বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
মাল্টিপ্ল্যান রেডক্রিসেন্ট সিটি (কুশিয়ারা, পদ্মা ও সুরমা ভবন),
মিরপুর জামে মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাইয়াফ আজকের
খুতবায় আল্লাহপাকের হামদ ও রসুল (সা)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করার পর সুরা
বাকারার ১৫৩ নং আয়াত উদ্ধৃত করেন, ‘হে ইমানদারগণ!
ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো, অবশ্যই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের
সাথে আছেন।’ কুরআন ও হাদিসের প্রচুর উদ্ধৃতিসহ তিনি সবর
নিয়ে আলোচনা করেন।
খতিব মহোদয় বলেন, সবরের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। সবর অর্থ ধৈর্য, কোনো
কাজে অবিচল থাকা, ধীর-স্থির থাকা, দৃঢ় থাকা, হতাশ না হওয়া, কাজে লেগে থাকা। মূলত
দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য নির্ভর করে সবরের ওপর। আল্লাহপাক কুরআন মজিদে নামাজের
উল্লেখ করেছেন ৮২ বার। আর ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মতে (রহ) সবরের উল্লেখ রয়েছে
৯০-এর ওপরে। আল্লাহপাক তাঁর নবি (সা)-কে সরাসরি নামাজের তাগিদ দিয়েছেন একবার
কিন্তু ‘তুমি ধৈর্যধারণ করো’- এভাবে
একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। পরীক্ষা ছাড়া আখেরাতে সাফল্যের কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিভিন্ন ভঙ্গিতে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন এবং তিনি
বলেছেন যে, তাঁকে দেখে নিতে হবে কে তাঁর উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারণ করেছে।
আল্লাহপাক বলেছেন, ‘আমি
অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো, ভয়-ভীতি, ক্ষুধা-অনাহার, জান-মাল ও ফসলাদির ক্ষতি
সাধন করে; তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দান করো’- সুরা
বাকারা ১৫৫। সকল নবি-রসুলকে আল্লাহ ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছেন। হজরত আইয়ুব (আ)-কে
এমন রোগ-ব্যাধি দিয়েছিলেন যার কারণে তাঁর এক স্ত্রী ছাড়া সকলে তাঁকে ছেড়ে চলে
গিয়েছিলেন। পরম ধৈর্যাবলম্বনের বিপরিতে আল্লাহপাক তাঁকে সবকিছু আবার ফিরিয়ে
দিয়েছিলেন। হযরত ইবরাহিম (আ) জালেমের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এবং
ধৈর্যাবলম্বনের বিনিময়ে আগুন তাঁর জন্য আরামদায়ক হয়েছিল। ইউনুস (আ) মাছের পেট থেকে
এবং মুসা (আ) ফেরাউনের দলবল থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এভাবে আলোচনা করলে দেখা যাবে
সকল নবি-রসুলই পরীক্ষার মুখোমুখি হয়ে ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আমাদের
প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনে পরীক্ষার পর পরীক্ষা। তিনি যা নন কাফেররা
তাঁকে তাই বলেছে, আল্লাহ নিজে তাঁর নবিকে সান্ত্বনা দিয়েছেন ও ধৈর্য ধরতে বলেছেন।
কাফেররা নামাজ আদায়ের সময় তাঁর মাথার ওপর উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়, শীষ দেয়,
বাজে কথাবার্তা উচ্চারণ করে সবকিছু তিনি আল্লাহর উদ্দেশ্যে সবর করেছেন।
মুহাম্মদ (সা)-এর পুত্র সন্তান সবগুলো অতি শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। এ
পরীক্ষাটি ছিল তাঁর জীবনে বড় ভয়াবহ। একেতো পুত্রহারার শোক তার ওপর কাফেরদের
উল্লাস। রসুলুল্লাহ (সা)-কে তাঁর নিকটতম আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশির পক্ষ থেকে
সান্ত্বনার পরিবর্তে তাঁকে ‘আবতার’
(শিকড়কাটা) বলে উপহাস করা হত। এমতাবস্থায় আল্লাহপাক সুরা কাউসার নাজিল করে তাঁর
নবিকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। তায়েফের পথে-প্রান্তরে নবি (সা)-কে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত
করে তুলেছিল এবং রক্তাক্ত হয়ে তাঁর পায়ের জুতা আটকে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় ফেরেশতারা
তায়েফবাসীদের ধ্বংস করে দিতে চাইলে নবি (সা) রাজি না হয়ে বলেন, এরা ইমান না আনলেও
এদের বংশধররা ইমান আনবে। এই বলে তিনি পরম ধৈর্য ধারণ করেছিলেন।
ইমানের পরীক্ষা গ্রহণ আল্লাহর এক স্থায়ী নিয়ম। বিপদ-মুসিবতে
হতোদ্যম না হয়ে যারা ধৈর্যাবলম্বন করে এবং বলে, ‘আমরা
আল্লাহরই জন্য এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাব তাদেরই জন্য সুসংবাদ’। মোমিন
মৃত্যুভয়ে ভীত নয়, কারণ সে জানে যে, মহান আল্লাহর পথে সে জীবনটা পরিচালনা করছে সেই
আল্লাহকে পাওয়া ও তাঁর প্রতিশ্রুত জান্নাত মৃত্যুর মধ্য দিয়েই কেবল সম্ভব। তাই
মৃত্যু ছাড়াও যে কোনো বিপদাপদে সে খুব স্বাভাবিকভাবে বলে আমরা তো আল্লাহরই জন্য।
ফলে তার মাঝে কোনো পেরেশানি নেই। সে এটিও জানে, বিপদ নিজে থেকে আসে না বা কেউ
চাপিয়েও দিতে পারে না বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাও নয়; সবই আল্লাহর ফয়সালা (কোনো
বিপদ কখনই আসে না, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া- সুরা তাগাবুন)। আল্লাহই বিপদ দেন এবং তা
দূর করার মালিকও তিনি। ফলে বিপদাপদে ঘাবড়ে না গিয়ে সে ধৈর্যাবলম্বন করে। এই
ধৈর্যশীলদের জন্যই রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবারিত রহমত ও অপার করুণা এবং এরাই
সঠিক পথপ্রাপ্ত (সুরা বাকারা ১৫৭)।
তিন অবস্থায় ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে। প্রথমত, আল্লাহর সকল আদেশসমূহ
মেনে চলার ক্ষেত্রে ধৈর্য। নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ পালনসহ আল্লাহর সকল বিধি-বিধান
মেনে চলা ধৈর্য ছাড়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, গুনাহসমূহ থেকে দূরে থাকার জন্য ধৈর্য।
নফস ও শয়তানের প্ররোচণা থেকে বেঁচে থাকা ধৈর্য ছাড়া সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, আল্লাহর পথে
চলার ক্ষেত্রে নানাভাবে বিপদ-মুসিবত ধেয়ে আসে। বিপদ-মুসিবতে ইসলামের ওপর টিকে
থাকা, অবিচল থাকা, দৃঢ় থাকার নামই ধৈর্য। এই তিন অবস্থাতেই ধৈর্য অবলম্বন করতে
হবে।
দুনিয়ার জীবনে সফল হওয়ার জন্যও ধৈর্য দরকার। ব্যবসা-বাণিজ্য-চাকরি
সকল ক্ষেত্রেই ধৈর্য অবশ্যম্ভাবী। পারিবারিক জীবনে সুখ-শান্তি নির্ভর করে ধৈর্যের
ওপর। একটি পরিবারে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই যদি ধৈর্যশীল হয় তবে সেই পরিবারে অনাবিল
শান্তি ও সুখ বিরাজ করে। স্বামী-স্ত্রীর কোনো একজনও যদি ধৈর্যশীল হয় তাহলেও
সংসারটা চলে যায়; কিন্তু উভয়ের মধ্যেই যদি ধৈর্যের অভাব থাকে তাহলে সে সংসারে
অশান্তি লেগেই থাকে। বর্তমান সমাজে বিচ্ছেদের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে এবং এর মূলে
রয়েছে ধৈর্যহীনতা। ধৈর্য অমূল্য সম্পদ এবং ধৈর্যের অভাব মানুষকে আত্মহত্যার মতো
সর্বনাশা পথ বেছে নিতে প্ররোচিত করে। সে তার জীবনটাকে ধ্বংস করে দেয়। অথচ সে এই
জীবনের মালিক নয়। মালিক আল্লাহ এবং তাঁর দেয়া আমানত সে নিজ হাতে ধ্বংস করে দুনিয়া
ও আখেরাতে চরমভাবে ধিকৃত হয়।
সমাজে মারামারি, হানাহানি, গুম-খুন নানাবিধ জুলুম-নির্যাতন ও
পাপাচারের মূলেও রয়েছে ধৈর্যহীনতা। ধৈর্য ধারণে ব্যর্থ হয়েই মানুষ প্রতিশোধপরায়ণ
হয়ে পড়ে। ক্ষমা করার মতো উদারতা কেবল ধৈর্যশীলদেরই থাকে। ধৈর্যের অভাবে মানুষ হিংস্র
হয়ে পড়ে যার ফলে সমাজের মানুষ দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করে। আল্লাহপাক বারবার তাঁর
বান্দাদের ধৈর্যধারণের তাগিদ দিয়েছেন এবং বলেছেন, তিনি তাঁর ধৈর্যশীল বান্দাদের
সাথেই আছেন।
দুনিয়া ও আখেরাত সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তাঁর সবরকারী বান্দাদের সাথে
আছেন, বান্দার মাঝে এই উপলব্ধি থাকলে সে হয়ে পড়ে অসীম সাহসী এবং এই সাহসী বান্দাকে
আল্লাহর পথ থেকে কেউ টলাতে পারে না। খতিব মহোদয় সবার পক্ষে আল্লাহর কাছে
ধৈর্যাবলম্বনের তৌফিক কামনা করেন।
Comments
Post a Comment