Skip to main content

আমার আব্বা : একজন দায়ী ইলাল্লাহ



আমার আব্বা মরহুম মো. লুৎফর রহমান ১৯৩২ সালের ১ জানুয়ারি কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত ভেড়ামারা থানার অধীন গাছিয়া দৌলতপুর গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হারান প্রামাণিক ও মাতার নাম রজদা খাতুন। তিনি চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন।
গ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় বেশ বিলম্বে তাঁকে পার্শ্ববর্তী ঠাকুর দৌলতপুর গ্রামের স্কুলে ভর্তি করানো হয়। ফলে সার্টিফিকেটের বয়সের তুলনায় তাঁর বয়স একটু বেশিই হবে। ধর্মপ্রাণ দরিদ্র পিতা ছেলেকে আলেম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরবর্তিতে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। তিনি ১৯৪৮ সালে বগুড়া থেকে প্রথম বিভাগে হাই মাদ্রাসা (এসএসসি সমমান) পাস করেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তাঁর আর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। তিনি ১৯৪৮ সালে বাহাদুরপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৯ সালে ইসলামপুর গ্রামের মরহুম আব্দুল মজিদ সরদারের দ্বিতীয় কন্যা তোহুরা খাতুনের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫১ সালে পিটিআই পাস করেন। মাদ্রাসা থেকে পাস করলেও স্কুলে তিনি ছিলেন মূলত একজন ইংরেজি শিক্ষকবাংলা, ইংরেজি ও আরবী বিষয়ে পারদর্শী শিক্ষক হিসেবে তিনি অত্যন্ত সফল ছিলেন। স্কুলে তিনি পন্ডিত সাহেব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর হাতের লেখাও ছিল ভারি সুন্দর। শিক্ষকতার মাঝে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে কৃতিত্বের সাথে ১৯৬৭ সালে আইএ, ১৯৭২ সালে বিএ এবং ১৯৭৬ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮২ সালে তিনি নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। আমি আমার আব্বার কাছে শুনেছি ১৯৭০ সালে কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে তিনি ডিগ্রি পার্ট-১ (বাংলা ১ম ও ইংরেজি ১ম পত্র) পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং সে পরীক্ষায় তিনি বাংলায় ৬২ ও ইংরেজিতে ৪২ পেয়েছিলেন। কলেজে তাঁর নম্বরই ছিল সর্বোচ্চ এবং ইংরেজিতে কারো নম্বর নাকি ৩৩-এর বেশি ছিল না।। ডিগ্রিতে তাঁর আরবী সাহিত্য ছিল এবং তাতে লেটার মার্ক ছিল। উচ্চ মাধ্যমিকেও তাঁর আরবী সাহিত্য ছিল। দীর্ঘ ২৬ বছর বাহাদুরপুর হাই স্কুলে শিক্ষকতার পর ১৯৭৪ সালে তিনি দামুকদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৬ সনের ৩১শে ডিসেম্বর সুদীর্ঘ ৪৮ বছর শিক্ষকতা শেষে অবসর গ্রহণ করেন।
পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সংস্পর্শে আসেন। এ ব্যাপারে গোলাপনগর গ্রামের মরহুম হারেজ মৌলভীর নাম স্মরণ করতে হয়। আমার আব্বা একজন খুব ভালো মানের পাঠক ছিলেন। তিনি মাওলানা মওদূদী (র.) ও মাওলানা আব্দুর রহীম (র.) সাহেবদ্বয়ের রচনাবলীর খুব ভক্ত ছিলেন। মাওলানা আব্দুর রহীম সাহেবের সুন্নাত ও বিদয়াত বইটি ছিল তাঁর খুবই পছন্দের। ইসলামী আন্দোলনকে জানা-বোঝার সাথে সাথে শিরক ও বিদয়াতকে তিনি অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। তাফহীমূল কুরআন অধ্যয়ন তাঁর প্রাত্যহিক কাজের অংশ ছিল এবং তাতে তিনি খুব আনন্দ পেতেন। মাওলানা সদরুদ্দিন ইসলাহী (র.) সাহেবের লেখা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ এবং সাইয়েদ কুতুব (র.)-এর ইসলামের সমাজ বিপ্লবের ধারা বইসমূহ তাঁর পছন্দের তালিকায় ছিলপরবর্তিতে তিনি জামায়াতের রুকন হন এবং এক পর্যায়ে ভেড়ামারা থানার আমীর নির্বাচিত হন। বার্ধক্যজনিত কারণে পরে তিনি বাহাদুরপুর ইউনিয়নকেন্দ্রিক দাওয়াতি কাজ ও আর্ত-মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। দাওয়াতি কাজে লেখনীকে তিনি চমৎকারভাবে ব্যবহার করেন। তিনি মানুষের মধ্যে প্রচুর বই বিশেষ করে তাফহীমূল কুরআন বিতরণ করেন। তাঁর হাতে সব সময় দাওয়াতি বই থাকতো এবং তিনি ছোট ছোট প্রবন্ধ লিখে তা মানুষকে পড়ানোর জন্য প্রদান করতেন। তাঁর লেখা বই ‘মজবুত ঈমানের চেতনা’, ‘আল কুরআনের বাছাইকৃত আয়াতগুচ্ছ’ ও ‘নাজাতের পথ’ তিনি ব্যাপকভাবে বিলি করতেন। হাতখরচের জন্য তাঁর সন্তানরা তাঁকে নিয়মিত কিছু অর্থ প্রদান করতেনতা তিনি দু:স্থ মানুষের সেবা ও দ্বীনের পথেই খরচ করে গেছেন। আর্ত-মানবতার সেবায় ২০০২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাহাদুরপুর ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ। সুদীর্ঘকাল সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ সনে সেক্রেটারি পদ থেকে অব্যাহতি নিলে তাঁকে প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা করা হয়। বাহাদুরপুর ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতি বছর শীতকালে শীতবস্ত্র (লেপ-কম্বল-চাদর) বিতরণ এবং রমযান মাসে রোযাদারদের জন্য চাল, ডাল, মুড়ি, চিঁড়া, চিনি এবং ঈদের সময় সেমাই-চিনি-আটা ও কুরবানি ঈদে গোশ্ত, শাড়ী-লুঙ্গি বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া সেনেটারি ল্যাট্রিন, টিউবওয়েল ও ঘরের টিন ক্রয়ে সহযোগিতা প্রদান করা হয়। দায়িত্ব পরিবর্তন হওয়ার পরও এ সব কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। শেষের দিকে চলাফেরায় তাঁর সমস্যা হলেও ভ্যানে চড়ে আত্মীয়-স্বজন ও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তিনি দাওয়াত পৌঁছাতেন। তিনি তাঁর পুত্রবধু ও মেয়েদেরকে নিয়ে বাড়ীতে নিয়মিত দ্বীনি তালিম করতেন। ইসলামী আন্দোলনে ব্যয়টাকে তিনি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেন। সূরা হাদিদে আল্লাহর পথে খরচের আয়াতসমূহ মানুষের সামনে পেশ করে বেশি বেশি দানের জন্য তিনি উদ্বুদ্ধ করতেন। অসুস্থতাবস্থায় তাঁর সাথে কেউ সাক্ষাত করতে গেলে দ্বীনের পথে বেশি বেশি কাজ করার জন্য তিনি তাগিদ দিতেন। তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের জন্য ২১ দফা অসিয়ত করে গেছেন। শেষ দফা দু’টি হলো-(২০) আমার মৃত্যুর পর মৃত্যুসংবাদ মাইকে প্রচার করবে না এবং খুবই সাধারণ কাপড়ে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করবে। মৃত্যুর পর কোন খানা-পিনার ব্যবস্থা করবে না এবং বিশেষ দিনে বা মৃত্যুবার্ষিকীতেও কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে না। একান্ত কিছু করতে চাইলে কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই দরিদ্র মানুষদের মাঝে-মধ্যে খাওয়াবে। (২১) সূরা আন নিসার ১১ নং আয়াত মনোযোগ সহকারে পড়ে ও বুঝে আমি অসিয়ত করছি যে আমার সম্পদ থেকে আমার মৃত্যুর পর বিধবা ও মিসকিনদের কল্যাণার্থে বাহাদুরপুর ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদে এককালিন ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার) টাকা দান করবে।
আমার আব্বা ২৭শে জানুয়ারি ২০১৫ মঙ্গলবার রাত ১১-০০ নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন)। মৃত্যুকালে তিনি চার ছেলে, পাঁচ মেয়ে, সাতাশ জন নাতি-নাতনী এবং অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ২৮ তারিখ বাদ জোহর নামাযে জানাযা শেষে তাঁকে গাছিয়া দৌলতপুর গোরস্তানে সমাহিত করা হয়। ছয় গ্রামের মুসলমানদের উদ্যোগে ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত বিশালায়তনের এ গোরস্তানের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন আমার আব্বা এবং সেখানকার ঈদজামাতের তিনি ছিলেন ইমাম। সুদীর্ঘকাল তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অসিয়ত মোতাবেক কোন মাইকিং ছাড়াই নামাযে জানাযায় সংগঠনের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও তাঁর অগণিত ছাত্র-গুণগ্রাহীর উপস্থিতিতে বিশাল ঈদগাহ ময়দান পূর্ণ হয়ে যায়। তাঁর অসিয়ত মোতাবেক আমাকে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। জানাযার পূর্বে বক্তব্য রাখেন সাবেক এমপি ও জামায়াতের সাবেক জেলা আমীর জনাব আব্দুল ওয়াহেদ (মরহুম), বর্তমান আমীর অধ্যক্ষ খন্দকার আলী মুহসিন, ভেড়ামারা উপজেলা চেয়ারম্যান এড. তৌহিদুল ইসলাম এবং আমি আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে আমার আব্বার জন্য দোয়া চাই। তাঁর অসিয়ত মোতাবেক আমরা কোন দোয়া অনুষ্ঠান বা খানাপিনার আয়োজন করিনি এবং বাহাদুরপুর ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদে আমার মা’র জন্যসহ ১০০,০০০/- (এক লক্ষ) টাকা আমরা জমা দিয়েছি। এ ছাড়া ইয়াতিমখানা ও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের এক বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা এবং বাহাদুরপুর ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের মাধ্যমে ১০০ ও আমাদের প্রতিবেশী ২৫ জনসহ মোট ১২৫ জন দু:স্থ মানুষের মধ্যে তিন কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়। এর সাথে আমরা তাঁর ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী ও নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজন মিলে দুই খতম কুরআন পড়ে নিজেরা আল্লাহর কাছে তা পেশ করেছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন আমাদের ভাই-বোন ও আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে  দোয়াকারী সন্তান হিসেবে কবুল করে নেন। আমিন। ২৮/০৩/২০১৫




Comments