মাল্টিপ্ল্যান রেডক্রিসেন্ট সিটি জামে মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাইয়াফ প্রায়দিনই মাগরিবের পূর্বে সংক্ষিপ্ত মাসায়ালা-মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করেন। সম্প্রতি তিনি সুন্নাত তরিকায় নামাজ আদায়ের পদ্ধতি শেখাচ্ছেন। আজকে তিনি আলোচনায় উল্লেখ করলেন, অধিকাংশ মুসল্লি ইমাম আবু হানিফা (রহ)-এর অনুসারী (হানাফী মাজহাব) হওয়ায় তিনি সেই আলোকে আলোচনা করেন। এর অর্থ, কোনো মাজহাবকে ভুল মনে করা নয়। সকল মাজহাবই কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক, যতটুকু ভিন্নতা তার পেছনে হাদিসের সমর্থন রয়েছে। ফরজ-ওয়াজিবের মতো মৌলিক বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। স্বয়ং রসুলুল্লাহ (সা)-এর আমলেই ভিন্নতা ছিল এবং এই ভিন্নতা উম্মাহর মাঝে দলাদলি নয় বরং একটি সৌন্দর্য ও অনুসরণের ক্ষেত্রে কোনো একটি বেছে নেয়ার সুযোগ।
আমাদের মাঝে কেউ আমিন জোরে বলে, আবার কেউ আস্তে বলে- সবই রসুলুল্লাহ (সা) থেকে প্রমাণিত। রফে ইয়াদাইন কেউ করেন আবার কেউ করেন না এবং হাত বাঁধার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা রয়েছে- কেউ বুকের উপর, কেউ নাভির উপর, আবার ছেড়ে দেন, সবই সুন্নাহ সমর্থিত। এসব আমল মুস্তাহাব পর্যায়ের- যে কোনো একটি অনুসরণে কোনো সমস্যা নেই এবং নামাজে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতিও হয় না। এসব নিয়ে উম্মাহর মাঝে ঝগড়া-ঝাটি করা, বিরোধ করা, একে অপরকে গোমরাহ বলা বা তীর্যকভাবে তাকানো মোটেই ঠিক নয়। উম্মাহর মাঝে ঐক্য খুবই জরুরি। ঐক্য বিনষ্ট হয় এমন তৎপরতা থেকে আমাদের সবারই দূরে থাকা জরুরি। খতিব মহোদয় একজন উদার মানুষ এবং তিনি তাঁর বক্তৃতায় উম্মাহর ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতি সবসময় গুরুত্ব প্রদান করে থাকেন।
আমার নিজের কথা।
আমি পারিবারিকভাবে হানাফী মাজহাবের অনুসারী। তবে সকল মাজহাব ও আহলে হাদিস (তারাও একটি মাজহাব এবং অন্যদের মতো বংশ পরম্পরা অনুসরণ করে থাকে) সবাইকে সত্যাশ্রয়ী মনে করি। সকলেই সঠিক পথে রয়েছে বলে বিশ্বাস করি এবং উম্মাহর মাঝে দলাদলি করাকে কুফুরি মনে করি। কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণকে তীব্রভাবে ঘৃণা করি। ২০১২ সনে হজ করার পর রফে ইয়াদাইন করি ও মোনাজাত ছেড়ে দিয়েছি। রফে ইয়াদাইন করাতে অনেকে ভাবে ‘আমি একজন আহলে হাদিস’। কোনো বিশেষ গ্রুপে নিজেকে চিত্রিত করতে পছন্দ করি না। আল্লাহ প্রদত্ত পরিচয় ‘মুসলিম’-এতেই সন্তুষ্ট এবং এই পরিচয় নিয়ে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়াতে পারলে নিজেকে সফল ও সৌভাগ্যবান মনে করবো। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা)-এর বিধান সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ- ‘শুনলাম ও মেনে নিলাম’- আমি এই মতে বিশ্বাসী।
যতদূর মনে পড়ে, হজের সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথেই আদায় করেছি, আলহামদু লিল্লাহ। মক্কা-মদিনায় অন্যান্যদের নামাজ আদায় মনোযোগের সাথে লক্ষ করেছি এবং সেসময়ে ড. আব্দুল্লাহ বিন বাজ (রহ)-এর লেখা ছোট্ট বই ‘রসুলুল্লাহ (সা)-এর নামাজ’ পড়ার পর আমার মধ্যে এই পরিবর্তন। হজ থেকে ফিরে এসে নামাজ সম্পর্কীয় হাদিসগুলো গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করেছি এবং সেই অধ্যয়নের ফসল হিসেবে পত্রিকায় লিখেছিলাম ‘রসুলুল্লাহ (সা)-এর নামাজ’ সম্পর্কীয় একটি প্রবন্ধ। যেটি আমার লেখা ইসলামের মৌলিক ইবাদত বইতে রয়েছে।
ইমাম আবু হানিফা (রহ) ও অন্যান্য ইমাম দীনের জন্য অসাধারণ খেদমত করেছেন। সবার প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করি। মানুষ সকলেই কোনো না ইমামের অনুসরণ করতে বাধ্য কারণ তাঁরা দীন মানার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিয়ম-রীতি সবই প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ (সা) থেকেই গ্রহণ করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ)-এর বক্তব্য, ‘আমার মতের ভিন্ন কোনো হাদিস পাওয়া গেলে সেটিই আমার মত।’ এমনটি বলতে সবাই বাধ্য। আমি রফে ইয়াদাইন করি বুখারি শরীফের এ সম্পর্কীয় হাদিস (৬৯১-৬৯৫) অনুসারে। পাঁচটি হাদিসেই রফে ইয়াদাইনের কথা বলা হয়েছে (আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দেখেছি রসুলুল্লাহ (সা) নামাজে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলেছেন। তা কাঁধ বরাবর উঠেছে। রুকুর তাকবির বলার সময় তিনি এরূপ করতেন এবং রুকু থেকে মাথা তোলার সময়েও এরূপ করতেন এবং সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলতেন তবে সেজদার সময় তিনি এরূপ করতেন না- বুখারি ৬৯২।) তিরমিজী শরিফে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা)-এর হাদিসে রফে ইয়াদাইন উল্লেখ নেই। ইমাম বুখারি (রহ) ঐ হাদিসটি গ্রহণ করেননি। কোনো সমস্যা নেই। রফে ইয়াদাইন করা ও না করা উভয় ক্ষেত্রেই দলিল আছে। বুখারি শরিফের অনেকগুলো হাদিস এবং মক্কা-মদিনার লোকজনের রসুলুল্লাহ (সা)-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে একটু অগ্রগামী মনে করে কেউ এমন আমল করতেই পারে।
আমিন বলা প্রসঙ্গে তিনটি হাদিস বুখারি শরিফে উদ্ধৃত করা হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, কেউ আমিন বললে আসমানে ফেরেশতারাও ‘আমিন’ বলে থাকে। উভয় আমিন পরস্পর মিলিত হলে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়- বুখারি ৭৩৭। আমি যখন একাকী নামাজ আদায় করি তখন মক্কা-মদিনার অনুরূপ কাদ কামিতছ ছলাহ ছাড়া একামতের বাক্যগুলো একবার উচ্চারণ করি। এ প্রসঙ্গে বুখারি শরিফে চারটি হাদিস রয়েছে। হজরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। আজানের বাক্যগুলো জোড়ায় জোড়ায় এবং ‘কাদ কামিতছ ছলাহ’ ছাড়া একামতের বাক্যগুলো একবার করে বলার জন্য বেলাল (রা)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল- বুখারি ৫৭০। বরেণ্য আলেম মাওলানা মাওলানা কামালুদ্দিন জাফরি বুখারি শরিফে বর্ণিত হাদিস অনুসারে নামাজ আদায়ের পদ্ধতিসমূহ কাঁটাবন মসজিদে চালু করেছিলেন এবং তা অব্যাহত রয়েছে।
আমি শিরক ও বিদয়াতকে খুব ঘৃণা করি এবং এটি আমি লাভ করেছি আমার আব্বার কাছ থেকে। স্কুলে পড়াকালীন আমি মাওলানা আব্দুর রহীম সাহেবের লেখা ‘সুন্নাত ও বিদয়াত’ পড়েছি। কলেজে ও শিক্ষকতার সময়ে সান্নিধ্য পেয়েছিলাম মুসলিম হাই স্কুলের হেড মাওলানা মরহুম মিছবাহুর রহমান ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক মু. ইয়াকুব স্যারের। আমি চেষ্টা করতাম মাওলানা মিছবাহুর রহমানের জুমা আলোচনা ও দরস শোনার। পরবর্তীকালে ইয়াকুব স্যারের জুমা আলোচনা ও দরসে বসতাম। আল্লাহপাক তাঁদেরকে ক্ষমা করে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা দান হরুন। তাঁরা ছিলেন শিরক ও বিদয়াতের বিরুদ্ধে আপোষহীন। ড. ইউসুফ আল কারজাভী ও ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ) দ্বারা আমি অনেকখানি প্রভাবিত। তাঁদের এবং দীনের ক্ষেত্রে উদার মনোভাবাপন্ন স্কোলাররা আমার পছন্দ।
প্রথমেই উল্লেখ করেছি, ছাত্রজীবন থেকেই বিদয়াতকে আমি ঘৃণা করি। মিলাদ অনুষ্ঠান ও ফাতেহাখানিতে খানাপিনাকে অপছন্দ করি (ইছালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত খানাকে মিসকিনদের হক মনে করি)। হজের পর থেকে মোনাজাতও ছেড়ে দিয়েছি। কাবা শরিফে সকল মাজহাবের অনুসারী কর্তৃক ইমামতি করানো হয়। কোনো ইমামই নামাজ শেষে আমাদের মতো মোনাজাত করেন না। আমাদের দেশেও অনেক বিজ্ঞ আলেমের অবস্থান মোনাজাতের বিপক্ষে এবং গ্রামে পর্যন্ত অনেক মসজিদে সম্মিলিত মোনাজাত হয় না। আমি বেশ আগে হাটহাজারি থেকে প্রকাশিত মাসিক মঈনুল ইসলামে মোনাজাতকে বিদয়াত হিসেবে উল্লেখ দেখেছি। দেওবন্দ মাদ্রাসা এর পক্ষে নয় বলে জানি। হাত তুলে সম্মিলিত মোনাজাত প্রসঙ্গে একটি হাদিস উদ্ধৃত করতে চাই। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি করিম (সা) বৃষ্টির জন্য ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে দোয়ার মধ্যে তাঁর হাত উঠাতেন না। আর তাঁর হাত এতদূর উঠাতেন যে, বগলের শ্বেত অংশ দৃষ্ট হত- বুখারি ৯৬৮।
আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, কোনো আমল সম্পর্কে সুন্নাত ও বিদয়াত নিয়ে মতপার্থক্য হলে তা ছেড়ে দেয়ার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। কারণ ঐ প্রকারের সুন্নাত পালন না করার মধ্যে কোনো গুনাহ নেই। কিন্তু বিদয়াত সন্দেহে ছেড়ে দেয়ার মধ্যে ছওয়াব রয়েছে। আমি আবারও বলছি, আমাদের খতিব মহোদয়ের মতো আমিও মনে করি, মাজহাবগত মতপার্থক্যকে দীনের মধ্যে সৌন্দর্য ও আল্লাহর বিধান পালনের ক্ষেত্রে সহজতা দান করেছে। আমাদের দীন বড় উদার, কোনো সংকীর্ণতা রাখা হয়নি। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কার্পণ্য বৈ আর কিছু নয়, যা ইসলামে খুবই অপছন্দনীয়।
আল্লাহপাক আমাদেরকে শিরক-বিদয়াত থেকে মুক্ত থেকে উদার হয়ে চলার তৌফিক দান করুন এবং উম্মাহর মধ্যে দলাদলি করা থেকে হেফাজত করুন। আমিন। ২২.০৬.২০২১
Comments
Post a Comment