Skip to main content

তোমরা নিজেদের ও নিজেদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও - সুরা তাহরিম ৬।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম


আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া যে, তিনি দয়া করে আমাদেরকে তাঁর ঘরে উপস্থিত হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। আলহামদু লিল্লাহ। দরুদ ও সালাম প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর।

আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ও কৃষিকাজ করি তার পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য নিজেদের সন্তান-সন্ততি ও পরিবারকে ভালো অবস্থায় রাখা এবং তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। দুনিয়ার জীবনে আরাম-আয়েশের সাথে আখিরাতের জীবনে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব। সুরা তাহরিমের ষষ্ঠ আয়াত উদ্ধৃত করে বলি, শুধু নিজে আল্লাহর পথে চললে হবে না সাথে সাথে নিজ পরিবারকেও চালাতে হবে এবং এর জন্য জবাবাদিহি করতে হবে। কয়েকটি বাচ্চা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে বলি আপনারা বাচ্চাদের মসজিদে নিয়ে আসবেন। ওদের দুষ্টুমীতে গুনাহ নেই, এটি তাদের শিশুসুলভ প্রকৃতি। তারা হাসবে, চিমটি কাটবে এবং জামাতের সারির ভেতর দিয়ে দৌড় দিবে- সবই স্বাভাবিক, এতে নামাজের কোনো ক্ষতি হয় না। রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রিয়তম দৌহিত্র হাসান ও হুসাইন রা.-এর উদাহরণ পেশ করে বলি, তারা তো তাদের নানার পিঠে চড়তো। এতে রসুলুল্লাহ সা. বিরক্ত হননি বা বকাঝকাও করেননি।

শিশুদের ছোট থেকে নামাজের তালিম দেয়ার কথা রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন এবং দশ বছর বয়সে উপনীত হলে নামাজের জন্য হালকা মারপিট করতেও বলেছেন। নামাজই মুসলমানিত্বের পরিচায়ক। জান্নাতের চাবি এবং আখিরাতে প্রথম হিসাবগ্রহণকারী আমল। আল্লাহর ভয়ে নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি জান্নাতের প্রত্যাশা করতে পারে এবং আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহপাক তাঁর কুরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, নামাজ আদায় না করার পরিণতি জাহান্নাম। জাহান্নামীদের জিজ্ঞেস করা হবে, কোন্ জিনিস তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে আসলো? তারা বলবে : আমরা নামাজ পড়তাম না (এটি প্রথম জবাব) সুরা মুদ্দাস্সির ৪২-৪৩। কুরআন মজিদে বলা হয়েছে, কেবল অবিশ্বাসীদের জন্যই নামাজ কঠিন। হাদিসে স্পষ্ট করা হয়েছে, যে ইচ্ছাকৃত নামাজ নষ্ট করলো সে কুফুরি করলো। আল্লাহর বাণী, ‘সবর ও নামাজ সহকারে সাহায্য নাও। নিঃসন্দেহে নামাজ বড়ই কঠিন কাজ, কিন্তু সেসব অনুগত বান্দাদের জন্য কঠিন নয় যারা মনে করে, সবশেষে তাদের রবের সাথে এবং তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে’- সুরা বাকারা ৪৫-৪৬। আল্লাহপাক নামাজ বলতে জামায়াতের সাথে নামাজ আদায়ের কথাই বলেছেন। তাঁর বাণী, ‘নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং যারা আমার সামনে অবনত হয় তাদের সাথে তোমরাও অবনত হও’- সুরা বাকারা ৪৩। রসুলুল্লাহ সা.-এর সময়ে মুনাফিকরা বাধ্য হয়ে নামাজের জামাতে হাজির হতো এবং সুরা মাউনে বলা হয়েছে তারা নামাজে অবজ্ঞা দেখায় ও লোক দেখানো কাজ করে।

আমাদের দেশে পুরুষদের মসজিদে আসার সুযোগ রয়েছে কিন্তু ঘরে মহিলাদের দ্বীন জানা ও বোঝার সুযোগ নেই বললেই চলে। তাদেরকে বোঝানোর দায়িত্ব আপনাদের। হৈ চৈ করে বা রাগারাগি করে নয়। ঘরে স্ত্রী ও সন্তানদের দরদের সাথে বোঝাতে হবে এবং এটিই আপনার দায়িত্ব। আপনার মধ্যে পেরেশানি থাকবে কিন্তু দুর্ব্যবহার নয়। আল্লাহও চান তাঁর বান্দারা ক্ষমাশীল হবে। আল্লাহর বাণী, হে ঈমানদার লোকেরা! তোমাদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু, তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো। আর যদি তোমরা ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু’- সুরা আত তাগাবুন ১৪। এখানে আল্লাহ তায়ালা শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করার পরও সহনশীল আচরণ করার তাগিদ দিয়েছেন। শত্রু বলতে বোঝানো হয়েছে এমন অনেক স্ত্রী বা সন্তান রয়েছে যারা স্বামীর বা পিতার সৎ জীবন যাপন পছন্দ করে না। আবার এমন অনেক স্বামী বা সন্তান আছে যারা স্ত্রী বা মায়ের পর্দা মেনে চলা বা ইসলামের পথে চলাটা পছন্দ করে না। সতর্ক থাকা অর্থ এরা কেউ যেন কেউ আপনাকে ইসলামের বিপক্ষে চলায় বা নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে চলতে অনুপ্রাণিত বা বাধ্য না করে। কিন্তু তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করলে বা সম্পর্ক ছিন্ন করলে সংশোধনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।

আমি আপনাদের সম্মুখে কুরআন থেকে স্বামী-স্ত্রী ও পিতা-পুত্রের কিছু ঘটনা তুলে ধরতে চাই। লুত আ. আল্লাহর নবি এবং তাঁর স্ত্রী কাফেরদের দলভুক্ত; হজরত আছিয়া আ. একজন মুসলিম (অনুগত) এবং তাঁর স্বামী ফেরাউন সর্বকালের সেরা জালেম ও স্বৈরশাসক; হজরত নুহ আ. আল্লাহর নবি এবং তাঁর পুত্র কেনান কাফেরদের দলভুক্ত; হজরত ইব্রাহিম আ. আল্লাহর পয়গম্বর এবং তাঁর পিতা আজর আল্লাহর দুশমন নমরুদের প্রধান পুরোহিত। আল্লাহর বান্দা (মুসলিম) একতরফাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন কিন্তু বিপরীতে লুত আ. স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন হননি বরং গজবের সময়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিতে আল্লাহই নিষেধ করেছেন এবং নুহ আ.-এর একই অবস্থা ডুবন্ত ছেলেকে নৌকায় তুলতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। ইবরাহিম আ. পিতার জন্য দোয়া করতে গেলে আল্লাহই না করেছেন। আছিয়া আ. শেষ পর্যন্ত ফেরাউনের সংসার করেছেন। ধৈর্যের পরীক্ষায় সবাই উত্তীর্ণ। অথচ আমাদের সমাজে সামান্যতেই ছেলেমেয়ে বিচ্ছিন্ন (ডিভোর্স) হতে চায় ও সন্তানকে ত্যাজ্য করতে চায়। আল্লাহপাক ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন- আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

পরিবারের সাথে সদাচরণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.। হেরা গুহায় ওহী প্রাপ্তির পর ভীত-সন্ত্রস্ত মুহাম্মদ সা. ছুটে আসেন তাঁর প্রিয়তম স্ত্রীর কাছে। তিনি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, আপনার কোনো ভয় নেই, আপনি গরীব-দুখী ও আত্মীয়স্বজনের সহায়, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালনকারী ও আমানত সংরক্ষণকারী; আল্লাহপাক আপনাকে বিপদে ফেলবেন না। নবি হিসেবে মুহাম্মদ সা.-এর ওপর প্রথম ঈমান গ্রহণকারী ব্যক্তি হলেন তাঁর স্ত্রী খাদিজা রা. এবং নবি পরিবারের সদস্য হজরত আলী রা.। আখিরাতে নাজাত পেতে হলে আপনার স্ত্রীর পক্ষ থেকে সদাচরণের সার্টিফিকেট লাগবে। তাই স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। পাশাপাশি স্বামীর সন্তুষ্টি ব্যতিরেকে স্ত্রীর পক্ষেও জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, কোনো নারী মৌলিক ইবাদতসমূহ পালনের সাথে স্বামীর আনুগত্য করলে তার যে দরজা দিয়ে খুশি জান্নাতে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।

সংসারে বাক-বিতণ্ডা ও মনোমালিন্য খুবই স্বাভাবিক। স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনেও ঘটেছে। কিন্তু এমন কিছু ঘটলে দ্রুত তা নিষ্পত্তি করতে হবে এবং যে এগিয়ে আসবে সে প্রভূত সওয়াবের অধিকারী হবে। মিথ্যাবলা কবিরা গুনাহ। অথচ স্বামী-স্ত্রী ও ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে মিথ্যাবলা আর গুনাহ হয় না, সেটি সওয়াবে পরিণত হয়। মনে করুন, একজন মহিলা স্বামীর সাথে রাগ করে বাবার বাড়ি চলে গেল। এমতাবস্থায় আপনি গিয়ে মহিলাকে বললেন, আপা ভাইতো আপনার অভাবে খানাপিনা ছেড়েই দিয়েছে; যতক্ষণ তার কাছে ছিলাম শুধু আপনারই কথা শুনলাম। আবার পুরুষটাকে গিয়ে বললেন, ভাই আমি চাচার বাসায় গিয়েছিলাম, আপাতো আপনার জন্য একেবারে পেরেশান হয়ে পড়েছেন; আপনি কী খান না খান সেই চিন্তায় তার স্বাস্থ্য চেহারা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। এমন কথা শুনলে সম্পর্ক জুড়ে লাগতে আর সময় লাগে? এরই নাম ফিতরাতের ধর্ম ইসলাম। কিন্তু মেয়ে জামাইয়ের সাথে রাগ করে বাড়ি চলে যায় আর মা/বাবা বলেন, জামাইয়ের এতোবড় স্পর্ধা তোর সাথে দুর্ব্যবহার! এমন আচরণের কারণেই মূলত সংসারে অশান্তি ও বিচ্ছেদ।

আমি আপনাদের সম্মুখে দুটি ঘটনা তুলে ধরতে চাই। আলী রা. ও ফাতিমা রা. প্রিয়তম নবি সা.-এর জামাই ও মেয়ে। রসুলুল্লাহ সা.-এর বড় আদরের। রসুলুল্লাহ সা. একদিন মেয়ে ফাতিমার ঘরে গিয়ে দেখেন, মেয়ের মুখ ভার এবং জামাই মাটির মধ্যে শোয়া অবস্থায়। তিনি জামাই-এর কাছে এসে ডাক দেন, হে আবু তোরাব! উঠো। আবু তোরাব অর্থ মাটির বাপ। তিনি কাউকে চার্জ করেননি, দোষারোপও করেননি। মধুর ডাক শুনেই তাঁদের মান-অভিমান দূর হয়ে যায়। জনৈক সাহাবি স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে খলিফা ওমর রা.-এর কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন। খলিফার বাড়ি তো আর রাজপ্রাসাদ নয়, বাড়ির বাইরে থেকে খলিফার স্ত্রীর উচ্চস্বরে আওয়াজ ও গালমন্দ শুনে তিনি ভাবলেন তার চেয়ে খলিফা আরো অসহায় এবং এমনটি মনে করে ফিরে যাচ্ছিলেন, এমন সময় খলিফা এসে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, আমরা আপনাকে অনেক ভয় পাই অথচ আপনি আমাদের চেয়ে বেশি অসহায়। জবাবে ওমর রা. বলেন, দেখ স্ত্রীরা আমাদের চরিত্রকে হেফাজত করে এবং তৎসঙ্গে আমাদের সন্তানদের জন্মদান, লালন-পালন, দুগ্ধপান এবং ঘরে কতো কাজ করেন। তাদের একটু কটূ কথা সহ্য করতে হয় এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এটিই হলো নারী জাতির প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি।

আসুন, আমরা উদার হই, সহনশীল হই এবং অপরের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করি। জান্নাত প্রাপ্তির সহজতম উপায় হলো আল্লাহর বান্দাদের ক্ষমা করা। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে তার ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করবে আল্লাহপাক কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করবেন এবং যে তার ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন।

অপরের গিবত করা হলে একটু ভালো লাগে কিন্তু তাতে যার গিবত করা হয় তার কোনো ক্ষতি হয় না বরং গিবতকারীর গুনাহের বোঝাটিই ভারি হয়। এসব গিবত ও নিন্দাবাদ আসে হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে, আর হিংসুকের জন্য জান্নাতে কোনো স্থান নেই। লাইলাতুল কদরসহ বিশেষ বিশেষ রাতে আল্লাহপাক তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন, কিন্তু তাদেরকে নয় যারা মুশরিক ও হিংসুক। আল্লাহপাক আমাদেরকে উদার ও সহনশীল এবং একে অপরকে ক্ষমা করার গুণ দান করুন। এই উদারতা ও ক্ষমাশীলতা শুরু হোক আমাদের পরিবার হতে। আমিন। ঈষৎ পরিবর্তিত।

১১.০২.২০২২ তারিখ কুচিয়ামোড়া বাজার জামে মসজিদে প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালীর জুমা আলোচনা।

Comments