Skip to main content

মু. আব্দুল ওয়াহেদ-দ্বীনের তরে নিবেদিতপ্রাণ আল্লাহর এক গোলাম



মরহুম আব্দুল ওয়াহেদ আমার একজন ঘনিষ্ট বন্ধু। কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ থেকে আমরা একই সাথে ১৯৭৫ সনে অর্থনীতিতে অনার্স ও ১৯৭৬ সনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করি। তিনি এখন আর আমাদের মাঝে নেই। গত ২২/০৩/২০১৫ তারিখ রবিবার বাদ ফজর কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধ হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন)। খুব ঘনিষ্টভাবে আব্দুল ওয়াহেদ ভাইকে দেখার ও জানার সুযোগ আমার হয়েছিল। অনার্স পরীক্ষা দেয়ার পূর্ব দিয়ে আমরা কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের পেছনে একটি মেসে উঠি এবং আমরা পরস্পর Roommate ছিলাম। আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদারবক্স হলেও আমরা দু'জন একই কক্ষে থাকতাম। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, বিনয়ী ও আল্লাহর দ্বীনের প্রতি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর কণ্ঠ ছিল খুবই মধুর। সহীহ শুদ্ধ করে কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং গান গাইতেও পারতেন। তিনি সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করতেন। যদিও তিনি একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান, তারপরও তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদে পরিচ্ছন্নতা ফুটে উঠতো। তিনি খুব যত্ন করে ওযু করতেন। ওযু করার সময় তাঁর কাঁধে একটা গামছা থাকতো। তিনি খুব ধীরে ধীরে পায়ের আঙ্গুলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে হাত দিয়ে ধইতেন এবং ওযু শেষে গামছা দিয়ে পায়ের আঙ্গুলগুলোসহ যত্ন করে মুছতেন। নামাযে তাঁর মধ্যে খুব বিনয় প্রকাশ পেত। নামাযে এমনি বিনয় দেখেছি আমার ও ওয়াহেদ ভাই-এর খুবই আপনজন সাইফুল ভাই-এর মধ্যে
আব্দুল ওয়াহেদ ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও মাতৃভূমির মুক্তির লক্ষ্যেই তাঁর মহান মুক্তিযুদ্ধে গমন। তিনি কুষ্টিয়া শহরের ছেঁউড়িয়া এলাকায় লজিং থেকে লেখাপড়া করেছেন। অনার্স পড়াকালীন তিনি ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট হন। ছাত্রাবস্থায় সাইফুল ভাইদের মধ্যস্থতায় তিনি কুমারখালীর মরহুম নূরুজ্জামান ভাই-এর বোনকে বিয়ে করেন। নূরুজ্জামান ভাই-এর পরিবারটা ছিল ইসলামী পরিবার এবং তাঁর আর এক ভগ্নিপতি ছিলেন মরহুম আমানুল্লাহ (সিনিয়র সহকারী সচিব থাকাবস্থায় ইন্তেকাল করেন)। আমি এ মুহূর্তে মরহুম নূরুজ্জামান ভাই ও মরহুম আমানুল্লাহ ভাই-এর মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন তাঁদের দু'জনকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন।
আমাদের মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অশান্ত। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব মীর কাসেম আলীর রাবি সফর উপলক্ষে শিবিরের বিপক্ষে সকল ছাত্র সংগঠন জোটবদ্ধ হয়ে পড়েসেদিন কেন্দ্রীয় ক্যাফেটারিয়ায় জনাব মীর কাসেম আলীর বক্তৃতা এখনও কানে বাজে। সে সভায় প্রচুর দর্শক-শ্রোতা ছিল। পরবর্তিতে সকল সংগঠন সম্মিলিতভাবে ছাত্রশিবিরকে আক্রমণ করে এবং সাইফুল ভাইসহ অনেকের সাথে সেদিন আব্দুল ওয়াহেদ ভাই মারাত্মকভাবে আহত হন তাঁর ডান পা ভেঙ্গে যায়। সে সময়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে জনাব মীর কাসেম আলী ব্যক্তিগতভাবে আব্দুল ওয়াহেদ ভাই-এর বেশ খোঁজ-খবর রাখতেন বলে তাঁরা দু’জন খুবই ঘনিষ্ট হয়ে পড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে সাইফুল ভাই ও অধ্যক্ষ মু. আব্দুর রবের সুপারিশে আমি বসুরহাট মুজিব কলেজে যোগদান করি। আর আব্দুল ওয়াহেদ ভাই জগতি সুগার মিলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি অংক ও ইংরেজিতে খুবই পারদর্শি ছিলেন। ফলে ভালো শিক্ষক হিসেবে খুব সহজেই পরিচিতি লাভ করেন। আমি আমার কর্মজীবনে বসুরহাট (নোয়াখালি), সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম), কুষ্টিয়া, নড়াইল, যশোর, মৌলভীবাজার ঘুরে কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ থেকে ০৭/০৫/২০১১ তারিখে উপাধ্যক্ষ পদে অবসর গ্রহণ করিএ দীর্ঘ সময়েও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুটআর আব্দুল ওয়াহেদ ভাই কুষ্টিয়ায় চাকুরী করার পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সঁপে দেন। তাঁর মেধা-যোগ্যতা-আন্তরিকতা ও আল্লাহ তায়ালার মেহেরবাণীতে তিনি তরতর করে উপরে উঠে যান এবং জেলা পর্যায়ের নেতা হয়ে যান। মেধা-শ্রম-নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দিয়ে তিনি যেমন ইসলামী আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করেছেন, মহান আল্লাহও তাঁর এ বান্দাহকে এ দুনিয়ায় সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। একটি দরিদ্র ও কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও আব্দুল ওয়াহেদ ভাই ভেড়ামারা-মিরপুর আসনের এমপি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯১ সন থেকে ২০১৩ পর্যন্ত জামায়াতের কুষ্টিয়া জেলা আমীর ও পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় নেতায় পরিণত হন। এ সবই আল্লাহ তাঁর এক বান্দাহকে দিয়েছেন ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় সামান্য প্রতিদান হিসেবেআর আখেরাত তো রয়েছেই। আমাদের বিশ্বাস আল্লাহ তাঁর এ মুখলিছ বান্দাহকে অনেক নেয়ামত দান করবেন এবং অনেকের জন্য সুপারিশ করার মত সৌভাগ্যও তাঁকে দান করবেন। তাঁর এক ঘনিষ্ট বন্ধু কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ (অব.) প্রফেসর মো. হাসানুজ্জামান-এর একটি উক্তি উল্লেখ করতে চাই-'আব্দুল ওয়াহেদ ভাই! আল্লাহ আপনাকে যে জান্নাতে স্থান দিবেন সেখানে সামান্য হলেও একটু জায়গা দেয়ার জন্য আমার পক্ষে আল্লাহর কাছে মেহেরবানী করে সুপারিশ করবেন।' এ হলো আব্দুল ওয়াহেদ ভাই সম্পর্কে তাঁর বন্ধুদের মূল্যায়ন।
মরহুম আব্দুল ওয়াহেদ ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তাঁর অমায়িক ও হাসি-খুশি ব্যবহার এবং সহজ ও অনাড়ম্বর জীবন খুব সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করতো। তিনি চলার পথে অগ্রসর হয়ে মানুষের সাথে সালাম বিনিময় করতেন ও হাত মেলাতেন। তিনি ছিলেন নির্ভেজাল একজন দায়ী এবং মানুষকে দ্বীনের পথে ডাকতেন; ডাকতেন কুরআন দিয়ে। কুরআনের ওপর তাঁর অসাধারণ পান্ডিত্য ছিল। তিনি বক্তৃতায় প্রচুর কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করতেন। তিনি সারাক্ষণ মানুষকে দ্বীনের পথে ডাকার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। বিভিন্ন মসজিদে ঘুরে ঘুরে জু’মার নামায আদায় করতেন এবং মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতেন। তিনি একজন সুলেখক ছিলেন। তাঁর লেখা নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম ও সোনারবাংলায় প্রকাশিত হত। তাঁর লেখা ‘আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন চাই’ বইটি পাঠকমহলে বেশ সাড়া দিয়েছিল। তিনি কাউকে শত্রু ভাবতেন না। `Friendship to all and enemity to none’-এই ছিল তাঁর নীতি। যেহেতু তিনি তাঁর নিজের দিকে ডাকতেন না; ডাকতেন আল্লাহর দিকে। তাই তিনি মনে করতেন শত্রুতা থাকলে সেটা আল্লাহর সাথে এবং ব্যবস্থা গ্রহণের যা দরকার তা আল্লাহ নেবেন। এ ধারণা বলে তিনি সবাইকে আপন করে ভাবতেন। সততা, ন্যায়পরায়ণতায় তাঁর কোন জুড়ি নেই। তিনি ছিলেন অল্পে তুষ্ট। অভাব-অনটন ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। প্রাচুর্য কখনই তাঁকে স্পর্শ করেনি অস্বচ্ছলতা থাকলেও তাঁর পরিবারে অশান্তি ছিল না। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী ও আদর্শ পিতা। স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত দয়ার্দ। এমপি হওয়ার পর তিনি সংগঠনের পরামর্শে চাকুরীটা ছেড়ে দেন এবং সংগঠনেরই নির্দেশে এমপি হিসেবে পদত্যাগ করেন। সংগঠনে সার্বক্ষণিক সময়দানের কারণে সামান্য ভাতায় বড় কায়-ক্লেশে তাঁর দিনগুলো অতিবাহিত হত। টিনের ঘর যেখানে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে-তাই ছিল তাঁর বাসস্থান। ভাতার সামান্য ক'টি টাকা তিনি তুলে দিতেন তাঁর বিদষী স্ত্রীর হাতে। তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মহিলা বিভাগের জেলা সভানেত্রী। তাঁকে খুব সফর করতে হয়। তিনি বই-পত্র ও স্কার্পসহ কিছু কাপড়-চোপড় সঙ্গে রাখতেন এবং এসব বিক্রিলব্ধ মুনাফা তাঁর সংসার পরিচালনায় সহায়তা করতো। ইদানিং তাও বন্ধ হয়ে গেছে। আর খোঁজ করতেন কোথায় সস্তায় শাক-সব্জি-তরি-তরকারি পাওয়া যায়। আমরা সাহাবায়ে কেরামদের অনাড়ম্বর ও অস্বচ্ছল জীবন-কাহিনী পড়েছি। তাঁদের সাথে এ যুগের মানুষের কখনই তুলনা হয়না। তারপরও বলবো আব্দুল ওয়াহেদ ভাই ছিলেন আবু জর গিফারী (রা.)-দেরই স্বার্থক অনুসারী। তিনি মানুষের অভাব-অভিযোগ ও দু:খ-কষ্টে চরমভাবে ব্যথিত হতেন। অথচ তাঁর নিজের অভাব-অভিযোগ কখনও কারো কাছে প্রকাশ করতেন না। তাঁর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি জীবন দেখে অন্যরা বুঝতেই পারতো না যে এ মানুষটির পরিবারে এত অভাব-অনটন। তিনি সৌন্দর্যপিপাসু ছিলেন। ফুল খুব পছন্দ করতেন। তাঁর বাসা ও হাজি শরীয়তুল্লাহ ইয়াতিমখানা তিনি মনের মত করে ফুল বাগান দিয়ে সাজিয়েছেন। তিনি বাগানে নিজ হাতে পানি দিতেন ও পরিচর্যার জন্য তাঁর লোকদের প্রতি জোর তাগিদ দিতেন।

এই মানুষটি কতখানি জননন্দিত ছিলেন তা বোঝা যায় তাঁর জানাযায় মানুষের ঢল দেখে। তিনটি জায়গায় তাঁর জানাযা হমিরপুর তাঁর এলাকায় বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাসদসহ সব দলের নেতারা উপস্থিত থেকে বক্তব্য রেখেছেন। সর্বস্তরের মানুষ তাঁর জানাযায় শরীক হয়েছেন। তিনি নিজেও জানাযার খবর পেলে সব কাজের মধ্যে সেটাকে অগ্রাধিকার দিতেন। গত ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ ঝুঁকি নিয়েই তিনি আমার আব্বার জানাযায় উপস্থিত হন এবং বক্তব্য রাখেন। আমার বন্ধু হিসেবে তিনি আমার আব্বাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন এবং আমার আব্বাও তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। পারিবারিকভাবে আমরা ছিলাম খুবই কাছের। পুলিশের ভয়ে বেশ কয়েক মাস তিনি বাসায় থাকতে না। তিনি হার্টের অসুখে ভুগছিলেন। ভালো মত চিকিৎসারও সুযোগ হয়নি। তদুপরি ছিল নানাবিধ যন্ত্রণা। তিনিসহ ইসলামপন্থী সকল জনগোষ্ঠীই আজ নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তাঁর জীবনটা অতিবাহিত হয়েছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন তাঁর এ বান্দাহর সকল খেদমতকে কবুল করে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা দান করেন। আমিন। 27/03/2015  ৩১ মার্চ ২০১৫ দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত।

Comments