Skip to main content

ইসলামের দৃষ্টিতে বিজয়োত্তর করণীয়

বিজয় মানে আনন্দ উল্লাস। যে কোনো বড় কাজ সাধিত হলে মানুষ খুশি হয় এবং আনন্দ করে। রাতদিন পরিশ্রম করে পরীক্ষা শেষে ভালো রেজাল্ট হলে, তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে কেউ চাকরি পেলে বা মামলা- মোকদ্দমায় জয়ী হলে সে বিজয়সূচক ভি চিহ্ন দেখিয়ে আনন্দ করে। দুঃখ-কষ্টে ব্যথিত হওয়া এবং ভালো কিছু হলে আনন্দিত হওয়া মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিরই অংশ। ভালো কিছু পেলে বা হলে ইসলাম যে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয় তাহলো সে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে এবং স্বতস্ফুর্তভাবে বলে উঠবে ‘আলহামদু লিল্লাহ’। অর্থাৎ সে নিজের অর্জন মনে করে বড়াই করবে না বা অহঙ্কার করবে না। বিজয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় প্রতিদ্বন্দ্বি থাকে। যেমন, নির্বাচনে অনেকে অংশগ্রহণ করে। সবাই কঠোর পরিশ্রম করে, টাকা-পয়সা খরচ করে কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভ করে মাত্র একজন। সাধারণত আমাদের দেশে যে সংস্কৃতি চালু আছে তাতে দেখা যায় বিজয়ী ব্যক্তি সপ্তাহ ধরে বিজয়োল্লাস করে এবং অনেক সময় বিজয়ী ব্যক্তির কর্মী-সমর্থকরা বিজিত ব্যক্তির ওপর চড়াও হয়। এজাতীয় আচরণ খুবই ঘৃণ্য ও নিন্দনীয়। বরং বিজিত ব্যক্তির প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপনই হলো বিজয়ী ব্যক্তির প্রধান কর্তব্য।


রাজনীতির অঙ্গনে জয়-পরাজয় অনেক কিছু বয়ে আনে। রাজনীতিক দলসমূহের আলাদা আলাদা দর্শন, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি থাকে। বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমেই কেবল অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব এবং তারা বিশ্বাস করে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের ম্যান্ডেট লাভ করেছি। বাস্তবেও তাই হয়। তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সকল নাগরিককে তাদের কর্মী বা সমর্থক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বরং বিজয় লাভ করলে সবাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের হয়ে যায় বা মনে করা হয়। মানুষকে হেদায়াত দান ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আল্লাহপাক নবি-রসুল প্রেরণ করেন। তাঁর বাণী, ‘তিনি তাঁর আপন রসুলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দ্বীনের ওপর একে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, যদিও শিরকবাদীগণ মোটেই বরদাশত করবে না’- সুরা সফ ৯। জমিনে প্রচলিত সকল দ্বীনের ওপর আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সকল মানুষ সেই দ্বীনের অনুগামী হয়ে যায়। সুরা নসরে আল্লাহ তায়ালা সেটিই জানিয়ে দিয়েছেন।

১. যখন আল্লাহর সাহায্য এসে যায় এবং বিজয় লাভ হয়,

২. আর (হে নবি!) তুমি দেখ যে, লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করছে।
৩. তখন তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাসবিহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। নিশ্চয়ই তিনি বড় তওবা কবুলকারী।

মক্কা বিজয়সহ সামগ্রিকভাবে বাতিল ব্যবস্থাপনার ওপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার কথাই এখানে বলা হয়েছে এবং স্পষ্ট করা হয়েছে যে দ্বীনের বিজয় কেবল আল্লাহর সাহায্যেই সম্ভব। এখানে মুহাম্মদ সা.-এর কোনো কৃতিত্ব নেই, সকল কৃতিত্ব আল্লাহর। তাই নবির সা. পক্ষে গর্ব অহঙ্কার করার কোনো সুযোগ ছিল না।

এই পৃথিবীতে রসুল সা.-এর আগমনের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করে দেয়া এবং এই সুরাটি নাজিলের মধ্য দিয়ে মূলত রসুল সা.-এর মিশন সমাপ্তি এবং তাঁকে আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার কথাই বলা হয়েছে। তিনি নিজেও বলেছেন যে সুরা নসরে তাঁর মৃত্যুর কথাই বলা হয়েছে। এই সুরার নাজিল হওয়া ও তাঁর ইন্তেকাল হওয়ার মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র তিন মাস কয়েক দিন।

এখানে বিজয় বলতে মক্কা বিজয়ের দিকে ইংগিত করা হয়েছে। মক্কা বিজয়ের ফলে সমগ্র আরবে ইসলাম বিজয়ী জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। একটি অনুকূল পরিবেশ পেয়ে সে সময়ে মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। হিজরতের পূর্বে মক্কায় নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ইসলাম গ্রহণের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। আবিসিনিয়ায় হিজরত পর্যন্ত (৫ বছরে) বড়জোর শ’ দেড়েক (কোনো কোনো বর্ণনায় ১৪১ জন) লোক ইসলাম কবুল করেছিলেন। মদিনায় হিজরত করার পর ইসলাম গ্রহণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। তখন ইসলাম একটি রাষ্ট্রীয় দ্বীন (জীবনব্যবস্থা)। ফলে বিজয়ী হওয়ার পর (রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে) আর ১/২ জন করে নয়, বরং সে সময়ে গোটা পরিবার, বংশ বা গোত্র ধরে লোকে ইসলাম গ্রহণ করতেছিল। এই সুরার শুরুতে সে কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।

নবি ও ঈমানদার জনগোষ্ঠী এবং কাফির-মুশরিকদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। কাফির-মুশরিকরা বিজয়কে নিজেদের অর্জন মনে করে তাদের নেতার প্রশংসা ও বিজয়য়োল্লাসে মেতে ওঠে। প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে প্রতিপক্ষের ওপর চরম জুলুম-নির্যাতন করে। পক্ষান্তরে মুমিনদেরকে শেখানো হয়েছে, বিজয় দান আল্লাহ তায়ালার একান্ত অনুগ্রহ এবং তাঁর সাহায্য ছাড়া কখনই মুমিনদের বিজয় লাভ সম্ভব নয়। তাই প্রশংসা নেতা-কর্মীর নয়, প্রশংসা আল্লাহর। আল্লাহ তাঁর নবি সা.-কে বলে দিয়েছেন যে তাঁর রবের প্রশংসা করতে। শুধু কী তাই? তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত হওয়ায় রসুল সা. ছিলেন বেগুনাহ। এই নির্দেশের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের গর্ব ও অহঙ্কার প্রকাশের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন।

রসুল সা. ও তাঁর সাথীদের ওপর সীমাহীন নিপীড়ন- নির্যাতনে পর্যুদস্ত হয়ে যে জমিন থেকে তিনি সহায়- সম্বলহীন অবস্থায় চলে গেলেন; আবার সেই জমিনে যখন বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন তখন ক্ষমা ও উদারতার হাত প্রসারিত করে মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন- ‘ইউসুফ আ. তাঁর ভাইদের সাথে যে আচরণ করেছিলেন, আমার কাছ থেকেও তোমরা তাই পাবে। তাই যারা কাবায় আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ, যারা কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নেবে বা নিজ নিজ ঘরে আশ্রয় নেবে তারাও নিরাপদ’। এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ফলে ক্ষমা পেলেন আমীর হামজা রা.-এর কলিজা ভক্ষণকারী হিন্দা, ক্ষমা পেলেন তাঁকে হত্যাকারী ওয়াহসী এবং আবু জেহেলের ছেলে ইকরামা। তিনি শুধু মক্কাই জয় করলেন না, জয় করলেন মানুষের হৃদয়ও। ইসলামের এ সব দুশমনরা পরবর্তিতে ইসলামের সেবকে পরিণত হয়েছিলেন। এমনটি ছিল আল্লাহ তায়ালারই অভিপ্রায়।

আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে দেখতে চান ক্ষমা, সহনশীলতা ও উদারতা এবং যারা এ সব গুণে গুণান্বিত হবে তিনি তাঁদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে পুরস্কৃত করবেন। পক্ষান্তরে শয়তান তার অনুসারীদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ জাগিয়ে দেয় এবং প্রতিশোধ গ্রহণে উস্কানি দেয়। সে মারামারি, হানাহানি ও রক্তারক্তির প্রসার ঘটিয়ে পৃথিবীকে অশান্তিময় করে তার চিরশত্রু মানুষকে শাস্তি দিতে চায়। মুমিনদের মাঝে কখনো বদলা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা জাগলে আল্লাহ বলেছেন- ‘তোমরা শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও’- হা-মীম আস সাজদাহ ৩৬। নবি মুহাম্মদ সা.-এর দ্বারা এতবড় বিজয় সম্পাদনের পর এই সুরায় যে শিক্ষাটা আল্লাহতায়ালা দিলেন তা পৃথিবীটাকে শান্তিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে চিরদিনের জন্য বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে।

প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা. প্রথম ব্যক্তি যিনি শত্রুকে ক্ষমা করার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে কাফির-মুশরিকদের ইসলাম গ্রহণের পাশাপাশি ইসলামের খেদমত করারও সুযোগ করে দেন। নেলশন ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনের সেরা অংশ কাটিয়েছেন শেতাঙ্গদের কারাগারে। কারগার থেকে মুক্তিলাভের পরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়েই তিনি ঘোষণা করেন, আমরা শেতাঙ্গ-অশেতাঙ্গ নই, আমাদের পরিচয় আমরা দক্ষিণ আফ্রিকান। দীর্ঘদিনের বৈরী অবস্থার অবসান ঘটে এবং তিনি দেশ গড়ার সুযোগ পান। তাঁর এই মহানুভবতা বিশ্বছবাসীকে নাড়া দেয় এবং তিনি লাভ করেন শান্তিতে নবেল পুরস্কার। বাংলাদেশেও পক্ষ-বিপক্ষের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে হিংসা-বিদ্বেষ দূরীকরণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীসহ হত্যা ও ধর্ষণের মতো জঘণ্য অপরাধে অভিযুক্ত স্বল্প সংখ্যক ছাড়া দালাল আইনে আটক সকলকে মুক্তি দান করেন। এই ক্ষমা ঘোষণা ছিল তাঁর মহানুভবতারই পরিচায়ক।

সুরা নসরে বর্ণিত আল্লাহর শিক্ষা ও মুহাম্মদ সা. এবং মহামানবদের উদারতা ও ক্ষমাশীলতা মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলিয়ে দিয়ে একটি শান্তির সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে।

হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ ও সমাজে মারামারি-কাটাকাটি করা সবই শয়তানী কাজ। পক্ষান্তরে আল্লাহ চান তাঁর বান্দারা উদার ও ক্ষমাশীল হোক এবং পৃথিবীটাকে শান্তির আবাস হিসেবে গড়ে তুলুক। আল্লাহপাক মানবজাতিকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

Comments