Skip to main content

দাওয়াতে দ্বীন ও তার প্রতিক্রিয়া


বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম


আল্লাহর পক্ষ থেকে যত নবী-রসুল এসেছেন সবারই দাওয়াতের বিষয় ছিল এক ও অভিন্ন এবং সেটাকে আমরা কালিমা তাইয়্যেবা হিসেবে জানি- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই)। ব্যাখ্যাস্বরূপ বলা যায়- আনিই বুদুল্লাহ ওয়াজ তানিবুত তাগুত (আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করে)। কালিমার মাঝে একটি নেতিবাচক দিক রয়েছে- আল্লাহর মোকাবেলায় সবাইকে অস্বীকার করার ঘোষণা।

আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)-ও একই বিষয়ে দাওয়াত প্রদান করেছেন। কোন সম্প্রদায় বা জাতির সর্বোত্তম ব্যক্তিকেই আল্লাহপাক তাদের জন্য নবী হিসেবে মনোনীত করেন। মুহাম্মদ (সা)-ও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাঁর জাতির মঝে সবচেয়ে সৎ, চরিত্রবান, বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। মানবচরিত্রের সকল সৎ গুণের সমাবেশ তাঁর মাঝে ঘটেছিল। তাঁর জাতির লোকেরা তাঁকে আল-আমিন, আস-সাদিক হিসেবে জানতো এবং তিনি ছিলেন তাদের আমানতদার, পরামর্শদাতা ও বিবাদ-বিসংবাদের মিমাংসাকারী। জাতির বিরুদ্ধাচরণের কোন প্রমাণ তাঁর মাঝে ছিল না।

মুহাম্মদ (সা) ৪০ বছর বয়সে নবুয়তপ্রাপ্ত হন। তাঁর দাওয়াতে প্রথম সাড়া দেন তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা)। এরপর আলী (রা), আবু বকর (রা) প্রমুখ। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকাশ্য দাওয়াতের নির্দেশ আসলে তিনি তাঁর বংশীয় লোকদের একটি পাহাড়ের পাদদেশে একত্রিত করে ঘোষণা দেন- হে জাতির লোকেরা! তোমরা বলো, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তাহলেই তোমরা সফলকাম হবে। সুদ-ঘুষের কোন কথা নেই, পর্দাহীনতার কোন কথা নেই, নারী ও দাস-দাসীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন কথা নেই; শুধু একটি মাত্র কালিমা উচ্চারণের আহবান। অথচ কত নিষ্ঠুরভাবেই না জবাব দিল তাঁর আপন চাচা আবু লাহাব এবং তখন থেকেই শুরু হয় বিরোধীতা- নিন্দাবাদ ও জুলুম-নির্যাতন।

কালিমার ঘোষণা স্রেফ কোন ধর্মীয় বাক্য ছিল না, এটি ছিল একটি বিপ্লবাত্মক ঘোষণা। আরবী ভাষাভাষী আবু জেহেল, আবু লাহাবসহ সমাজের নেতৃস্থানীয়রা উপলব্ধি করেছিল যে, তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের জন্য মুহাম্মদ (সা) চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিবে। মক্কার ১৩ বছরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। সংঘাত-সংঘর্ষ এড়িয়ে কৌশলে ও গোপনে রসুল (সা) দাওয়াত দান শুরু করলেও বেশিদিন গোপন রাখতে পারেননি। আগে সামাজিক কাজ করে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করে তারপর দ্বীনের দাওয়াত দান সে কৌশলও তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি আল্লাহর মনোনীত ও তাঁর নির্দেশনায় তাঁর কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন এবং সকল বিরোধীতার মোকাবেলায় পরম ধৈর্য অবলম্বন করে সামনে এগিয়ে গেছেন। বিরোধীতার জবাব নিজে না দিয়ে শুধুই ইতিবাচকভাবে দাওয়াত দিয়েছেন। জবাবদানের দায়িত্বটি আল্লাহ নিজে গ্রহণ করে কখনো তাঁকে শান্তনা দিয়েছেন ও কখনো কাফিরদের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন এবং সাথে উন্নত নৈতিক চরিত্রে ভূষিত হওয়ার জন্য আহবান জানিয়েছেন। সে সময়ের নাজিলকৃত সূরাগুলোকে (সূরা কাউছার, সূরা লাহাব, সূরা হুমাযা ইত্যাদি) তেমনি মনে হয়।

১৩ বছরের মক্কীজীবনে তিনি এবং তাঁর সাথীরা এক তরফাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন। শুধু মুহাম্মদ (সা)-ই নন, আল্লাহর পক্ষ থেকে যত নবী-রসুল এসেছেন সবার সাথে একই ঘটনা ঘটেছে। নিপীড়ন-নির্যাতনের কাহিনীতে কুরআনের পাতাসমূহ ভরপর, কত নবী-রসুলকেই না হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহপাক সকল নবী-রসুলকে দাঁড় করিয়েছেন সমসাময়িক রাজশক্তির বিরুদ্ধে। ফিরাউনের সাথে মুসা (আ), নমরুদের সাথে ইবরাহিম (আ)-এর কাহিনী তো আমাদের খুব জানা। জালেম শাসকদের সহযোগী ছিল ধর্মীয় পীর-পুরোহিত, কায়েমী স্বার্থবাদী পুঁজিপতি ও সমাজপতি শ্রেণি। সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো সাহস এদের ছিল না এবং এরা ছিল শাসকদের উচ্ছিষ্টভোগী। আল্লাহর ভাষায়- কয়েক জন যুবক ছাড়া মুসাকে তার জাতির লোকেরা কেহই মেনে নিলো না ফিরাউনের ভয়ে ও তার নেতৃস্থানীয় লোকদের ভয়ে।

আমাদের প্রিয়তম নবী (সা)-এর ইতিহাস আমাদের সামনে বর্তমান। তাঁকে প্রেরণের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আল্লাহপাকের স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা- তিনি তাঁর আপন রসুলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দ্বীনের ওপরে একে বিজয়ী করতে পারেন, যদিও শিরকবাদীরা মোটেই বরদাশত করবে না। দ্বীনকে বিজয়ী করার টার্গেট নিয়েই তাঁর সকল কর্মপ্রচেষ্টা। সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আল্লাহতায়ালার সহায়তায় এক পর্যায়ে তিনি মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হন এবং নবগঠিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, প্রধান সেনাপতি, প্রধান বিচারপতিসহ সবই তিনি। রাষ্ট্রপরিচালনাসহ সকল কর্মকান্ড তিনি নবী হিসেবেই সম্পাদন করেছেন এবং সবই তাঁর সুন্নাতেরই অংশ। এর অর্থ এ নয় যে, সবাইকে জীবনে এক সময় রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধান বিচারপতি হতে হবে। বরং এ কাজগুলো দুনিয়ারী নয়, দ্বীনদারীরই অংশ।

পৃথিবীর ইতিহাস হলো সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব। আল্লাহতায়ালা তাঁর ইলমের ভিত্তিতে বিচার করবেন না, করবেন মানুষের আমলের ভিত্তিতে। একদিকে রয়েছে ঈমানদার জনগোষ্ঠী এবং বিপরিত দিকে রয়েছে সকল কুফুরি শক্তি। ঈমানদার ও কুফুরি শক্তির মধ্যে এ দ্বন্দ্বে আল্লাহকে দেখে নিতে হবে ঈমানের দাবীতে কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী। একজন ব্যক্তির নিজেকে মুসলিম দাবী করার অর্থ হলো সে ইসলামে বিশ্বাস করে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে ও আনুগত্য করে এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় ও এর বিজয় কামনা করে। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে কেউ যদি নিরপেক্ষ থাকে বা তার অবস্থান বাতিলের পক্ষে হয় তাহলে তার ঈমানের দাবী মিথ্যা বৈ আর কিছু নয়। আল্লাহর স্পষ্ট ঘোষণা- যারা ঈমানের পথ গ্রহণ করে তার আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে আর যারা কুফুরির পথ অবলম্বন করে তাগুতের পথে সংগ্রাম করে। তোমরা শয়তানের সঙ্গী-সাথীদের সাথে লড়াই করো, আর বিশ্বাস করো শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল। সকলের পক্ষে সক্রিয়ভাবে ইসলামী আন্দোলনে শরীক হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে তবে তার অবস্থানটা স্পষ্ট হওয়া দরকার।

দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজকে গণতান্ত্রিক পথে সম্ভব-অসম্ভের প্রশ্ন অনেকে তুলেছেন। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলে সেখানে দাওয়াত সম্প্রসারণ, দাওয়াতে সাড়া দেয়া লোকদের সংঘবদ্ধ করা ও তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় গুণাবলী ও দক্ষতা সৃষ্টি এবং জনমত ইসলামের পক্ষে আনয়নের ফলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা যতখানি সম্ভব বিকল্প কোন পন্থায় সম্ভব কি-না আমার জানা নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে নাজাতের জন্য ইসলাম প্রতিষ্ঠা আল্লাহপাক শর্ত করে দেননি বরং এ পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টার মাধ্যমে গুনাহের ক্ষমা ও জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে। অসংখ্য নবী-রসুলের জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি; এটি তাঁদের কোন ব্যর্থতা নয় বরং সেই জাতি কপালপোড়া ও তাদের ব্যর্থতা।

দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজটি একান্তই আল্লাহর। যারা এ পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় তারা মূলত আল্লাহর সাহায্যকারী। আমি বিশ্বাস করি একটি দলের জনশক্তি যদি বিশ্বাস ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হয় এবং সেই জনপদের মানুষ যদি সক্রিয় বিরোধীতা না করে তাহলে আল্লাহপাক তাঁর রহমত হিসেবে সেই জনপদে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন। এ ব্যাপারে সূরা আন নূরের ৫৫ নং আয়াত আমরা উল্লেখ করতে পারি। তাঁর বাণী-

আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদের তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদের দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দ্বীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক

সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করছি কোন কোন স্কলার বলতে চাচ্ছেন গণতান্ত্রিক পন্থায় নয় দাওয়াতের মাধ্যমে দ্বীন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বিষয়টি অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। কারণ যারা গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারা তো তাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য ব্যাপক দাওয়াতী কাজ করে থাকে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু স্কলার দাওয়াতের মাধ্যমে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করবেন এটা তাঁরা হয়তো নিজেরাও বিশ্বাস করেন না। বিশ্বব্যাপি যেখানেই যে কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠিত আছে বা করতে চায় তা অবশ্যই সুসংগঠিত দলের মধ্যেমেই সেটা সম্ভব। বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি বিষোদগার করে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা স্বৈরশাসনকে সহায়তা করারই নামান্তর।

আজ মুসলমানরা বহুধা বিভক্ত। আমাদের আকিদা লা ইলাহা ইল্লাহ। যারা এই কালিমা বিশ্বাস করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা ও যাকাত আদায় করে তারাই আমাদের ভাই। আকিদা সহীহ করা ঈমানেরই দাবী। কিন্তু এ নিয়ে উম্মাহর মধ্যে দল-উপদল সৃষ্টি মোটেই কাম্য নয়। মতপার্থক্য যা তা সবই সুন্নাত-মুস্তাহাব নিয়ে। আসলে জবাবদিহিতা রয়েছে ফরজ-ওয়াজিবে, সুন্নাত-মুস্তাহাব পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে এবং আমাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিবে। সুন্নাত-মুস্তাহাব পালনে কারো ঘাটতি থাকতেই পারে এবং এতে ভিন্নতাও থাকতে পারে; কারণ স্বয়ং রসুল (আ)-এর আমলেও ভিন্নতা ছিল। তবে বিদয়াত থেকে অবশ্য মুক্ত থাকতে হবে, যা সর্বনাশা ও জাহান্নামে পৌঁছে দেবে। মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি কুফুরি এবং আল্লাহর কাছে অসন্তুষ্টির কারণ। তাঁর বাণী-

তোমরা যেন তাদের মত হয়ে যেয়ো না, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হেদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে তারা সেদিন কঠিন শাস্তি পাবে। যেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জল হয়ে ওঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে। তাদের বলা হবে, ঈমানের নেয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরি নীতি অবলম্বন করলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এ নেয়ামত অস্বীকৃতির বিনিময়ে আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো। আর যাদের চেহারা উজ্জল হবে, তারা আল্লাহর রহমতের আশ্রয় লাভ করবে এবং চিরকাল তারা এ অবস্থায় থাকবে- আলে ইমরান ১০৫-১০৭।

বর্তমান মুসলিম বিশ্ব নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অগ্রসর হচ্ছে। আল্লাহর বাণী- তারা কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে একে অপরের প্রতি পরম দয়াবান’- সূরা আল ফাতহ ২৯। আল্লাহর বাণীর ঠিক বিপরিত অবস্থা বর্তমান এবং নিজেরা পরস্পরের রক্তপিপাসু। তোমরা পরস্পরের ভাই- এই ভ্রাতৃত্ববোধ কোথায় যেন বিলীন হয়ে গেছে। আমরা যা করছি সবই ঈমানের পরিপন্থি। আসুন, আমরা আল্লাহর কাছেই ফিরে আসি ও বলি- হে পরোয়াদেগার! তুমি আমাদের ভুলত্রুটি ও দুর্বলতা ক্ষমা করে দাও। হিংসা-বিদ্বেষ থেকে আমাদের মুক্তি দান করো এবং ক্ষমার গুণে আমাদের সমৃদ্ধ করো ও পরস্পর ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করে দাও। আমিন। ২১.০৬.১৯

Comments