Skip to main content

আল্লাহ ক্ষমাশীল, তিনি ক্ষমা পছন্দ করেন

 জুমার খুতবা

১৮.০৬.২০২১


বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম

মাল্টিপ্ল্যান রেডক্রিসেন্ট সিটি (কুশিয়ারা, পদ্মা ও সুরমা ভবন), মিরপুর জামে মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাইয়াফ আজকের খুতবায় আল্লাহপাকের হামদ ও রসুল (সা)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করার পর ইমানদারদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ক্ষমা ও সহনশীলতা নিয়ে আলোচনা করেন।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, তিনি ক্ষমা পছন্দ করেন এবং তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যেও ক্ষমা করার গুণ ভালোবাসেন। আল্লাহপাক তাঁর মুত্তাকি বান্দাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অসংখ্য নেয়ামত দ্বারা সুসজ্জিত ও বিশালায়তনের জান্নাত এবং উক্ত জান্নাত পাওয়ার লক্ষ্যে তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতিযোগিতা করার আহবান জানিয়েছেন। তাঁর বাণী, ‘তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমার উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতা করো, আর সেই জান্নাতের জন্যও যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবী সমান, এটি মুত্তাকিদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। (মুত্তাকি তারা) যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় খরচ করে, যারা নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করে এবং যারা মানুষকে ক্ষমা করে দেয়; আল্লাহ মুহসিনদের ভালোবাসেন’- সুরা আলে ইমরান ১৩৩-১৩৪।

এখানে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের ক্ষমা পাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতা করার আহবান জানিয়েছেন। বুঝতে হবে জান্নাত প্রাপ্তির মতো নেয়ামত কেবল আল্লাহর ক্ষমার মাধ্যমেই সম্ভব। আর ক্ষমার বিনিময় হলো জান্নাত। এখানে জান্নাতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এই বলে যে, এর প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবীব্যাপী। পৃথিবীতে রাজা-বাদশাহর আভিজাত্য প্রকাশ পায় তার প্রাসাদের আয়তনের ওপর। একজন জান্নাতি ব্যক্তির মর্যাদা ও আভিজাত্য কখনো কারো সঙ্গে তুলনীয় নয়। এই বিশালায়তনের জান্নাতের মালিকানা লাভের মাপকাঠি হলো তাকওয়া। কোনো কাফির-মুশরিক দুনিয়ায় তার যতই ধন-দৌলত, বাড়ি-ঘর, আসবাবপত্র থাকুক না কেন মৃত্যুর পর তা কোনো মূল্য বহন করবে না। এখানে আল্লাহপাক স্পষ্ট বলেছেন, এটি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে কেবল মুত্তাকিদের জন্য।

মুত্তাকি কে, আল্লাহপাক তার একটি পরিচিতি দান করেছেন। মানুষের যে ধন-সম্পদ সবই আল্লাহর দান। আল্লাহর দেয়া এই সম্পদ সে আল্লাহর পথে সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় খরচ করে। মোমিন কৃপণ ও অর্থলোলুপ হয় না। সে মনে করে, তার অর্থসম্পদে আল্লাহর অসহায় বান্দাদের হক রয়েছে। এ ছাড়াও আল্লাহর দীনের প্রতিষ্ঠা লাভে সে অকাতরে খরচ করে। মুত্তাকি হওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর পথে খরচকে এখানে শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়েছে।

মুত্তাকি হওয়ার জন্য আল্লাহপাক আরো দুটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। এক. ক্রোধের সময় নিজেকে সংবরণ করে দুই. আল্লাহর বান্দাদের ক্ষমা করে। ক্রোধ নিমেষেই মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। সাধের সংসার, সুদীর্ঘকাল স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে জীবনযাপন রাগের কারণে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়। এই ক্রোধের ফলে পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই, আত্মীয়তার সম্পর্ক, বন্ধুত্ব অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। মুত্তাকিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, না এমনটি কখনই হবে না। কখনো যদি রাগের উদ্রেগ হয় তাহলে সে নিজেকে সংবরণ করে নেবে। রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে এবং শয়তান তাকে প্ররোচনা দেয় প্রতিপক্ষকে আঘাত করা বা হত্যা করার জন্য। এমন কি এই রাগই মানুষকে আত্মহত্যায় প্রলুব্ধ করে। রাগ হলে রসুলুল্লাহ (সা) পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করার কথা বলেছেন। অর্থাৎ কোনো কারণে ক্রোধের সঞ্চার হলে অজু করার কথা বলেছেন। দণ্ডায়মান থাকলে বসে পড়া ও বসা অবস্থায় থাকলে শুয়ে পড়তে বলেছেন। তাতে রাগ উপশম হয়। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মল্লযুদ্ধে যে বীর সে বীর নয়, সেই প্রকৃত বীর যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংবরণ করে। জনৈক সাহাবি রসুলল্লাহ (সা)-এর নিকট উপদেশ চাইলে তিনি বলেন, রাগ করো না।' আসলে এর মধ্যেই সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

মানুষের মাঝে রাগ থাকবে না, এমনটি নয়। এটি প্রকৃতিগত, আল্লাহই মানুষের শরীরে রাগ দিয়ে রেখেছেন। আল্লাহর চাওয়া, মানুষ যেন ক্রোধের দাস না হয়ে পড়ে। আল্লাহ, আল্লাহর রসুল ও ইসলামের কোনো হুকুম-আহকাম বা ইসলামের মর্যাদা হানিকর কোনো কিছু ঘটলে কারো অন্তরে যদি ক্রোধের সঞ্চার না হয় তাহলে বুঝতে হবে তার ইমান সংশয়পূর্ণ। ইমানের দাবী হলো, এমতাবস্থায় মোমিন ক্রোধান্বিত হবে এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধের উপায় খুঁজবে। একান্ত না পারলে মনে মনে ঘৃণা করবে।

মুত্তাকি বান্দার আর একটি বৈশিষ্ট্য, সে মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং তার সাথে মন্দ আচরণ সে ক্ষমা করে দেয়। আল্লাহপাক নিজে ক্ষমাশীল এবং বান্দার অপরাধ ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। বান্দার মধ্যে ক্ষমার এই গুণ আল্লাহর খুবই পছন্দ। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে তার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্তির এ এক বড় সুযোগ। মানুষকে ধার দিয়ে যে ঋণগ্রস্তকে অবকাশ দেয় বা ক্ষমা করে দেয় আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাকেও ক্ষমা করে দিবেন। রসুলুল্লাহ (সা) জীবনে বিশেষ করে মক্কার ১৩ বছরে নানা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু তিনি কখনই ব্যক্তিগত কারণে কোনো বদলা গ্রহণ করেননি। বরং সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অবশ্য ইসলামের কোনো বিষয়ে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তিনি শাস্তিদানে পিছপা হননি। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি যে ক্ষমার নজির সৃষ্টি করেছেন সেটি ছিল এক বিষ্ময় ও পৃথিবীবাসীর জন্য ছিল এক উজ্জল দৃষ্টান্ত।

কিন্তু দুর্ভগ্য, ক্ষমার এ গুণ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা হয়ে পড়েছি প্রতিশোধপরায়ণ। মানবজীবনে ধৈর্য একটি মহৎ গুণ। আল্লাহপাক বারবার বলেছেন, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ (সা)সহ সকল নবি-রসুল চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের মতো নিপীড়ন-নির্যাতন আর কেউ ভোগ করেননি। তাঁদের থেকে শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে আমরা আরবের অন্ধকার যুগের মতো বংশ পরম্পরা যেন শত্রুতা বজায় রাখতে চাই এবং বদলা গ্রহণের ক্ষেত্রে সীমালংঘন করে থাকি। কেউ হয়তো একটু কটূ কথা বললো আমরা তার জবাবে থাপ্পড় মারি। থাপ্পড়ের বিনিময়ে অঙ্গহানি বা হত্যা করতে উদ্যত হই। এসবই সীমালঙ্ঘন, বাড়াবাড়ি ও সুস্পষ্ট জুলুম। আল্লাহপাক মজলুমের পক্ষে আখেরাতে সকল জুলুমের বদলা গ্রহণ করবেন।

মজলুমের পক্ষে বদলা গ্রহণের সুযোগ দুনিয়াতেও আল্লাহ দিয়ে রেখেছেন। তবে বাড়াবাড়ি না করে সমপরিমাণ গ্রহণের এখতিয়ার রয়েছে, তবে ক্ষমা করা আল্লাহর পছন্দ। এমতাবস্থায় ক্ষমাকারীকে পুরস্কৃত করা আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা গিবত বা মানুষের মন্দ আলোচনা অপছন্দ করেন তবে কারো প্রতি জুলুম করা হলে ভিন্ন কথা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ্যভাবে মন্দ বলা পছন্দ করেন না, তবে যে ব্যক্তির ওপর অবিচার করা হয়েছে তার কথা আলাদা; আল্লাহ তায়ালা সবকিছুই শোনেন ও জানেন। ভালো কাজ তোমরা প্রকাশ করো, অথবা কোনো মন্দ কাজের জন্য যদি তোমরা ক্ষমা করে দাও, তাহলে আল্লাহ তায়ালা অতি ক্ষমাশীল ও প্রবল শক্তিমান’- সুরা নেসা ১৪৮-১৪৯।

কারো প্রতি জুলুম করা হলে জালেমের বিরুদ্ধে কথা বলা গিবত নয়। যদিও ক্ষমা করা আল্লাহ পছন্দ করেন এবং ক্ষমার বিনিময় হিসেবে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল। আল্লাহ প্রবল শক্তিমান এবং শক্তিমান হয়েও তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য অতিশয় ক্ষমাশীল। মানুষ সাধারণত অত্যাচারিত হওয়ার পর যখনই শক্তিমান হয়ে উঠে তখনই প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে অস্থির হয়ে পড়ে। প্রতিশোধ গ্রহণের শক্তি থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করার মধ্যেই রয়েছে মাহাত্ম্য। অবশ্য সব সময় ক্ষমার নীতি অবলম্বন করলে জালেম পেয়ে বসে। তার জুলুম থামিয়ে দেয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে বলা ও জনমত গঠন এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্যেও কল্যাণ রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, মুত্তাকি বান্দা নিজে জুলুম করবে না এবং সমাজে কেউ জুলুম করুক সেটিও বরদাশত করবে না। একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা ইসলামের লক্ষ্য। এসব গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা মুহসিন বান্দা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

খতিব মহোদয় ক্রোধ সংবরণ এবং পরস্পর ক্ষমা ও সহনশীল আচরণের জন্য তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আহবান জানান।

Comments