Skip to main content

দরসুল কুরআন

 হে ইমানদার লোকেরা! তোমাদের পিতা ও ভাইকেও বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না যদি তারা ইমান অপেক্ষা কুফরকে অধিক ভালোবাসে। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তারাই জালেম। হে নবি! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, যে ব্যবসায়ে মন্দ দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাকো এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে খুবই পছন্দ করো- এসব যদি আল্লাহ ও তাঁর রসুল এবং তাঁর পথে জিহাদ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফয়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। আল্লাহ ফাসেকদের কখনো হেদায়াত (সত্য পথের সন্ধান) দান করেন না-  সুরা তাওবা ২৩-২৪।

নামকরণ : এই সুরার দুটি নাম। এক. তাওবা, দুই. বারায়াত। তাওবা নামকরণ এই কারণে যে কতিপয় ইমানদারের তাবুক যুদ্ধে শরীক না হওয়ার জন্য যে গুনাহ হয়েছিল এই সুরায় তাদের তাওবা কবুল করে ক্ষমা করার কথা উল্লেখ রয়েছে। আর বারায়াত (সম্পর্কচ্ছেদ) এই অর্থে যে সুরার শুরুতে মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে।

বিসমিল্লাহ না লেখা : এই সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম লেখা হয়নি। না লেখার কারণ প্রসঙ্গে নানাজনে নানা কথা বলেছেন। তবে ইমাম রাযীর (রহ) বক্তব্যই সঠিক। তিনি বলেছেন, নবি মুহাম্মদ (সা) এই সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম লেখেননি, তাই সাহাবায়ে কেরামও লেখেননি এবং পরবর্তীকালে সবাই এই রীতি অবলম্বন করেছেন। বর্তমান কুরআন যে হুবুহু মুহাম্মদ (সা) থেকে এবং কোনোরূপ পরিবর্তন ছাড়াই আমাদের হাতে এসেছে এটি একটি বাড়তি প্রমাণ।

নাজিলের সময়কাল : এই সুরা তিনটি ভাষণের সমষ্টি। প্রথম থেকে পঞ্চম রুকু পর্যন্ত ৯ম হিজরির জিলকদ মাস বা কাছাকাছি সময় নাজিল হয়। নবি (সা) সে বছর হজরত আবু বকর (রা)-কে আমিরুল হজ করে মক্কায় পাঠানোর পরে এই ভাষণটি নাজিল হয়। নাজিলের সংগে সংগে নবি (সা) আলী (রা)-কে এই ভাষণটিসহ পাঠান যাতে হজে আগত লোকদের সম্মুখে পেশ করতে পারেন। তখনো আরবের মুশরিকরা হজ করতে পারতো এবং তারা উলঙ্গ হয়ে করতো। হজের মহাসমাবেশে এই ভাষণটি পেশের মধ্য দিয়ে মুশরিকদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে পরবর্তী বছর থেকে তাদের হজ নিষিদ্ধ করা হয়।

দ্বিতীয় ভাষণটি (৬ষ্ঠ রুকু থেকে ৯ম রুকুর শেষ পর্যন্ত) ৯ম হিজরির রজব মাসে বা তার কিছু আগে নাজিল হয়। সে সময়ে নবি (সা) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। ইসলাম বিজয়ী শক্তি হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে থাকবে না এখানেই শেষ হয়ে যাবে সেই প্রশ্নে জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার জন্য ইমানদারদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং যাদের মধ্যে ইমানের দুর্বলতা বা আলোস্য পেয়ে বসেছিল তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে।

তৃতীয় ভাষণটি ১০ম রুকু থেকে শেষ পর্যন্ত যা তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর নাজিল হয়। এখানে মুনাফিকদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহর পথে জিহাদের ব্যাপারে যারা দুর্বলতা প্রদর্শন করবে তাদের ইমান সংশয়পূর্ণ। জিহাদ ইমান ও কুফরের মাপকাঠি। নিষ্ঠাবান কিছু মুসলমান দুর্বলতার কারণে যুদ্ধে শরীক না হওয়ার কারণে তাদের অপরাধ ক্ষমা করার কথা এখানে বলা হয়েছে।

ব্যাখ্যা : এই দুটি আয়াতে প্রকৃত মোমিনের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। ইমান ও কুফর অর্থাৎ মোমিন ও কাফেরকে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মোমিনের নানা গুণবৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। এরা নামাজী, রোজাদার, জাকাত আদায়কারী, হজ পালনকারী হওয়ার সাথে সাথে সত্যবাদী, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালনকারী, আমানত সংরক্ষণকারী, লজ্জাস্থান হেফাজতকারী, বিনয়ী, সদাচরণকারী অর্থাৎ মানবচরিত্রের সকল সৎ গুণাবলীর উপস্থিতি মোমিনের চরিত্রে থাকতে হবে। সাথে সাথে মানুষের জন্য ক্ষতিকর সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মোমিন মুক্ত থাকবে। এজাতীয় মোমিনের জন্যই রয়েছে সুসংবাদ। কুরআন আবার এসব গুণাবলীসম্পন্ন মোমিনের কাজও বলে দিয়েছে। কুরআনের ভাষায়- যারা ইমান এনেছে তারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে আর যারা কুফুরি করে তারা লড়াই করে তাগুতের (আল্লাহদ্রোহী) পথে। তোমরা শয়তানের সঙ্গী-সাথিদের বিরুদ্ধে লড়াই করো, বিশ্বাস করো শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল- সুরা নেসা ৭৬। এখানে স্পষ্ট করা হয়েছে যে ইমানদার মাত্রই আল্লাহর পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টাকারী, পক্ষান্তরে কাফেরের চেষ্টা-প্রচেষ্টা সবই আল্লাহদ্রোহীতার পথে (তাগুতের পথে)। তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। দুটি পক্ষকে আল্লাহপাক মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন।

আল্লাহপাক সন্তানকে তার পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের জোর তাগিদ দিয়েছেন, পিতা-মাতা কষ্ট পান এমন কিছু করা সন্তানের জন্য বৈধ রাখেননি। বরং সবসময় নত হয়ে চলার কথা বলেছেন। হাদিসে নানা ভঙ্গিতে পিতা-মাতার খেদমতের কথা উল্লেখ রয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণেরও তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। অথচ এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ইমান অপেক্ষা কুফরকে যারা ভালোবাসে তারা যেই হোক এমনকি পিতা/ভাই হলেও তারা মোমিনের বন্ধু হতে পারে না। কুফরকে ভালোবাসে এমন লোককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলে সে আর ইমানদার থাকে না, হয়ে পড়ে জালেম। যারা আল্লাহর বিধান ইসলামে বিশ্বাস করে, মেনে চলে ও প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালায় প্রকৃতপক্ষে তারাই মুসলিম। পক্ষান্তরে যারা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে বিশ্বাস করে না, মানে না বা ইসলামের মোকাবেলায় অন্য কিছু কায়েম করতে চায় তারা নিরেট কাফের। আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক রয়েছে যারা ব্যক্তিজীবনে ইসলামকে ধর্ম হিসেবে মানে অর্থাৎ নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত নিষ্ঠার সাথে পালন করা সত্তে¡ও ইসলামের দুশমনদের সাথেও সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। এর কারণ হচ্ছে, ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ হিসেবে মানার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও উপলব্ধির অভাব।

কালিমা তাইয়্যেবাহ ইসলামের মৌলিক আকিদা। এই কালিমার মধ্যে সকল আল্লাহদ্রোহী (তাগুত) শক্তিকে অস্বীকার করা হয়েছে। যার কারণে সকল নবি-রসুলের সাথে সমসাময়িক রাজশক্তি ও তাদের অনুগতদের প্রচÐ বিরোধীতা হয়েছে। এই কালিমা ছিল একটি বিপ্লবাত্মক ঘোষণা। অন্যভাবে বলা যায় (কুরআনের আয়াত), তোমরা আল্লাহর অনুগত্য করো ও তাগুতকে অস্বীকার করো। তাগুতকে মেনে নিয়ে ধর্মকর্ম করা হলে তাগুত কখনই বাধা দেয় না। বরং তারা মসজিদকে সৌর্ন্দমণ্ডিত করে, বড় বড় কুরবানি দেয় ও দীনের খেদমতে কখনই কার্পণ্য করে না। রসুল (সা)-এর যে কাজ একজন মোমিনের কাজও ঠিক তাই। আল্লাহপাক রসুল পাঠিয়েছেন তাঁর দীনকে বিজয়ী করার জন্য। এই কাজ করতে আল্লাহ কখনো বলেছেন, মুশরিকরা মোটেই বরদাশত করবে না, আবার বলেছেন এব্যাপারে আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট।

মুহাম্মদ (সা) আরবে কোনো আগন্তুক ছিলেন না। তিনি মক্কা নগরিতে জন্মগ্রহণ করেন, সেখানেই বড় হন এবং আরবের লোকেরাই তাঁকে উপাধী দিয়েছিলেন আল-আমিন ও আস-সাদিক। খুব নিকট থেকে তাঁকে সবাই দেখেছে এবং মানবচরিত্রের সকল সৎ গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মাঝে। অথচ কালিমা তাইয়্যেবার দাওয়াত দানের সাথে সাথে তাঁর স্বজাতি ও বংশের লোকেরাই ভীষণভাবে শত্রুতা শুরু করে এবং এটিই স্বাভাবিক যা সকল নবি-রসুলের জীবনে ঘটেছিল। এখনো যারা নবির (সা) পন্থানুসারে মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান জানাবে একই পরিস্থিতি তাদের জীবনেও আসবে। ইসলামের দিকে আহবান বলতে তাগুতকে অস্বীকার করে জীবনবিধান হিসেবে পরিপূর্ণভাবে ইসলামকে মেনে নেয়ার আহবান।

একথা সত্য, ইসলামকে তখনই পরিপূর্ণভাবে মানা যাবে যখন ইসলাম রাষ্ট্রীয় দীন হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসুল (সা)-এর ওপর মক্কায় শরীয়ত (বিধি-বিধান) নাজিল করেননি, করেছেন মদিনায়। ১৩টি বছর মক্কায় বাধা-বিপত্তির মোকাবেলায় যে লোকগুলো তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁদের দ্বারা মদিনায় একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই ইসলামকে বিশ^বাসীর কাছে তিনি পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ইসলামকে দুনিয়াবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে সকল বাধা অপসারণের লক্ষ্যেই এই যুদ্ধ-জিহাদ। এখানে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই। এ পথে যেসব বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়ায় একে একে সবগুলোর নাম উল্লেখ করে (পিতা-মাতা, সন্তান, স্ত্রী, ভাই-ব্রাদার, আত্মীয়-স্বজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ি-ঘর) বলেছেন, আল্লাহ, তাঁর রসুল ও জিহাদ অপেক্ষা যদি অধিক প্রিয় হয় তাহলে অপেক্ষা করো আল্লাহর ফয়সালা আসার জন্য। আর আল্লাহ কখনো ফাসেকদে হেদায়াত দান করেন না।

পিতা ও ভাইকেও বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না- এমন অবস্থা তখনই দেখা দেয় যখন যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ নবি প্রেরণ করেছেন এবং সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কেউ সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালায়। হয়তো স্পষ্ট হচ্ছে না, মনে করুন আপনি একটি ইসলামী সংগঠনের কর্মী এবং আপনার চাচা ভিন্ন আদর্শের অনুসারী হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচন করছেন। চাচা স্বাভাবিকভাবে আশা করছেন, ভাতিজাসহ বংশের সবাই তাঁর পক্ষে নির্বাচন করবেন। চাচা ভাতিজাকে ডেকে তাঁর পক্ষে কাজ করার জন্য বললে আপনি বিনয়ের সাথে জানালেন, তিনি একটি দল করেন এবং সেই দলের একজন প্রার্থী রয়েছে। একথা শোনার সাথে সাথে চাচা অগ্নিশর্মা হয়ে উঠবে। চাচা বংশের সবাইকে ডেকে ভাতিজার স্পর্ধার কথা উল্লেখ করে বলবেন, তোমরা ওকে সাবধান করো নইলে আমি দেখে নেব। এই আয়াতের মর্ম তখন আপনি যথার্থই উপলব্ধি করবেন।

কুরআনকে বুঝতে হবে আল্লাহর রসুল (সা)-এর জীবন থেকে। আমি এখানে যে দুটি আয়াত উল্লেখ করেছি তা রসুলুল্লাহ (সা)-এর মদিনা জিন্দেগির একবারে শেষে এবং প্রেক্ষাপট মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও তাবুক যুদ্ধ। এই সুরায় আপনি অনেক কড়া কথাবার্তা শুনতে পাবেন- আল্লাহ মোমিনদের জানমাল খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে, তারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে, মারে ও মরে। তাদেরকে জান্নাত দানের ওয়াদা আল্লাহর জিম্মায় পাকাপোক্ত ওয়াদা। এসব পড়ার পর আপনার মনে জাগতে পারে, কিসের সংসার, কিসের ছেলেমেয়ে-স্ত্রী, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমি রওনা হলাম জান্নাতের প্রত্যাশায় শহীদ হওয়ার লক্ষ্যে। কুরআন রসুল্লাহ (সা)-এর ওপর দীর্ঘ ২৩ বছরে অবস্থার প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে। যেখানে যুদ্ধের দামামা সেখানে তো শহীদ হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার মতো ভাষণই দিতে হবে। অবশ্য এটা ঠিক, সকল মুসলমানের মাঝে শহীদ হওয়ার আকাক্সক্ষা থাকতেই হবে। কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই কাউকে শহীদ করা হতে পারে।

আল্লাহর রসুল (সা)-এর দুটি জিন্দেগি। এক. মক্কায় ১৩ বছরের জীবন, দুই. মদিনায় ১০ বছরের জীবন। মক্কায় ১৩ বছরে কোনো যুদ্ধ নেই, একতরফা মার খেয়েছেন, একঘরে জীবন কাটিয়েছেন, সঙ্গী-সাথিদের আবিসিনায় পাঠিয়েছেন এবং এক পর্যায়ে তিনি নিজেও মদিনায় হিজরত করেছেন। কোনো চোরাগুপ্তা হামলা নয়, কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ নয়, গোপনে কোনো কাফের নেতাকে হত্যা বা কোনো ধরনের সন্ত্রাস নয়। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হাত সংবরণ করো ও নামাজ কায়েম করো। কুরআন-হাদিস পাঠ করে আমার উপলব্ধি, সশস্ত্র যুদ্ধ কেবল রাষ্ট্রশক্তি বা সরকারই ঘোষণা করতে পারে। এর বাইরে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংগঠন কারো সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা বা মানুষকে আহবান জানানোর অধিকার নেই এবং করা হলে সেটি হবে সমাজে ফিতনা সৃষ্টি। ফিতনা হত্যা অপেক্ষাও জঘন্য। সন্ত্রাস বা জঙ্গিতৎপরতার সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই। হয়তো বলবেন, একতরফা শুধু মার খাবে। হ্যাঁ, কুরআন তো তাই বলে। কুরআন থেকে জানুন, গর্তওয়ালাদের কাহিনী, হজরত ইব্রাহিম (আ), মুসা (আ), জাদুকরদের ঘটনা সবই তো একতরফা। কুরআনে যে বর্ণনা তাতে দেখা যায়, আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দারা সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু কখনই ইমান থেকে বিচ্যুত হননি। অগণিত নবি-রসুল হত্যার শিকার হয়েছেন। তাঁদের সবারই লক্ষ্য ছিল মানুষকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসা এবং দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আখেরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। নবি-রসুল ও ইমানদারদের সাফল্যের কথাও রয়েছে। যেমন সোলাইমান (আ), দাউদ (আ), ইউসুফ (আ) প্রমুখের। এ সংখ্যাটি খুবই নগণ্য বরং জুলুম-নির্যাতনের শিকার হওয়ার কাহিনীই বেশি। বড় বড় জালেম ও পাপিষ্ঠ জাতির ধ্বংসের কথাও উল্লেখ রয়েছে এবং সেটি করেছেন স্বয়ং আল্লাহ। নমরুদ, ফেরাউনসহ বিভিন্ন কওমকে আল্লাহ নিজ হাতেই ধ্বংস করেছেন। শেষ নবি মুহাম্মদ (সা) ১৩টি বছর নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগের পর মদিনায় সরকার গঠনের পর তাঁর দ্বারা আল্লাহ কাফেরদের মস্তক চূর্ণ করেছেন। তাই জালেমদের বিষয়টি আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দিতে হবে।

দীন কায়েমের উত্তম পথ হলো মানুষকে ব্যাপকভাবে দাওয়াত দান এবং তাদেরকে সহযোগী করা। একদল নিবেদিত নেতা-কর্মী ও সেই জনপদের মানুষ যদি সহযোগী হন তাহলে আল্লাহপাক সেই জনপদে দীনের বিজয় দান করবেন। এটি নির্ভর করে নেতা-কর্মীদের চরিত্রমাধুর্য ও তাদের ত্যাগ-কুরবানির ওপর। হতাশা নয় মানুষকে আশার বাণী শোনাতে হবে, ক্ষমা ও সহনশীলতার কথা প্রচার করতে হবে, নেতিবাচক কোনো কর্মকাণ্ড নয় শুধুই ইতিবাচক কাজ করতে হবে। সমালোচনা ও নিন্দাবাদের জবাবে সবর করতে হবে এবং মানুষের ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে, মানুষের দুঃখ-কষ্টে সহমর্মিতা প্রকাশ ও সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, বিপদাপদে পাশে দাঁড়াতে হবে, এসবই মোমিনচরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এভাবে ইমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ একটি জনগোষ্ঠী বা দল ময়দানে দাঁড়িয়ে গেলে আল্লাহ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তিনি তাঁর নিজ অনুগ্রহে তাদের ভয় দূর করে দেবেন ও খেলাফত (রাজত্ব) দান করবেন (সুরা নূর ৫৫)। আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং পরিপূর্ণ আস্থা রেখে শুধুই ইতিবাচক কাজ অর্থাৎ নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় অগ্রসর হলে আশা করা যায় আল্লাহর সাহায্য মোমিনরা লাভ করবে।

দীন কায়েমের নামে সমাজে যারা সন্ত্রাস করে, মানুষকে হত্যা করে এরা হয় উন্মাদ, ইসলামকে ভুলভাবে বুঝেছে, নয়তো এরা ইসলামের দুশমনদের এজেন্ট। ইসলামকে বুঝতে হলে প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ (সা) থেকেই বুঝতে হবে। সন্ত্রাসের সাথে তাঁর দূরতম সম্পর্ক ছিল না। তিনি অত্যন্ত দরদের সাথে মানুষকে আল্লাহ, তাঁর রসুল ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য আহবান জানিয়েছেন এবং যারা কবুল করেছে তাদেরকে সুসংবাদ আর যারা অস্বীকার করেছে তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহর দিকে ডাকার সাথে সাথে তাগুতকে অস্বীকার করার কথাও বলেছেন। এই অস্বীকৃতির কারণেই তাঁর ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের ওপর বিপদ-মুসিবত ও জুলুম-নির্যাতন নেমে এসেছে। এই সবকিছু উপেক্ষা করে আল্লাহর পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও অবিচল থাকার নামই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।

ইমানদার জনগোষ্ঠী সকলের মৌলিক দায়িত্ব, মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান জানানো এবং সেটি সর্বাবস্থায়। মৌখিক দাওয়াত, ফেসবুকে দাওয়াত, বক্তৃতার মাধ্যমে দাওয়াত, বই ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে দাওয়াত, সামষ্টিক দাওয়াত, সর্বোপরি আমলের মাধ্যমে দাওয়াত। আখেরাতে বিশ্বাসী একজন মোমিন সবধরনের পাপাচার থেকে মুক্ত এবং সকল সৃষ্টির প্রতি দয়ার্দ ও কল্যাণকামী। আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠাপূর্ণ ইমান এবং তাঁর কাক্সিক্ষত গুণাবলীতে সমৃদ্ধ হওয়ার তৌফিক আমাদের দান করুন। আমিন। ১০.০৬.২০২১

 

Comments