনো কিছু হঠাৎ করে আসে না। আসে আল্লাহর অনুমতিক্রমে (সুরা তাগাবুন) এবং সবই আমাদের হাতের কামাই। করোনা এসেছে সতর্কীকরণ হিসেবে। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি, সবাই এথেকে সতর্ক হতে পারেনি এবং তাদের জীবনে কোনো পরিবর্তনও সাধিত হয়নি। সুদ, ঘুষ, জিনা-ব্যাভিচার, নগ্নতা-বেহায়াপনা-অশ্লীলতা সব বহাল রয়েছে। সত্যিই, যারা নিজেদেরকে সংশোধন করতে পারলো না তারা কপালপোড়া, বদনসিব- এরা আবু লাহাব, আবু জেহেল, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের সার্থক উত্তরসূরি। আল্লাহর রসুল (সা)-কে চাক্ষুস দেখে, জেনে তারা ইমান আনতে ব্যর্থ হয়েছিল। করোনার মতো একটি নিদর্শন তাদের দৃষ্টিতে স্রেফ একটি ভাইরাস এবং এই ভাইরাস ধ্বংস করার জন্য তারা প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। হ্যাঁ, এটি আল্লাহপাকের নিয়ম, যারা চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাবে আল্লাহ তায়ালা তাদের সহায়তা করবেন। কিন্তু মৃত্যু চাক্ষুস দেখে বা ICU থেকে ফেরত এসেও অনেক হতভাগা নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারলো না।
মানুষ আল্লাহ তায়ালার খলিফা। সে তার সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য চেষ্টা করবে, এটি আল্লাহরই নিয়ম। একজন মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্য হলো- মুসলিম বিজ্ঞানী আবিষ্কারের পর নিজের কৃতিত্ব নয়, আল্লাহপাকের অনুগ্রহ বলে সে বিনয়াবনত হবে এবং এর ফলে সে দুনিয়া ও আখেরাতে পুরস্কৃত হবে। পক্ষান্তরে অমুসলিম বিজ্ঞানী নিজের কৃতিত্ব বলে জাহির করবে এবং দুনিয়ায় সে তার ফল লাভ করবে, আল্লাহ তাকে দেবেনও। কিন্তু আখেরাতে তার কোনো প্রাপ্তি নেই।
শিরকের পরেই আল্লাহর ক্রোধ উদ্রেগকারী আমল হলো তাঁর বান্দাদের ওপর জুলুম। কুরআন থেকে উপলব্ধি করা যায়, দুনিয়ায় গজবের অন্যতম কারণ সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন ও সমাজে অশ্লীলতার প্রসার। মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা নমরুদ-ফেরাউনদের কাজ। তাদের উত্তরসূরীরা সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করার জন্য যেমন গুম-খুনে মেতে ওঠে তেমনি যুবসমাজের নৈতিক শক্তি ধ্বংস করার জন্য অশ্লীলতার প্রসার ঘটায়। জালেমরা হয়ে ওঠে বেপরোয়া। মনে করে, কেউ তাকে দেখে না বা তাকে কখনো জবাবদিহি করতে হবে না। আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেন (এটা ফিরে আসার সুযোগ হিসেবে), কিন্তু তিনি ভুলে যান না। ন্যায়বিচারক আল্লাহ দুনিয়ায় শাস্তি না দিলেও আখেরাতে মজলুমের পক্ষ থেকে কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে দিবেন। এই করোনা আল্লাহর দিকে ফিরে আসার সুযোগ হয়ে এসেছিল।
হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে করোনা থেকে হেফাজত করো ও তোমার পথে ফিরে আসার তৌফিক দান করো। আমিন। ২৫.০৩.২০২১
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment