Skip to main content

মুহাম্মদ সা. সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক প্রশংসিত ও সর্বোচ্চ প্রশংসাকারী

 

জুমার খুতবা

০৩.১২.২০২১

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর প্রিয়তম নবি সা.-এর জন্ম, শৈশব ও খতমে নবুওয়াত নিয়ে আলোচনা করেন।

নবিকূলের সরদার ও সর্বশেষ নবি মুহাম্মদ সা. আরবের বিখ্যাত কুরাইশ বংশের বনু হাশেম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ আর রাহীকুল মাখতুম ও ইবনে হিশামে উল্লেখ রয়েছে যে, মুহাম্মদ সা.-এর জন্ম হয়েছে ৯ রবিউল আউয়াল। আবার কেউ বলেছেন ১১ বা ১২ রবিউল আউয়াল। জন্ম তারিখ নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও জন্মবার নিয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। রসুলুল্লাহ সা. নিজেই বলেছেন আমি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছি এবং শুকরিয়া হিসেবে সোমবারে রোজা রাখি। রসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাত হিসেবে কেউ সোমবারে রোজা রাখলে সে সওয়াব পাবে।

মুহাম্মদ সা.-এর জন্মের পূর্বে তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ বাণিজ্য উপলক্ষে মদিনা গিয়েছিলেন এবং ফেরার পথে ইন্তেকাল করেন। তিনি এতিম অবস্থায় দুনিয়ায় আগমন করেন। আল্লাহপাক তাঁকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তোমাকে কি এতিম অবস্থায় পাননি? আমিনার কোলে যেদিন মুহাম্মদ সা.-এর আগমন ঘটে সেদিনটি ছিল দাদা মুত্তালিবের জন্য খুবই আনন্দের। গর্ভে থাকাকালীন মা আমিনা সন্তানকে নিয়ে যেসব স্বপ্ন দেখতেন তা তিনি শ্বশুর আব্দুল মুত্তালিবকে অবহিত করেন। জন্মের পর মুহাম্মদ সা.-কে দাদার কোলে দিলে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি নাতিকে খৎনা করা ও নাড়িকাটা এবং শরীরে কোনো ময়লা-আবর্জনা ছাড়া পরিচ্ছন্ন অবস্থায় পান। তিনি তাঁর নাতিকে কাবার ভিতরে নিয়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। তাঁর গর্বের ধন এতিম নাতিকে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ও আত্মীয় পরিজনের কাছে পরিচিত করে নিজে নাতির প্রশংসা করেন এবং সাথে সাথে নাতিকে দেখে সবাই প্রশংসা করেন।

মুহাম্মদ সা.-এর জন্মের ৭ দিনে আকিকা উপলক্ষে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ও বংশের লোকদেরকে দাওয়াত দেন এবং নাতির নাম রাখেন ‘মুহাম্মদ’- যার অর্থ সর্বোচ্চ প্রশংসিত। তৎকালে আরবের রীতি অনুসারে সম্ভ্রান্ত পরিবারে নবজাত সন্তানের লালন-পালনের জন্য অর্থের বিনিময়ে অন্য নারীর কাছে দেয়া হতো এবং যারা লালন-পালন করতেন তারা দুধমা হিসেবে সম্মানিত হতেন। তায়েফ থেকে একটি কাফেলা নবজাত সন্তান খোঁজার লক্ষ্যে মক্কায় আগমন করে। সেই কাফেলায় ছিলেন হজরত হালিমা রা. এবং তাঁরা ছিলেন বেশ অসচ্ছল। একটি দুর্বল গাধায় চড়ে তিনি তাঁর স্বামীর সাথে মক্কায় আসেন। তাঁর কাফেলার সবাই দ্রæত এসে ধনী পরিবারের সন্তান নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন। শেষে হালিমা রা. খোঁজ পান আব্দুল মুত্তালিবের ঘরে একটি এতিম সন্তান রয়েছে। এতিম শুনে তাঁরা একটু দ্বিধাদ্বন্দে পড়েন। শেষে সিদ্ধান্ত নেন যে শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন। আব্দুল মুত্তালিব তাদেরকে স্পষ্ট করেন যে তাঁর নাতি এতিম, উচ্চ পারিশ্রমিক ও বখশিস প্রদান করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

শিশুকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল গ্রামের আবহাওয়া নির্মল ও স্বাস্থ্যপ্রদ এবং সেখানকার ভাষা বিশুদ্ধ আরবি। মক্কায় নগর সভ্যতার প্রভাব এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ভাষাভাষির বসবাস। ঐতিহ্য ও নানা কারণে তারা গ্রামে সন্তানকে পাঠিয়ে দিত। মুহাম্মদ সা.-এর জীবনে নানা অলৌকিক ঘটনা (মুজিজা) শিশু অবস্থা থেকেই ঘটেছে। শিশু মুহাম্মদ সা.-কে নিয়ে হালিমা রা. শীর্ণকায় গাধার পিঠে আরোহণ করলে সেই গাধা সবল হয়ে পড়ে এবং সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। হালিমা রা.-এর স্তনে দুধের আধিক্যসহ তাদের ছাগলগুলোও দুগ্ধবতী হয়ে পড়ে। হালিমা রা.-এর ছাগল যে মাঠে চরে সবাই চাইতো তাদের ছাগলগুলো সেই মাঠে চরাতে। কিন্তু তাতে কাজ হতো না। মুহাম্মদ সা.-এর আগমনে হালিমা রা.-এর গৃহ বরকতে ভরে উঠে।

আল্লাহপাকের সকল সৃষ্টির মধ্যে নবি মুহাম্মদ সা. জগতে যতখানি প্রশংসিত হয়েছেন আর কেউ তার ধারেকাছেও নেই। স্বয়ং আল্লাহপাক এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবি সা.-এর প্রশংসা করে তাঁর শানে দরুদ পাঠ করেন এবং ঈমানদার বান্দাদের প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশ প্রদান করেন। ২৪ ঘন্টা পৃথিবীর সকল প্রান্তে নবির সা. প্রতি দরুদ পাঠ ও তাঁর প্রশংসা করা হয়। এছাড়া আজান ও একামতে আল্লাহর নাম উচ্চারণের সাথে সাথে নবির নামও উচ্চারিত হয়। অমুসলিমরাও নবি মুহাম্মদ সা.-এর প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেনি। মাইকেল হার্ট তাঁর দি হান্ড্রেড বইতে মুহাম্মদ সা.-কে এক নম্বরে রেখেছেন।

আমাদের প্রিয়তম নবির সা. আর একটি নাম ‘আহমাদ’- যার অর্থ ‘প্রশংসাকারী’। কুরআন মজিদে মুহাম্মদ ও আহমদ দুটি নামই রয়েছে। ‘মুহাম্মদ’ নামে একটি সুরার নামকরণও হয়েছে। মুহাম্মদ সা. মহান আল্লাহপাকের যতটা প্রশংসা করেছেন পৃথিবীর আর কেউ তা করেনি বা করতে পারবে না। তিনি মৌখিকভাবে তওবা-ইস্তেগফার ও সুন্দর সুন্দর নামে সর্বক্ষণ আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করেছেন এবং কাজেকর্মে তিনিই প্রথম আত্মসমর্পনকারী (মুসলিম) হিসেবে নিজেকে পেশ করেছেন। জীবনে একটি মুহূর্তও তিনি আল্লাহর নাফরমানি করেননি এবং তিনি ছিলেন আল্লাহর আনুগত্যের নমুনা (মডেল)। আহার-নিদ্রা, উঠা-বসা, চলাফেরায় সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করেছেন এবং তাঁর উম্মতকে শিখিয়েছেন। সকল কাছের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা, আবার কখনো আলহামদু লিল্লাহ, কখনো সোবহান আল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, আল্লাহু আকবার বলে নিজে যেমন আল্লাহকে স্মরণ ও প্রশংসা করেছেন, তেমনি তাঁর উম্মতকেও শিক্ষা দিয়ে অভ্যস্ত করেছেন। ‘নবির সা. জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ’- একথা বলে আল্লাহপাক তাঁর নবিকে সা. অনুসরণের জন্য ঈমানদার বান্দাদেরকে জোর তাগিদ দিয়েছেন এবং এই অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর ভালোবাসা ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি।

আহমদ নামটি সুরা সফের ৬ নং আয়াতে ইসা আ.-এর জবানিতে বলা হয়েছে ‘আমার পরে একজন রসুল আসবেন, তাঁর নাম আহমদ। এই আহমদ নামকে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী দাবী করে আমি সেই আহমদ। সে বলে মুহাম্মদ সা. নবি কিন্তু শেষ নবি নন এবং নবি প্রেরণের ধারা শেষ হয়নি, আমিও একজন নবি। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী একা নন, মুহাম্মদ সা.-এর সময় ও পরে অনেক ভণ্ড নবির আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁর জীবদ্দশায় মুসাইলামা কাজ্জাব নবি দাবী করেছিল এবং তার অনেক ভক্ত-অনুরক্তও সৃষ্টি হয়েছিল। তার ভক্তরা তার কাছে মুজেজা দাবী করলে সে নানা টালবাহানা ও মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং ব্যর্থ হয়। আবু বকর রা.-এর শাসনামলে ভণ্ড নবির উৎপাত ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং মুসাইলামা ওয়াহ্শীর বল্লমের আঘাতে নিহত হয়। যুগে যুগে আরো অনেকে নবি দাবী করলেও এখন পর্যন্ত গোলাম আহমদ কাদিয়ানির কিছু অনুসারী রয়েছে। এই ভণ্ড নবির মৃত্যুও বড় করুণ অবস্থায় হয়। ল্যাট্রিনে পড়ে তার মৃত্যু হয়।

আমাদের ঈমানের শর্ত মুহাম্মদ সা. শুধু নবি নন বরং তাঁকে সর্বশেষ নবি মানতে হবে এবং তাঁর পরে আর কোনো নবি নেই। কাদিয়ানিরা এই শর্ত পূরণ না করায় সর্বসম্মত মত হলো কাদিয়ানিরা অমুসলিম। বিভিন্ন মুসলিম দেশে তাদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের দেশে অমুসলিম ঘোষিত না হওয়ায় তারা আহমাদিয়া জামাত/আহমাদিয়া মসজিদ নাম দিয়ে নানাভাবে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করছে এবং অনেককে ঈমানহারা করতে সক্ষম হচ্ছে। খতিব মহোদয় সরকারের কাছে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ও সংখ্যালঘু ঘোষণার জোর দাবী জানান। কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে তিনি মুসল্লিদের সমর্থন চাইলে সবাই দুহাত উঁচু করে সাড়া দেন। খতিব মহোদয় কাদিয়ানিদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্য তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আহবান জানান।

 

Comments