মারামারি, খুনোখুনি মানব সমাজের সূচনালগ্ন
থেকে চলে আসছে। আদিপিতা হযরত আদম (আ)-এর এক ছেলে অপর ছেলেকে হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত
নরহত্যার সূচনা এবং তা অব্যাহত রয়েছে। সমাজে হানাহানি, রক্তারক্তি কখনো বাড়ে আবার কখনো
কমে। দেশে আইনের শাসন বলবৎ থাকলে তা কমে এবং মারামারি-খুনোখুনি বাড়লে সবাই বলে দেশে
আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। তখন সবাই দাবী করে আইনের কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রয়োগের যাতে
সমাজে কেউ অপরাধ করার সাহস না পায়। বর্তমানে সারা বিশ্বেই আইন-শৃঙ্খলার ক্রমাবনতি লক্ষ্য
করা যায়। তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে জননিরাপত্তা বর্তমানে বড় হুমকির সম্মুখীন।
রসুল (সা)-এর আগমনের পূর্বে আরবের সমাজটা
ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। মানুষের জান-মালের কোন নিরাপত্তা ছিল না। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই,
অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় এবং খুন-যখম ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে একে অপরের
প্রাণ হরণ করতে একটুও দ্বিধা করতো না। অনেক সময় তাদের মাঝে মারামারি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ
বংশ পরম্পরা চলতো। এ ছাড়া মানবীয় সকল সৎ গুণাবলী তারা হারিয়ে ফেলেছিল। সমাজে সুখ-শান্তি
ও নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না। সবচেয়ে বড় অবহেলিত ও নির্যাতিত ছিল নারী সমাজ ও দাসশ্রেণি।
এমনি একটি অধপতিত সমাজে আল্লাহপাক বড় করুণা
করে পাঠান তাঁর সর্বশেষ দূত মুহাম্মদ (সা)-কে। তিনি ছিলেন সকল মানবীয় গুণে ভূষিত এবং
মানবচরিত্রের সকল খারাপ দিক তাঁর মাঝে ছিল অনুপস্থিত। তিনি ছিলেন সেই সমাজের সবচেয়ে
গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি; সমাজের মানুষের আল-আমিন ও আস-সাদিক। দীর্ঘ ৪০টি বছর তিনি সেই সমাজে
বসবাস করেছেন এবং জীবনের কোন একটি মুহূর্তেও তাঁর মাঝে মিথ্যা, ধোকা-প্রতারণা-শঠতা
কেউ লক্ষ্য করেনি। সমাজের এই দুরবস্থা তাঁকে পীড়া দিচ্ছিলো, কিন্তু কোন সমাধান তাঁর
জানা ছিল না।
৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় নবুয়ত লাভের পর
তিনি মানুষকে বিশ্বাসের কথা শোনালেন। শুধুই বিশ্বাস এবং এই বিশ্বাসই মানুষের মাঝে আমূল
পরিবর্তন নিয়ে আসলো। মানুষের জানমাল হরণকারী ও নারীর ইজ্জত লুণ্ঠনকারী যুবকরাই হয়ে
উঠলো মানুষের জানমাল ও নারীর ইজ্জতের রক্ষাকারী। সেই বিশ্বাসটি হলো আল্লাহ, রসুল ও
আখিরাতে বিশ্বাস এবং এর ফলে বিশ্বাস স্থাপনকারী জনগোষ্ঠীর চরিত্রে চলে আসলো এক যুগান্তকারী
পরিবর্তন।
তিনি মানুষকে আহবান জানালেন, আল্লাহ ছাড়া
কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রসুল। তিনি আরো জানালেন, এ দুনিয়ার জীবনই চূড়ান্ত
নয়। মৃত্যুর পর তোমরা পুনরায় উত্থিত হবে এবং বিচারের সম্মুখীন হবে ও দুনিয়ায় তোমাদের
কৃত ভালো-মন্দের পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। দুনিয়ার আদালতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড,
যা আখিরাতের তুলনায় নিতান্তই মামুলি। আখিরাতের শাস্তি চিরন্তন এবং তা এতো ভয়াবহ যা
কখনই কল্পনায় আনা যাবে না। পক্ষান্তরে যারা নেক আমল করবে তাদের প্রতিদান এমন জান্নাত
যা চিরস্থায়ী এবং তার সুখও কল্পনা করা যাবে না। শুধু বিশ্বাসই অসভ্য ও বর্বর মানুষগুলোকে
পৃথিবীর সেরা মানুষে পরিণত করলো এবং তাদের হাতে গড়া সমাজ ও রাষ্ট্র সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার
সমাজে পরিণত হলো। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি, মোট কথা জননিরাপত্তা ব্যাহত হয় সবই
সমাজ থেকে দূর হয়ে গেল। নারী পেল তার পূর্ণ নিরাপত্তা এবং পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদার
আসন পেলো মা, যার পদতলে সন্তানের বেহেশত। স্ত্রী হলো রাজরানী এবং ঘোষিত হলো তোমাদের
মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। মেয়ে পেল পিতা-মাতার সম্পত্তির
অংশ এবং শুভ সংবাদ শোনানো হলো, যে তার কন্যা সন্তানের সাথে উত্তম আচরণ করবে ও লালন-পালন
শেষে যোগ্য পাত্রে পাত্রস্থ করবে আখিরাতে রসুল (সা)-এর সাথে হবে তার অবস্থান। বোনের
সাথে সদাচরণকারী ভাইয়েরও শুভ পরিণতি ঘোষিত হলো।
সমাজে এক শ্রেণির মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি-
‘দুনিয়াটা মস্তবড়ো,
খাও দাও স্ফুর্তি করো’। এই শ্রেণিটিই মূলত অমান্যকারী (কাফির)।
মুহাম্মদ (সা)-এর ঘোষণাকে তারা সহজভাবে না নিয়ে প্রচন্ড বিরোধীতা করে এবং রসুল (সা)
ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ওপর সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন চালায়। আল্লাহপাকেরই নির্দেশে রসুল
(সা) ও তাঁর সাথীরা চরম ধৈর্যাবলম্বন করেন। এটা মুমিনদের জন্য খুবই সহজ। আখিরাতে প্রতিদান
পাবে এ আশায় মুমিনরা প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে ক্ষমা করতে পারে। এটা তাদের গুণ (তোমরা দৌড়ে
এসো তোমাদের প্রভুর ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার প্রশস্ততা মহাকাশ ও পৃথিবীর
মতো। তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকিদের জন্যে, যারা ব্যয় (দান) করে সচ্ছল ও অসচ্ছল
অবস্থায়, যারা রাগ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল ও কোমল-আলে ইমরান ১৩৩)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেবল আখিরাতে বিশ্বাস
কি ব্যক্তিমানুষ ও সমাজকে অপরাধ মুক্ত করতে সক্ষম? এককথায় জবাব- না। এটা তখনই সম্ভব
যখন আখিরাতেবিশ্বাসই জনগোষ্ঠীর হাতে সমাজের কর্তৃত্ব চলে আসবে। সমাজের সাধারণ মানুষ
অনুকূল পরিবেশ পেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৎ হয়ে যাবে। আরবে সমাজের কর্তৃত্ব আবু জেহেল ও
আবু লাহাবদের হাত থেকে মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর সাথীদের হাতে চলে আসার সাথে সাথে গোটা
সমাজ পরিবর্তিত হয়ে যায়। মূলত অসৎ লোকদের হাত থেকে সমাজের কর্তৃত্ব রসুল (সা)-এর হাতে
ন্যস্ত করার লক্ষ্যেই আল্লাহপাক তাঁকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর ভাষায়- ‘তিনি তাঁর আপন
রসুলকে হেদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দ্বীনের ওপর একে বিজয়ী করতে পারেন,
মুশরিকরা যতোই অপছন্দ করুক’-সূরা তাওবা ৩৩, সূরা সফ ০৯। সূরা আল ফাতহার
২৮ নং আয়াতে একই কথার পুনরাবৃত্তি শেষে বলেছেন সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। এব্যাপারে
মতপার্থক্য করার কোন সুযোগ আল্লাহ রাখেননি। আর এ কাজের বিনিময়ও আল্লাহ বলে দিয়েছেন।
তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা, তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টারত মুমিনদের তিনি ক্ষমা করবেন ও
জান্নাতে দাখিল করাবেন এবং মুমিনদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়ও (সূরা সফ ১০-১৩) দান করবেন। বিজয়
দান আল্লাহর পক্ষ থেকে অতিরিক্ত এবং সেটা শর্তাধীন। শর্ত হলো একদল যোগ্য লোক গড়ে উঠতে
হবে এবং যে জনপদে দ্বীন কায়েম করতে চায় সে জনপদের মানুষ বিরোধী না হয়ে আকাঙ্ক্ষী হতে
হবে। কারণ এটা আল্লাহতায়ালার বড় নেয়ামত। তিনি অযোগ্য ও অপাত্রে তাঁর এ নেয়ামত দান করেন
না। দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হক ও বাতিলের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব চলবে এবং এই দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে
আল্লাহ দেখে নিতে চান কে হকপন্থী ও কে হকের বিরোধী। আখিরাতে বিনিময় প্রাপ্তির আশায়
হকের পথে মুমিনরা আমরণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় এবং সকল বিপদাপদ ও জুলুম-নির্যাতনে অবিচল
থাকে।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার এ কাজ মূলত আল্লাহর।
যারা এ পথে অগ্রসর হয় তারা আল্লাহর সাহায্যকারী এবং এরা অতি উচ্চ মর্যাদাবান। একজন
ব্যক্তি ঈমান ও নেক আমলে ভূষিত হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য জান্নাতের ওয়াদা রয়েছে।
এরা আল্লাহতায়ালার গোলাম, আর এই গোলামদের মাঝ থেকে যারা ইকামতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন
করেন তারা হলেন আনসারুল্লাহ। একটি সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ঈমান ও নেক আমলে
সমৃদ্ধ হলে আল্লাহপাক তাদের দুনিয়ায় খিলাফত দান করার ওয়াদা করেছেন (সূরা নূর ৫৫)। এখানে
পক্ষ দু’টি-এক. আল্লাহর
পক্ষ, দুই. শয়তানের পক্ষ (যারা ঈমান এনেছে তারা (সর্বদা) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, আর
যারা কুফুরি করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পক্ষে, তোমরা শয়তানের সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে
লড়াই করো, বিশ্বাস করো শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল- সূরা আন নিসা ৭৬)।
ঈমানদারদের মাঝে কোন পেরেশানী নেই। যেহেতু
আল্লাহ তাদের অভিভাবক। ঈমানদারদের সাথে যারা শত্রুতা করছে তাদের প্রতিও তাদের কোন ক্ষোভ
ও বিদ্বেষ নেই। কাফিরদের শত্রুতা মূলত আল্লাহর সাথে এবং ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্বও
আল্লাহরই। কুরআন মজিদে আল্লাহপাক সেটিই বুঝিয়েছেন। নবী-রসুল ও তাঁদের সঙ্গী-সাথীদের
ওপর সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি তের বছর মক্কী জিন্দেগীতে
রসুল (সা) ও তাঁর সাথীরা একতরফা মার খেয়েছেন এবং কোন পাল্টা ব্যবস্থা নেই। বরং আল্লাহর
পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ‘হাত সংবরণ করো ও নামায কায়েম করো’। মদীনায় একটি
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই কেবল রসুল (সা) যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া কোন
ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠী বা কোন দল যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না। কাফির-মুশরিকদের (নমরুদ-ফিরাউন-সাদ্দাদ
বা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধ্বংস) বিরুদ্ধে যতো ব্যবস্থা সবই আল্লাহ নিজের থেকে নিয়েছেন।
বরং আল্লাহ মুমিনদের যে নৈতিক উচ্চ মান
উপস্থাপন করেছেন তা এই, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রুর কল্যাণ কামনা করে যাওয়া। সূরা ইয়াসিনে
উল্লেখ করা হয়েছে, এক জনপদে তিন তিনজন রসুল এসেছিলেন এবং তাঁদের দীর্ঘ চেষ্টা-প্রচেষ্টায়
মাত্র একজন লোক ঈমান গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন। ঈমান আনার পর তিনি দেখলেন তাঁর জাতির
তো সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি তাদের দিকে দৌড়ে এসে বলেন, ‘হে জাতির লোকেরা!
তোমরা রসুলদের আনুগত্য করো যাঁরা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চান না এবং নিজেরা হেদায়াতের
ওপর প্রতিষ্ঠিত’। দুর্ভাগ্য, জাতির লোকেরা ঈমান আনার পরিবর্তে ঐ লোকটিকে
হত্যা করে। সেই সময়ে তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে- ‘হায়! আমার জাতির
লোকেরা যদি বুঝতো কিসের বদৌলতে আমার রব আমাকে ক্ষমা করলেন ও সম্মানিত লোকদের মধ্যে
গণ্য করলেন’। কত বড় শরীফ ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন যে তার হন্তার
জন্য কোন বদ দোয়া বা অকল্যাণ কামনা নয়, বরং তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়েও যদি তার জাতির
লোকেরা হেদায়াত পেত, কতই না উত্তম হতো। আল্লাহপাক এভাবেই মুমিনদেরকে উপস্থাপন করেছেন।
এমন চরিত্রের অধিকারী হওয়া সম্ভব কেবল আখিরাতে বিশ্বাসী মুমিনদেরই। এ প্রসঙ্গে স্মরণ
করতে হয় আল্লাহর বাণী- ‘ভালো কাজ তোমরা প্রকাশ করো কিংবা তা গোপন
করো, অথবা কোন মন্দ কাজের জন্য যদি তোমরা কাউকে ক্ষমা করে দাও, তাহলে তোমরা দেখতে পাবে,
নিঃসন্দেহে আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল ও প্রবল শক্তিমান’-সূরা আন নিসা
১৪৯।
মুমিন হয় বড় উদার ও প্রশস্ততার অধিকারী। সে জানে এ দুনিয়ায় আল্লাহর বান্দাদের
ক্ষমা করলে প্রতিদানে আখিরাতে আল্লাহরও ক্ষমা পাওয়া যাবে। তাই মুমিন কখনই প্রতিহিংসাপরায়ণ
হয় না এবং বদলা গ্রহণের চিন্তাও তার মাথায় আসে না। সকল বাধা-বিপত্তির মাঝেও সে নীরবে
আল্লাহর বান্দাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত তুলে ধরেন এবং সাধারণ মানুষের সকল সহানুভূতি
ও সহযোগিতা চলে আসে মজলুমের পথে; এভাবেই দ্বীনের কাজে অগ্রগতি আসে। আখিরাতে বিশ্বাস
মানুষকে সাহসী ও বেপরোয়া করে, ফলে কোন জুলুম-নির্যাতন তার পথরোধ করতে পারে না; সাথে
সাথে সে হয়ে পড়ে উদার ও বিনয়ী এবং আল্লাহর কাছে বিনিময় প্রাপ্তির আশায় সহজেই তার প্রতিপক্ষকে
ক্ষমা করতে পারে। কুরআনে বর্ণিত মুমিনের চরিত্রে নিজেকে গড়ে ওঠার তাওফিক আল্লাহপাক
আমাদের দান করুন।
Comments
Post a Comment