বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
শিক্ষাব্যবস্থাকে দুটিভাগে বিভক্ত করা যায়। এক. প্রাতিষ্ঠানিক, দুই. অপ্রাতিষ্ঠানিক। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে আমরা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানকে বলতে পারি। এসব প্রতিষ্ঠানে সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নানাবিধ বিষয় শিক্ষা দান করা হয়। আমাদের দেশে পাঠদান পদ্ধতি হিসেবে মাতৃভাষা বাংলা ও ইংরেজি চালু রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষাদান পদ্ধতি। সেখানে আরবির প্রাধান্যের পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজিও রয়েছে। আমরা বিশাল জনঅধ্যুষিত এক উন্নয়নশীল দেশ। বিশ্বে উন্নত সকল দেশসমূহ শিক্ষাদান পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদের মাতৃভাষাকে। তাই আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য বিদেশে যায় তখন তাদেরকে সবার আগে সেসব দেশের ভাষা শিখতে হয়। যেমন জার্মান, চাইনিজ, রাশিয়ান, জাপানি বিভিন্ন দেশের ভাষা শেখার পরে যায় বা সেদেশে ছয় মাস/এক বছর ভাষা শেখায় ব্যয় করতে হয়। কিন্তু আমরা পারি না। ভাষার মাস আসলে সবাই একটু নড়েচড়ে বসে।মানুষকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং আলোচনা সভা ও সেমিনার- সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করা হয়।
আমাদের দেশে বর্তমানে যে ব্যবস্থাপনা (বাংলা, ইংরেজি ও আরবি) চালু রয়েছে সেটিই বাস্তবতা। শহরগুলোয় ইংলিশ মিডিয়ম স্কুলের আধিক্য এবং বাংলা ও ইংলিশ ভার্সন স্কুলের প্রসার প্রমাণ করে নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। লেখাপড়া বা কর্মসংস্থানের জন্য মানুষ এখন বিদেশমুখী। এছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতিও বিদেশমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম দায়ী। বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইংরেজি ও আরবি ভাষাজ্ঞান (Spoken English & Arabic) জরুরি। আমাদের গ্রামের নিরক্ষর ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষ মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এবং আয় উপার্জন করে বেশ সচ্ছলতার সাথে জীবন যাপন করছে। তবে এটা ঠিক, একজন ফিলিপাইন বা ভারতীয় নাগরিক যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে সেই তুলনায় আমাদের দেশের নাগরিক অনেক কম পেয়ে থাকে। এর অন্যতম কারণ ভাষাজ্ঞান। আমার নিজের উপলব্ধি, নিতান্ত প্রয়োজনই মানুষকে বিদেশী ভাষা শিখতে বাধ্য করছে।
আমাদের প্রয়োজন গুণগত ও নৈতিক শিক্ষা। আমাদের দেশের অনেক উচ্চপদস্থ আমলা ও কর্মকর্তা নৈতিক দিয়ে একেবারে অধপতিত। তারা ঘুষ-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। দুর্নীতি আমাদের সকল সম্ভাবনা ধ্বংস করে দিচ্ছে। মাদ্রাসা ব্যতীত আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার মান মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। মাতৃভাষার উৎকর্ষতা ছাড়া গুণগত ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান সম্ভব নয়। দেশে উচ্চবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা খুবই সীমিত। সাধারণ মানুষকে শিক্ষার আওতায় আনতে হলে প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষাদান ও শিক্ষাকে সহজ ও আনন্দঘন করা। এখানেই আমরা ব্যর্থ। উচ্চশিক্ষা সীমিত করে কর্মমুখি ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার এবং সেটি করতে হলে অবশ্যই মাতৃভাষা চর্চার ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
আমাদের দেশে নৈতিক শিক্ষার পুরোটায় বলা যায় অপ্রাতিষ্ঠানিক। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে জুমা ও ঈদগাহে বক্তৃতা, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আলোচনা, বইপত্র, পত্রিকা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, ইউটিউব, ফেসবুকসহ নানা অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষাদান। এসব ক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। নৈতিকভাবে অধপতিত এই সমাজে মানুষকে চরিত্রবান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দ্বীনমুখী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আশার দিক, মানুষ ক্রমান্বয়ে তার সন্তানদেরকে কুরআনে হাফেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষা দানের দিকে ঝুঁকছে। এগুলোও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য না পাওয়ায় তেমন বিকশিত হতে পারছে না।
মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইসলামের বক্তব্য স্পষ্ট। আল্লাহর বাণী, ‘পরম দয়ালু (আল্লাহ)। এ কুরআনের শিক্ষা দিয়েছেন। তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং কথা (ভাষা) শিখিয়েছেন’- সুরা আর রহমান। ভাষা আল্লাহ তায়ালার দান এবং এই বাকশক্তি (ভাষা) মানুষকে সকল সৃষ্টি থেকে পৃথক ও সবার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। এই ভাষার মাধ্যমে মানুষকে জ্ঞান অর্জন করতে হয় এবং তার যোগ্যতার বিকাশ ঘটে। অন্যান্য সৃষ্টি জন্মগতভাবে লব্ধ শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করে- যেমন মাছ পানিতে সাঁতার কাটে, পাখি আকাশে উড়ে এবং আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ কাজ করে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য সৃষ্টির আলাদা কোনো শিক্ষক নেই এবং নেই কোনো শিক্ষাদান পদ্ধতি। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানুষকে পৃথকভাবে শিক্ষা দিতে হয়েছে। আল্লাহপাক নিজে আদম আ.-কে তাঁর সকল সৃষ্টির নাম ও তার কার্যক্রম শিখিয়েছেন।
বর্তমানে পৃথিবীতে তিন শতাধিক ভাষা রয়েছে। মাতৃভাষা বলতে বোঝায় মানুষ জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা শেখে এবং যে ভাষায় নিজের দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না প্রকাশ করে তাকেই বোঝায়। মুসলমানের ভাষা ও কাফেরের ভাষা বলে কিছু নেই। সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাইতো আমাদের কবি গেয়েছেন, ‘ও আমার বাংলা ভাষা, মায়ের ভাষা- খোদার সেরা দান।’ আল্লাহপাক প্রদত্ত অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে ভাষা অন্যতম এবং হেদায়াতের জন্য দান করেছেন আল কুরআন। এই কুরআনকে জানা ও এর মর্ম উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন ভাষাজ্ঞান।
অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের পার্থক্য হলো তার ভাষা। সকল সৃষ্টি জন্মগতভাবে জানলেও ভাষাজ্ঞানের কারণে মানুষকে পৃথকভাবে জানতে হয়। এই জানার হাজারো প্রক্রিয়া রয়েছে। বক্তৃতা বা আলোচনা শুনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে, বই পড়ে এবং অনলাইনভিত্তিক নানা প্রক্রিয়ায়। এই জানার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা যতখানি সহায়ক, অন্য কোনো ভাষায় সেটি সম্ভব নয়। আদম আ. ছিলেন প্রথম মানুষ ও নবি। মানুষের হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবি ও রসুল আল্লাহ পাঠিয়েছেন এবং তাঁদেরকে স্বজাতির ভাষাভাষী করা হয়েছে ও কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরই ভাষায়। আল্লাহপাকের বাণী, ‘আমি সব নবিকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে’- সুরা ইব্রাহিম ৪। মুহাম্মদ সা. একজন আরবিভাষী বলেই তাঁর উপর অবতীর্ণ কিতাব ‘আল কুরআন’ আরবি ভাষায় অবতীর্ণ।
ভাব প্রকাশের মাধ্যম ভাষা। সকল ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি। কুরআন আরবি ভাষায় এবং মুহাম্মদ সা. একজন আরবীয় বলে আরবির প্রতি আমাদের আকর্ষণ রয়েছে। আমরা আরবিকে ভালোবাসি এবং এটিই স্বাভাবিক। দ্বীনকে জানার মূল মাধ্যম আল্লাহর কিতাব আল কুরআন এবং নবি সা.-এর জীবনচরিত। আল্লাহপাক তাঁর কিতাবকে উপস্থাপন করেছেন মুত্তাকিদের জন্য পথপ্রদর্শক (সুরা বাকারা ২) এবং মানব জাতির জন্য পথের দিশা (সুরা বাকারা ১৮৫) হিসেবে। হেদায়াত বা পথের দিশা পেতে হলে অবশ্যই আল্লাহর কিতাবকে নিজের ভাষায় বুঝতে হবে এবং মর্ম উপলব্ধি করে আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে মেনে চলতে হবে।
আমরা যদি পেছন ফিরে দেখি তাহলে উপলব্ধি করবো, শিক্ষার প্রধান মাধ্যম ছিল বক্তৃতা এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা। আমাদের শেখার ও জানার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আল্লাহর পক্ষ তাঁর বান্দাদের জন্য সর্বশেষ হেদায়াত আল কুরআন। এই মহাগ্রন্থ আল কুরআন সকল মুসলমানের ঘরে অবিকৃত অবস্থায় মজুদ রয়েছে। অথচ আরবি ভাষাভাষী মানুষের কাছে যখন কুরআন উপস্থাপন করা হয় তখন তার যাদুকরি সাহিত্যিক মান এবং বিষয়বস্তুর নির্ভুলতা ও কল্যাণকারিতা সহজেই মানুষকে মুগ্ধ করে। আরবরা তাদের ভাষায় নাজিলকৃত কুরআনের মর্ম উপলব্ধি করতেন বিধায় একদল সত্যানুসন্ধিৎসু মানুষ হেদায়াত লাভে ধন্য হয়েছেন। পক্ষান্তরে দুনিয়াপূজারী ও পাপাচারী জনগোষ্ঠী কুরআনের মাঝে তাদের বিপদ উপলব্ধি করে প্রচণ্ড বিরোধীতা করে এবং এটিই স্বাভাবিক। আজও আমরা লক্ষ্য করি কুরআনের তাফসির মাহফিল যারা পণ্ড করে তারাই আবার নেতা-নেত্রীর মৃত্যুতে ঘটা করে কুরআনখানির ব্যবস্থা করে। অর্থ ও ব্যাখ্যা ছাড়া এই নির্জীব কুরআন খতম তাদের কোনো কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা রাখে না। অধিকাংশ মুসলিম কুরআনকে বুঝতে চায় না এবং কুরআন থেকে হেদায়াত লাভের চেষ্টাও করে না। কুরআনের প্রতি এ এক বড় অবিচার। মুসলমানদের এ অবিচার দেখে বড়ই আক্ষেপ করে লিখেছিলেন ভারতের নবম রাষ্ট্রপতি ড. পণ্ডিত শঙ্কর দয়াল শর্মা নিম্নবর্ণিত কয়েকটি চরণ।
যা ছিল প্রাণ সঞ্চালনের গ্রন্থ
হয়ে গেল প্রার্থনার পুস্তক
যা ছিল অধ্যয়নের জন্য হয়ে গেল আবৃত্তির জন্য জীবন্তদের বিধান ছিল হয়ে গেল মৃতদের ছাড়পত্র জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা ছিল পড়ে গেল মুর্খদের হাতে সৃষ্টি বশ করার আহবান ছিল থেমে গেল মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে প্রাণহীনকে চেয়েছিল প্রাণবন্ত করতে লেগে গেল বিদেহীদের পরিত্রাণকল্পে ওহে মুসলমান! একি তুমি করলে!! ওঠো, চোখ মেলো আর ভেবে দেখো।
আল্লাহপাক দয়া করে আমাদেরকে বাঙালি করে পাঠিয়েছেন। বাঙলা আমার মায়ের ভাষা। আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠতম উপহার এই ভাষা। এই ভাষায় শুদ্ধভাবে কথা বলা ও লেখা এবং এর মাধ্যমে গল্প, কবিতা, উপন্যাসে ইসলামকে ফুটিয়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। এসবের মাধ্যমে ইসলামকে সাধারণ মানুষের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব।
ব্যাপকভাবে ইসলামের চর্চা হয় বক্তৃতার মাধ্যমে। সাপ্তাহিক জুমার নামাজে খুতবা প্রদান বাধ্যতামূলক এবং সেটি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে শ্রবণ করতে হয়। কেউ কথা বললে ‘ভাই, চুপ করো’- তাও বলা যায় না। ইসলামের আলোকে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এবং দ্বীনের ব্যাপক প্রচারের ক্ষেত্রে এই খুতবার অবদান অনস্বীকার্য। দুর্ভাগ্য, আমরা এর থেকে পুরোপুরি ফায়দা লাভ করতে সক্ষম হচ্ছি না। মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ ও সমাজ পরিবর্তনে বক্তৃতার যাদুকরী প্রভাব রয়েছে। জুমার দিনে বক্তৃতা শ্রবণকে আল্লাহর রসুল সা. আবশ্যক করেছেন। এটি শুধু বক্তৃতা নয়, ইবাদত এবং অত্যন্ত মনোযোগের সাথে শুনতে হয়। জুমার দিন প্রস্তুতিসহ সকাল সকাল মসজিদে উপস্থিত হওয়ার তাগিদ রয়েছে এবং যে প্রথমে উপস্থিত হবে তার আমলনামায় উট, পরবর্তীতে গরু, ছাগল ও মুরগি কুরবানির সওয়াবের কথা বলা হয়েছে। খতিব মহোদয় যখন মিম্বরে আরোহণ করেন তখন ফেরেশতারা সওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শ্রবণ শুরু করে। এতে উপলব্ধি করা যায়, ইমাম সাহেবের খুতবা শুরুর পরে উপস্থিত মুসল্লিরা জুমার সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়।
আমাদের দেশের ব্যবস্থাপনায় আরবিতে খুতবা দেয়া হয় যা শুধু অযৌক্তিকই নয় বরং আল্লাহর বাণী ‘আমি সব নবিকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে’- এর নির্দেশনার পরিপন্থী। খুতবা বা বক্তৃতা মানুষের বোধগম্য ভাষাতেই হওয়া বাঞ্চণীয়। দুর্ভাগ্য, মানুষ আরবি বুঝে না বিধায় খুতবা আমাদের দেশে তিনটি হয় যা সুস্পষ্ট বিদয়াত এবং আলোচনা চলার সময় বলা হয় পরে চার রাকাত সুন্নাত পড়ার সময় দেয়া হবে, এ কথা বলাতে খুবই স্বল্প সংখ্যক মানুষ বক্তৃতা শুনে থাকে এবং খতিব মহোদয়ের বাংলায় ওয়াজ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। দুটি খুতবা সুন্নাহ সমর্থিত এবং প্রথম খুতবা মাতৃভাষায় হলে এর হক আদায় হওয়া সম্ভব। ড. আব্দুল্লাহ বিন বাজের মতো জগত বিখ্যাত ফকিহ মানুষের বোধগম্য নয় এমন ভাষায় খুতবা প্রদানকে নাজায়েজ বলেছেন এবং সউদী আরবের বরেণ্য মুফতি শাইখ ইবনে উসাইমিন রহ.-কে মাতৃভাষায় খুতবা প্রদান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জায়েজ বলে মন্তব্য করেন এবং স্পষ্টভাবে বলেন, খতিবকে নিজ ভাষায় খুতবা দিতে হবে (ফাতওয়া আরকানিল ইসলাম)।
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, ‘প্রত্যেক খতিবকে জুমার সময় তাঁর মাতৃভাষায় ওয়াজ করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য’- তানকীহুর রুওয়াত ১/২৬৪।
প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নয়নের পরও বলা যায় দ্বীনের চর্চা ও নসিয়তের ক্ষেত্রে বক্তৃতার অবদান সর্বাগ্যে। জুমার খুতবা, তাফসিরুল কুরআন ও ওয়াজ মাহফিলে বরেণ্য আলেমদের ওয়াজ শোনার জন্য মানুষ উদগ্রীব থাকে এবং সেসব ওয়াজ মাহফিলের আলোচনা ইউটিউবে মানুষ মনোযোগ সহকারে শুনে। নসিহতের ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে রয়েছে জুমার খুতবা। রসুলুল্লাহ সা.-এর পন্থা অনুসরণ করে যদি জুমার খুতবা প্রদান করা যায় তবে উদ্বুদ্ধকরণ ও সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যুগান্তকর ভূমিকা রাখতে পারে। এখানে বলা যায়, খতিব মহোদয় মিম্বরে আরোহণের পূর্বে সব মুসল্লি মসজিদে উপস্থিত হয়ে যাবে এবং ইমাম সাহেব সমসাময়িক বিষয়ে মাতৃভাষায় খুতবা প্রদান করবে যাতে মহান আল্লাহর অভিপ্রায় ‘যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে’- বাস্তবায়ন হয়। খতিব মহোদয়ের খুতবা ও ফরজ নামাজের মাঝে আর কোনো নামাজ থাকবে না। ঢাকা শহরে অনেক মসজিদে খুতবা এবং ফরজ নামাজের মধ্যে কোনো নফল নামাজের সুযোগ দেয়া হয় না। আমাদের বিশ্বাস, বছরে ৫২টি সপ্তাহে খতিব মহোদয় পরিকল্পিতভাবে তাঁর মুসল্লিদের সম্মুখে দ্বীনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে পারলে ইনশা-আল্লাহ নসিহতের হক আদায় সম্ভব।
মানুষকে দাওয়াত দিতে হবে এবং সেটি কোন্ প্রক্রিয়ায় আল্লাহ তা উল্লেখ করেননি। এব্যাপারে গাইডলাইন হলো দাওয়াত দিতে হবে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা। আল্লাহর বাণী, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের দিকে আহবান করো হিকমাত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়’- সুরা নাহল ১২৫। যতো প্রকার প্রক্রিয়া রয়েছে এবং ভবিষ্যতে উদ্ভাবন হবে সবই বৈধ পন্থা। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক দাওয়াত, বক্তৃতা-বিবৃতি, জুমা ও ঈদের খুতবাসহ সবধরনের আলোচনা, বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকায় লেখনি, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপ, ইউটিউব যতো রকমের উপায় আছে সবই গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ জনগণের বোধগম্যের লক্ষ্যে তাদের ভাষায় অর্থাৎ মাতৃভাষায় দ্বীনের চর্চা করতে হবে। মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষায় আমরা যতো পারদর্শী হবো ততো বেশি দ্বীনকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবো।
ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী একটি জাতির শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, তমুদ্দুন মজলিসের মতো একটি ইসলামী সংগঠন ভাষার জন্য আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। আল্লাহপাকের অশেষ দয়ায় বাংলা ভাষায় প্রচুর কুরআনের তাফসির, হাদিসের তরজমা এবং বিপুল পরিমাণ ইসলামী সাহিত্য গড়ে উঠেছে। সাহিত্যের একটি বড় অংশ গল্প, উপন্যাস, নাটক ও কবিতায় আমরা এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছতে পারিনি। আশার দিক, অনেক তরুণ ইসলামের আলোকে নতুন সাহিত্য রচনার প্রয়াস চালাচ্ছে।
কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ। কুরআনের সঠিক মর্ম উপলব্ধির জন্য আরবি ভাষার জ্ঞান অপরিহার্য। নামাজ সহীহ করে আদায়ের লক্ষ্যে বিশুদ্ধ তেলাওয়াত সবার জন্য জরুরি কিন্তু আরবি ভাষাজ্ঞান ও ব্যাকরণ জানা সবার পক্ষে সম্ভব নয় আবার প্রয়োজনও নেই। সাধারণ মানুষ দ্বীনকে জানবে মাতৃভাষায় অনুদিত কুরআন-হাদিস ও ইসলামী সাহিত্য পড়ে। তাই দ্বীনের ব্যাপক চর্চা ও মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত সহজভাবে পৌঁছে দেয়ার জন্য মাতৃভাষায় প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন ছাড়া সম্ভব নয়।
Comments
Post a Comment