Skip to main content

বিবাহ বিচ্ছেদ : এক সামাজিক সমস্যা

 বিবাহ বিচ্ছেদ : এক সামাজিক সমস্যা


মানুষ ঘরবাঁধে আজীবন একসাথে চলার লক্ষ্যে এবং উভয়ই যদি আল্লাহর নেক বান্দা হয়ে থাকে তাহলে এই জুটি মৃত্যুর পরে জান্নাতেও একত্র থাকতে পারবে। মজার ব্যাপার হলো দুনিয়ার জীবনে মনোমালিন্য বা বিদ্বেষ থাকলেও জান্নাতে শুধুই প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা ও প্রশান্তি লাভ করবে। মানুষ বিয়েসাদী করে পরস্পর থেকে সুখ ও শান্তি লাভের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কাঙ্ক্ষিত প্রশান্তি লাভে ব্যর্থ হয়ে মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্যেই শান্তি খুঁজে। কিন্তু শান্তি তখন সোনার হরিণ হয়ে পড়ে। পিতামাতা, বন্ধুমহল ও সমাজ তাদেরকে ভালো চোখে দেখে না। বিবাহ বিচ্ছেদে পুরুষ অপেক্ষা নারী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর চাওয়ার প্রেক্ষিতেই (আদালতের পর্যবেক্ষণ) বিচ্ছেদ ঘটে। এক জরিপে দেখা গেছে ৭০.৮৫ ভাগ নারী ডিভোর্স চায় এবং ২৯.১৫ ভাগ পুরুষ স্ত্রীকে তালাক দেয়। বর্তমানে রাজধানীতেই নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ৪৯ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন।

আজকে ১১.০১.২২ তারিখের পত্রিকায় (দৈনিক নয়া দিগন্ত ২য় পৃষ্ঠা) প্রকাশিত খবরের (বিচ্ছেদের আবেদনের মধুর সমাপ্তি। রায়ে কাঁদলো হাজারো মানুষ) প্রেক্ষিতে আমার এই লেখা। অভিনন্দন বিচারক মতিউর রহমানকে। বিবাহ বিচ্ছেদ নয়, বরং সবারই উচিৎ নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিবাহের মতো মধুর সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ ঘটানোর মাধ্যমে শয়তান উৎফুল্ল হয়। তার সর্বাধিক প্রিয় কাজ হলো মানুষকে দ্বীন শিক্ষা থেকে বিরত রাখা ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে বিচ্ছেদ ঘটানো। শয়তান মানুষের চিরশত্রু। বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে সে শুধু দুইজন ব্যক্তিকে নয় বরং দুটি পরিবারসহ অসংখ্য মানুষকে শাস্তি দিয়ে থাকে।

সমাজবিজ্ঞানীরা বিবাহ বিচ্ছেদের নানা কারণ উল্লেখ করেন। বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে প্রগতিশীল ও অভিজাত পরিবারেই বিবাহ বিচ্ছেদের আধিক্য। এর মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধের ঘাটতি প্রধানতম কারণ। ফলে পর্দাহীনতা ও পরকীয়ার মতো ঘটনা ঘটে। পর্দার প্রতি উদাসীনতা অবাধ মেলামেশার সুযোগ করে দেয়। নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ প্রকৃতিগত এবং বিয়ের মধ্য দিয়েই কেবল পরস্পরকে একত্র হওয়ার সুযোগ বিভিন্ন ধর্মে স্বীকৃত। স্বামী-স্ত্রী ও তাদের থেকে পাওয়া সন্তান-সন্ততি মানুষকে প্রশান্তি দান করে এবং বিনোদনের সর্বোত্তম মাধ্যমও বটে।

ইসলামে হালাল কাজের মধ্যে সর্বাধিক ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় কাজ হলো বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক। কৃত্রিমভাবে খুলা গ্রহণ করা (মিথ্যা দোষারোপ করে স্বামী থেকে বিচ্ছেদ চাওয়া) প্রসঙ্গে হাদিসে সেই নারীকে মুনাফিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং আরো বলা হয়েছে যে অন্যায়ভাবে বিচ্ছিন্ন হতে চাইবে সে জান্নাতের সুবাস থেকে বঞ্চিত হবে। তালাকের অধিকার দেয়া হয়েছে পুরুষকে। মিলেমিশে চলা একান্ত সম্ভব না হলে সর্বশেষ উপায় হলো তালাক বা স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ ঘটানো। নিজেরা চেষ্টা করবে, বিছানা আলাদা করে দিবে, উভয় পরিবারের সদস্যরা মিলমিশ করে দেয়ার চেষ্টা করবে। সবকিছু ব্যর্থ হলে স্ত্রীর পবিত্রাবস্থায় স্বামী একবার তালাক দিয়ে নিজ বাড়িতেই রেখে দিবে। এর মধ্যে ফিরে আসলে খুবই ভালো। না হলে দ্বিতীয়বার তালাক দিবে এবং এভাবে পরপর তিনবার তালাক দিলেই কেবল তালাক কার্যকর হবে। এমন প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে অধিকাংশ সময় মিলমিশ ঘটে যায়।

পৃথিবী একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। জীবনটা সরল রেখায় চলে না। এখানে ঘাত-প্রতিঘাত রয়েছে। কর্মক্ষেত্র, সমাজ ও বন্ধুমহল এবং দাম্পত্যজীবনে মান-অভিমান, রাগ হতেই পারে। স্বউদ্যেগে দূর করা হলো একজন বিশ্বাসী ব্যক্তির দায়িত্ব এবং প্রথমে যে সম্পর্ক ঠিক করে নেয় সে প্রভূত সওয়াবের অধিকারী হয়। আল্লাহপাক স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে শত্রু উল্লেখ করেও ক্ষমা করার কথা বলেছেন। তাঁর বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে কতিপয় তোমাদের শত্রু, তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো। তোমরা যদি তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দাও, তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করো এবং তাদের মাফ করার নীতি অবলম্বন করো, তবে আল্লাহ তায়ালা পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু’- সুরা তাগাবুন ১৪। শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করার পরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা না বলে পরস্পরকে ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে।

কুরআনে বর্ণিত কিছু ঘটনা আমরা লক্ষ করতে পারি। নুহ আ.-এর ছেলে ছিল পিতার অবাধ্য। আল্লাহর নাফরমানির কারণে যখন শাস্তি হিসেবে সেই জাতির উপর মহাপ্লাবনের মতো গজব নেমে আসে তখন কেনান গর্ব করে বলেছিল সে পাহাড়ের চূড়ায় উঠবো। ডুবতে থাকলে পিতা নূহ আ. হাত বাড়ালেও আল্লাহ না করে দেন। ইবরাহিম আ. আল্লাহর নবি আর তাঁর পিতা আজর নমরুদের সহযোগী ও সন্তানের কট্টর দুশমন। এতো কিছুর পরও পিতার জন্য ইবরাহিম আ.-এর দোয়া করার কথা জানা যায়। আমরা লুত আ.-এর স্ত্রীর কথা জানি। স্বামীর অবাধ্য এই স্ত্রীকে তালাক দেয়ার কথা জানা যায় না বরং যখন গজব নেমে এসেছিল তখন স্ত্রীকে সাথে নেয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর পক্ষ থেকে না করা হয়েছিল। ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া আ.-এর কথা কে বা না জানে? ঈমান আনার কারণে জালেম স্বামীর কাছ থেকে সীমানহীন জুলুম-নির্যাতন নীরবে সহ্য করে আল্লাহরই কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। রোগ-ব্যাধি দিয়ে হজরত আইউব আ. যে পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন তা মনে হয় আর কেউ হননি। সবাই ছেড়ে গেলেও বিবি রহিমা তাঁর স্বামীকে ত্যাগ করেননি। জগতবাসির কাছে স্বামীভক্তির চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সমগ্র নারী জাতির জন্য আদর্শ হয়ে আছেন।

উপরে কুরআনের আয়াত ও কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো। একটু ভাবুন তো, আপনার স্ত্রীকে লুত আ.-এর স্ত্রীর সাথে, আপনার পিতাকে ইবরাহিম আ.-এর পিতার সাথে, আপনার সন্তানকে নূহ আ.-এর সন্তানের সাথে, আপনার স্বামীকে আছিয়া আ.-এর স্বামীর সাথে তুলনা করে নিশ্চয়ই বলবেন আমার স্ত্রী/স্বামী/পিতা/সন্তান অনেক ভালো। এখন প্রয়োজন পরস্পরকে ক্ষমা করা, দোষত্রুটি উপেক্ষা করা এবং সেটি যদি সম্ভব হয় তাহলে আল্লাহকে পাবেন পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু হিসেবে। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন এবং তিনি ধৈর্যের পুরস্কার দুনিয়া ও আখেরাতে দান করবেন। বান্দার সাথে আল্লাহ কখনো মিথ্যা বলতে পারেন না। বিবি রহিমা স্বামী সেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন, আমরা বৃদ্ধ পিতা-মাতা এবং স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সেবা করে জান্নাতে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করে নিতে পারি।

দাম্পত্য কলহ কখনই হবে না এমনটি নয়। আমি প্রথমেই বলেছি, জীবনটা সরল রেখায় চলে না। এসবই পরীক্ষা এবং পরীক্ষার মধ্য দিয়েই আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে। স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনেও দাম্পত্য কলহ দেখা দিয়েছে এবং সাহাবয়ে কেরামের জীবনেও ঘটেছে। প্রয়োজন দ্রুত মিটিয়ে ফেলা এবং দোষত্রুটি উপেক্ষা করা ও ক্ষমা করা। হজরত ওমর রা.-এর খেলাফত আমলে জনৈক সাহাবি স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে খলিফার কাছে আসেন। খলিফার বাড়ি তো আর রাজপ্রাসাদ নয়, তিনি খলিফার বাড়িতে আসার পর ভেতর থেকে তাঁর স্ত্রীর জোরে জোরে আওয়াজ শুনতে পান। ভাবলেন, আমার চেয়ে খলিফা আরো বড় অসহায় এবং এমনটি মনে করে ফেরত যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় খলিফা বাইরে বের হয়ে তাকে ডাকেন। তখন লোকটি বলেন, আমি যে উদ্দেশ্যে এসেছিলাম সেটি আর বলতে চাচ্ছি না, আপনিও আমার মতো অসহায়। খলিফা তাকে বললেন, দেখ তারা আমাদের কতো খেদমত করেন, তার বিনিময়ে একটু কটু কথা বললে সেটি সহ্য করতে হয়। সংসারে সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই।

স্বামী-স্ত্রী এবং ভাইয়ে-ভাইয়ে বিরোধে উস্কানি দান নয় বরং মিটিয়ে ফেলার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়াও বৈধ। ইসলামে মিথ্যা বলা কঠিন অপরাধ এবং হাদিসে বলা হয়েছে সকল পাপের মা ও মুনাফিকের স্বভাব। অথচ স্বামী-স্ত্রী ও ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ মিটিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে মিথ্যাবলা আর পাপ থাকে না সেটি হয়ে যায় সওয়াবের কাজ। যেমন, একজন বললো, ভাই ভাবীর সাথে কথা হলো- তিনি তো আপনার জন্য একেবারে পেরেশান, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার ভাবীকে এসে বললো, আপনি কি ভাইয়ের অবস্থা জানেন? আপনার জন্য তো পাগল হতে বাকি। ফিতরাতের ধর্ম ইসলামে এসব আর মিথ্যা থাকে না।

ইসলাম চায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে মধুর। সেখানে থাকবে আস্থা, ভালোবাসা ও নির্ভরতা। কুরআনের ভাষায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা বলা হয়েছে পরস্পরের বন্ধু ও সাথী। এটি ঠিক, স্বামীকে করা হয়েছে সংসারে কর্তৃত্বশীল এবং ঈমানদার নারী স্বামীর আনুগত্য করে থাকে। আল্লাহর বিধানের পরিপন্থি না হলে স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর জন্য ফরজ এবং আল্লাহর বিধান পালনের সাথে সাথে স্বামীর অনুগত নারীকে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে খুশি প্রবেশের সুসংবাদ শুনিয়েছেন। আবার ভয় দেখিয়েছেন, মিরাজের রাতে দেখলাম, জাহান্নামে অধিকাংশ নারী এবং এর অন্যতম কারণ পর্দাহীনতা ও স্বামীর অবাধ্যচরণ। পাশাপাশি স্ত্রীর প্রতি সদাচরণ করতে স্বামী বাধ্য। হাশরের ময়দানে স্বামীর পক্ষে বা বিপক্ষে স্ত্রীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। নিশ্চয়ই স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহারকারী স্বামী সেদিন আটকে যাবে।

দাম্পত্য জীবনে পরস্পরের প্রতি সুধারণা, সদাচরণ এবং একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসার মাধ্যমে সম্ভব দাম্পত্য জীবনে স্থিতি, প্রশান্তি এবং আখেরাতে একত্রে জান্নাতে অবস্থান। আল্লাহপাক আমাদেরকে ইসলামের সীমার মধ্যে চলার মাধ্যমে সুখী দাম্পত্য জীবনের অধিকারী হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন। ১২.০১.২০২২।

Comments