Skip to main content

জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভের মাঝেই রয়েছে সাফল্য

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম


অবশেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকে মরতে হবে এবং তোমরা সবাই কিয়ামতের দিন নিজেদের পূর্ণ প্রতিদান লাভ করবে। একমাত্র সেই ব্যক্তিই সফলকাম হবে যে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাবে এবং যাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর এ দুনিয়াটা তো নিছক একটা বাহ্যিক প্রতারণার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। সুরা আলে ইমরান ১৮৫

(হে মুসলমানগণ!) তোমাদের অবশ্যই ধন ও প্রাণের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এবং তোমরা আহলে কিতাব ও মুশরিকদের থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি এমন অবস্থায় সবর ও তাকওয়ার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো তাহলে তা হবে বিরাট সাহসিকতার পরিচায়ক। সুরা আলে ইমরান ১৮৬

নামকরণ : সুরার ভেতরে আলে ইমরান উল্লেখ থাকায় চিহ্নস্বরূপ এর নামকরণ করা হয়েছে আলে ইমরান।

নাজিলের সময়কাল :
এ সুরায় চারটি ভাষণ রয়েছে। প্রথম ভাষণ সম্ভবত শুরু থেকে ৪র্থ রুকুর প্রথম দুই আয়াত পর্যন্ত বদর যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে।

দ্বিতীয় ভাষণটি ৪র্থ রুকু থেকে ৬ষ্ঠ রুকু পর্যন্ত ৯ম হিজরিতে নাজরান প্রতিনিধি দলের আগমনের সময়।

তৃতীয় ভাষণটি ৭ম রুকু থেকে ১২শ রুকু পর্যন্ত। প্রথম ভাষণের সাথে সাথে নাজিল হয়েছে বলে মনে হয়।

চতুর্থ ভাষণটি ১৩শ রুকু থেকে শেষ পর্যন্ত ওহুদ যুদ্ধের পরবর্তীকালে।

ব্যাখ্যা : এখানে যে দুটি আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে তা ওহুদ যুদ্ধের পরবর্তীকালে নাজিলকৃত। ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের বড় ধরনের বিপর্যয় হয়। সত্তর জন সাহাবি শাহাদত বরণ করেন। এখানে স্পষ্ট করা হয়েছে যে মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু থেকে কেউ রেহাই পাবে না এবং মৃত্যু এজন্যই যে দুনিয়ার জীবনে কে ভালো কাজ করে ও কে মন্দ কাজ করে সেটি যাচাই করা। আখিরাতের দিনটি হবে প্রতিদান প্রাপ্তির দিন। আমরা প্রতিনিয়তই মৃত্যু দেখছি। আমি আমার আব্বাকে হারিয়েছি, একটি ভাইকে হারিয়েছি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও কতো পরিচিত জনকে হারিয়েছি। দাদা-দাদি ও নানা-নানিকে অনেক আগেই হারিয়েছি। মৃত্যুর চেয়ে সত্য আর কিছু নেই। প্রতিনিয়তই আমরা মৃত্যু সংবাদ শুনছি ও ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রজেউন পড়ছি এবং জানাজা ও দাফন-কাফনে শরীক হচ্ছি। আমরা মুখে উচ্চারণ করছি, নিশ্চয়ই আমরা ফিরে যাব কিন্তু ফিরে যাওয়ার সেই উপলব্ধি ও নিজেকে পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টা আমাদের মাঝে খুব সামান্যই রয়েছে। সম্প্রতি হাইকোর্ট ডিভিশনের একজন বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টে নিযুক্তি লাভের পর শপথ গ্রহণের পূর্বেই তাঁর রবের কাছে ফিরে গেলেন। আমি তাঁর মাগফেরাত কামনা করছি।

দুনিয়ার জীবন একটি ধোকা ও প্রতারণা বৈ আর কিছু নয়। খুবই ক্ষণস্থায়ী এ জীবন। দুনিয়ার জীবনে ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, অর্থবৃত্ত মানবজীবনে সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি নয়। আল্লাহর ভাষায় সফল সেই ব্যক্তি যে আখেরাতে জাহান্নাম থেকে রেহাই পাবে এবং যাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের সম্মুখে জান্নাত ও জাহান্নামের পথ স্পষ্ট করেছেন। সাময়িক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মোহে মানুষ পরকাল অস্বীকার করে জুলুম-নির্যাতন ও নানা পাপাচারে জড়িত হয়। শয়তান সাফল্যের সাথে মানুষকে মৃত্যু ও পরকালকে ভুলিয়ে দিয়েছে।

আল্লাহর জান্নাত অত্যন্ত দামী এবং মূল্য দিয়েই তা অর্জন করতে হবে। সুরা তওবা ১১১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জানমাল খরিদ করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে, মারে ও মরে। তাদের প্রতি জান্নাত দানের ওয়াদা আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা। আর আল্লাহর চেয়ে বেশি ওয়াদা পালনকারী আর কে আছে? এখানে (১৮৬ নং আয়াত) আল্লাহপাক স্পষ্ট করেছেন যে তিনি তাঁর বান্দাদের ধন ও প্রাণের পরীক্ষা নেবেন। আল্লাহ তায়ালা সকল নবি- রসুলকে দাঁড় করিয়েছেন সমসাময়িক স্বৈরশাসকদের মোকাবেলায়। নমরুদের বিরুদ্ধে হজরত ইবরাহিম আ. -কে, ফেরাউনের বিরুদ্ধে হজরত মুসা আ.-কে এবং নবি মুহাম্মদ সা.-কে তাঁর সময়ের আবু জেহেল ও আবু লাহাবদের মোকাবেলায়। হক ও বাতিলের (সত্য- মিথ্যার দ্বন্দ্ব) দ্বন্দ্ব চিরন্তন। আল্লাহর বাণী, যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে আর যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। তোমরা শয়তানের সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে লড়াই করো আর বিশ্বাস করো শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল। সুরা নিসা ৭৬।

পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহ বলেছেন, আহলে কিতাব (ইহুদি ও খৃষ্টান) এবং মুশরিকদের (যাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়নি) থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। এটি আল্লাহ তায়ালার বাণী, যারা ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে দেখতে চায় তাদের সাথে ইসলামের দুশমনদের শত্রুতা অবশ্যম্ভাবী। তৎকালে ইসলামের শত্রুতায় আহলে কিতাব ও মুশরিক উভয়ই ছিল তৎপর। মূলত এরা উভয়ই কাফির। যারা আল্লাহর বিধান অমান্য করে অন্য কিছু চায় তারা সবাই কাফির। মুসলমান সেই যে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ হিসেবে বিশ্বাস করে ও মেনে চলে এবং ইসলামকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। এদের জন্যই আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন যে চির শান্তির আবাস জান্নাত।

আহলে কিতাব ও মুশরিকদের বিরোধীতার জবাবে আল্লাহ তায়ালা ধৈর্য ধারণের তাগিদ দিয়েছেন। একটি লাশ পড়লে দশটি লাশ ফেলতে বলেননি বা প্রতিশোধ হিসেবে প্রতিপক্ষের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দিতেও বলেননি। প্রতিশোধ গ্রহণ না করলে শয়তান উস্কানি দেয় এবং তার চেলারা বলে ভীরু-কাপুরুষ, পাল্টা মার লাগাও। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, শয়তানের প্ররোচনা অনুভব করলে আল্লাহর আশ্রয়ে চলে এসো। এখানে আল্লাহপাক সবর অবলম্বন ও তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করাকে বিরাট সাহসিকতার পরিচায়ক বলে উল্লেখ করেছেন। ইসলামের দুশমনরা যতো গালি দিক ও অন্যায় আচরণ করুক তার জবাবে একজন মুমিন অবশ্যই নৈতিকতার সীমা রক্ষা করে চলবে। প্রতিশোধ নয়, আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের মাঝে উদারতা ও ক্ষমাশীলতার গুণ পছন্দ করেন। তাঁর বাণী, অন্যায়ের প্রতিবিধান সম পরিমাণ অন্যায় কিন্তু কেউ যদি ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে নেয় তার পুরস্কার আল্লাহর জিম্মায়। মজলুমের অধিকার আছে বদলা গ্রহণের। কিন্তু দেখা যায় বদলা গ্রহণ করতে গিয়ে প্রায়ই বাড়াবাড়ি হয়ে যায় এবং তখন মজলুম নিজেই জালেমে পরিণত হয়ে পড়ে। তাই সবচেয়ে নিরাপদ হয় ক্ষমা করে দেয়া। বিনিময়ে আখিরাতে আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাত প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে।

শিক্ষা : এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং মৃত্যুর পরে আর কখনই এই দুনিয়ায় ফিরে আসা সম্ভব নয়। তাই আমাদের উচিৎ কালক্ষেপণ না করে দ্রুত আল্লাহর কাছে ফিরে আসা অর্থাৎ তওবা করা। ভালো ও মন্দ কোনো আমলই নষ্ট হবে না এবং আখিরাতে আমরা তার পূর্ণ প্রতিফল লাভ করবো। ভালো কর্মের বিনিময়ে জান্নাত এবং মন্দের বিনিময়ে জাহান্নাম। আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হই এমন সকল কর্ম থেকে আল্লাহপাক আমাদেরকে হেফাজত করুন। ০৫.০২.২০২২

Comments