আমি যখন পৃথিবীতে ছিলাম তখন আমি আমার পরিবার, আমার দল,
সমাজ ও রাষ্ট্র সবার কাছেই আমি ছিলাম অপরিহার্য। আমার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি,
আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পতিবেশি, অফিসের লোকজন আমাকে ছাড়া কোন কিছু ভাবতেই পারতো না।
আমার দল আমাকে নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখতো। আমি চতুর্দিকে শুধুই প্রশংসা শুনতাম।
কিন্তু যেদিন আমার রুহটা বেরিয়ে গেল সেদিন থেকে আমি মূল্যহীন। সবাই ব্যস্ত হয়ে
উঠলো কত দ্রুত দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা যায়। সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজন দ্রুত
আমাকে ঘর থেকে বের করে আনলো। আমার স্ত্রী যার সঙ্গে সুদীর্ঘকাল একত্রে বসবাস
করেছি, আমাকে আর আমার বিছানায় রাখতে চাইলো না। দ্রুত গোসলের মাধ্যমে জানাযার জন্য
প্রস্তুত করা হলো। আমার নিজের ও দলের জনপ্রিয়তা জাহির করার জন্য বিশাল ময়দানে
জানাযার ব্যবস্থা করা হলো। অনেক জাতীয় ও স্থানীয় নেতারা আমার প্রশংসা করে বক্তৃতা
করলো। তারপর দাফন-কাফন শেষে সবাই আমার কাছ থেকে বিদায় নিল। শুরু হলো আমার
জবাবদিহিতা। আমি লা জবাব। ফেরেশ্তাদের হাতুড়ীপেটা থেকে বাঁচানোর জন্য কেউ আর এগিয়ে
আসলো না। পুলিশী রিমান্ডে মার আর কী? বড় ভয়ঙ্কর সে শাস্তি। আমি নিজেও অনেককে ধরে
শাস্তি দিয়েছি। তার চিৎকারে আমি থেমে গিয়েছি। আমাকে যে ফেরেশ্তারা শাস্তি দিচ্ছে
তারা কেউ কানে শুনে না। আমার চিৎকার যদি দুনিয়ার মানুষ শুনতো তাহলে সবাই বেহুঁশ
হযে পড়তো। আমাকে শোনানো হলো এখন যে শাস্তি দেয়া হচ্ছে তা নাকি খুবই মামুলি। আসল
শাস্তি হবে বিচারের পর। আমার তো ইতিবাচক কোন কাজ ছিল না। ফেরেশ্তারা জিজ্ঞাসাবাদ
করবে এবং একটি বিশেষ দিনে আমার বিচার হবে তা আমি কখনই বিশ্বাস করতাম না।
আলেম-উলামা ও ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা যা বলেছে তা কখনো শুনতে চাইনি এবং
যাতে কেউ শুনতে না পারে সে জন্য ছিল আমার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। তাফসির মাহফিল,
কুরআনের আলোচনা তা যদি মহিলারা একত্রে বসে করে, তা শুনলেও আমার মাথায় খুন চড়ে যেত।
আমার সব অপকর্ম আজ মনে পড়ছে। চাপাবাজি সব শেষ। কবর থেকেই প্রকৃত সত্য উম্মোচন হয়ে
গেছে। আজ মিথ্যার আবরণে সত্যকে ঢেকে রাখলেও তা সবই প্রকাশ হয়ে পড়ছে।
আমি আমার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে অত্যন্ত ভালোবাসতাম।
তাদের আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য আমার চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। এক সময়
আমার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের চাহিদা বাড়তে থাকে। প্রথমের দিকে দামী শাড়ী, গহনা বা
একটু ঘুরে বেড়ানো থাকলেও পরবর্তিতে ফ্লাট, প্লট, ব্যাংক-ব্যালেন্স এবং এক পর্যায়ে
মালোয়েশিয়া ও কানাডায় বাড়ী কেনার দাবী উঠতে থাকে। আমিও সকল সীমা অতিক্রম করতে থাকি। প্রথমের দিকে নিরীহ লোকদের ধরে এনে
রিমান্ডের ভয় দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছি। এ দ্বারা আমার পরিবারের চাহিদা
পূরণ না হওয়ায় কন্টাক্টে গুম-খুনে আমি মেতে উঠি। এক পর্যায়ে এক সঙ্গে সাত জনকে
হত্যা করে লাশ গুম করতেও আমার হাত কাঁপেনি বা বিবেকে বাধেনি।
দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন, পদোন্নতি ও ভালো জায়গায় পোস্টিং-এর জন্য আমি কি না
করেছি? মানুষকে বাধ্য করেছি মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে আমি কসাই
বানিয়েছি এবং শ্লোগান তুলেছি ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই। তার মুখচ্ছবি বলে দেয় তিনি
আল্লাহর একান্ত অনুগত একজন শরীফ মানুষ। তিনি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র। কসাই খ্যাত কোন খুনি
স্বাধীনতাত্তোর ঢাবিতে লেখাপড়া করা সম্ভব নয়, তা জেনে ও বুঝেও স্রেফ বৈষয়িক
স্বার্থে আল্লাহর এ প্রিয় বান্দাহকে ফাঁসিতে ঝুলানোয় আমার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
শুধু কি তাই? দেশ বরেণ্য আলেম, শীর্ষ ইসলামী চিন্তাবিদ ও নেতৃবৃন্দের চরিত্রহনন ও
শাস্তি দানের জন্য আমি আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়েছি। বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের নেতা
যাঁর নুরানি চেহারা, কথা ও লেখনী মানুষকে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ করে; সেই
মানুষটিকে স্রেফ রাজনৈতিক বিদ্বেষের কারণে আমি বলেছিলাম যে, এই লোকটিই সকল
খুন-ধর্ষণ ও অপকর্মের হোতা এবং আমি তার ফাঁসি চাই। অথচ এ দেশের সর্বোচ্চ আদালত
একবার বলেছিল তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কোন অপরাধ প্রমাণিত নয়। খুন-ধর্ষণের মত
জঘন্য অপরাধ কোন আল্লাহভীরু ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়, তা জানা সত্ত্বেও আমি আমার
দলের নেতা-নেত্রীর মন জয় করার জন্য বারবার মিথ্যা বলেছি এবং অপরকে বলতে বাধ্য
করেছি। আমি যা বিশ্বাস করিনি (যারা ঈমানদার নর ও নারিকে কষ্ট দেয়; অত:পর তাওবা করে
না, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি-সূরা বুরুজ) তাই আজ
সত্যে পরিণত হয়েছে। এখন আর আমার কোন সাহায্যকারী নেই।
কবরে শাস্তি দেয়ার সাথে সাথে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় জাহান্নামের কিনারায়
আমাকে হাজির করানো হয় যা আমার স্থায়ী বাসস্থান। তা যে কত ভয়ঙ্কর তা আমি বুঝাতে
পারবো না। আমি দুনিয়ায় আল্লাহভীরু অনেক ছাত্র-যুবককে
ট্রাক থেকে ফেলে দিয়ে বা ট্রেনের নিচে ফেলে হত্যা করে লাশ যত্রতত্র রেখে দিয়েছিলাম।
আজ আমার মনে পড়ছে বিচারের পর ফেরেশ্তারা টেনে-হেঁচড়ে বড় অপমানের সাথে আমাকে
জাহান্নামে ছুঁড়ে মারবে। সেদিন আমার স্ত্রী, আমার সন্তান-সন্ততি, আমার দলের
নেতৃবৃন্দ, আমার উর্দ্ধতন বস সবাই আমার থেকে পালিয়ে থাকবে এই ভয়ে যে, না জানি আমি
আমার এ অপকর্মের জন্য তাদেরকেও দায়ী করে বসি। আমার সবচেয়ে কষ্ট লাগবে তখন যখন বেহেশ্তের সুরম্য অট্টালিকার
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে যাদেরকে আমি অত্যাচার-নির্যাতন করেছি, অপমান করেছি তারা আমাকে বলবে, ‘আমার রবের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আমি পূর্ণ
বদলা পেয়েছি এবং আমি আমার রবের প্রতি সন্তুষ্ট; তুমি তোমার বদলা পেয়েছ তো’। এ
অপমান অসহ্য হলেও আমার কোন উপায় নেই। আমার কোন বন্ধু-সৃহৃদ সেদিন আমার কোন উপকারে আসবে না। ২৯/০৩/২০১৫
Comments
Post a Comment