জুমা আলোচনাপ
রানখালী উত্তরপাড়া জামে মসজিদ
তারিখ : ১৬.১২.২০২২
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। যাদের আত্মদানের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ ও মাগফেরাত কামনা করি সেইসব বীর শহিদদের এবং যারা বেঁচে আছে তাদের সুস্থতা কামনা করি। সাথে সাথে শহিদ পরিবারসমূহের সার্বিক কল্যাণ কামনা করি।
আমি গ্রামের কয়েকটি মসজিদে জুমা আদায় করলাম। অধিকাংশ মসজিদে মুসল্লিরা অনেক বিলম্বে আসেন। অথচ জুমার দিন আমাদের ইদের দিন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠতম দিন। আজানের পরপরই আমাদের উচিত আল্লাহর ঘরে উপস্থিত হওয়া। আজানের পরে জুমার নামাজ ও খুতবা শ্রবণ ছাড়া আমাদের আর কোনো কাজ নেই। শুধু বেচা-কেনা নয়, কোনো কাজই জায়েজ নয়। মসজিদে আগমনের ভিত্তিতে সওয়াব লেখা হয়। পর্যায়ক্রমে আগমনের ফলে উট, গরু, ছাগল কুরবানির সওয়াব মুসল্লিদের আমলনামায় লেখা হয়। আপনাদের পক্ষে কি সম্ভব একটি উট কুরবানি করার? অথচ একটু সতর্ক হলে সহজেই উট কুরবানির সওয়াব পেতে পারেন। খতিব মহোদয় যখনই মিম্বরে আরোহন করেন তখনই ফেরেশতারা সওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শোনা শুরু করেন। তাই সাড়ে বারোটায় আজান হওয়ার সাথে সাথে আপনারা মসজিদে চলে আসবেন। ঢাকায় অনেক মসজিদ রয়েছে যেখানে সাড়ে বারোটার পূর্বেই মসজিদ পূর্ণ হয়ে যায়। এই মসজিদে ১.০০ থেকে আলোচনা, এরপর খুতবা এবং নামাজ। জুমার দিনে আপনাদের কাজই হবে খুতবা শ্রবণ ও নামাজ আদায়। প্রয়োজনীয় সুন্নত নামাজ আদায় শেষে সর্বদা প্রথম কাতারে বসার চেষ্টা করবেন। প্রথম কাতারে বসা প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, প্রথম কাতারে দাঁড়ানোয় কতো সওয়াব তা যদি মুসল্লিরা বুঝতো তাহলে লটারি করা লাগতো।
আল্লাহপাক সদাচরণ পছন্দ করেন। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও (মহান আল্লাহ) তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন। ছোট- বড়ো, ধনি-গরিব সবার সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। সদাচরণের সবচেয়ে বড়ো হকদার হলেন আপন পিতা-মাতা। সুরা বনি ইসরাইলে আল্লাহপাক বলেছেন, পিতা-মাতা উভয়ই বা কোনো একজন যদি বার্ধক্যে উপনীত হন তাহলে উহ্ শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করো না। তাদের সাথে সবসময় নম্র আচরণ করিও। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি প্রসন্নচিত্তে তাকালে কবুল হজের সমান সওয়াব পাওয়া যাবে। একদিন মিম্বরে আরোহনের সময় রসুলুল্লাহ সা. আমিন, আমিন, আমিন বলেন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রসুলুল্লাহ সা.! আপনি আমিন, আমিন, আমিন বলছেন কেন? জবাবে বলেন, এইমাত্র জিবরাইল আ. আমাকে বলে গেলেন, যে ব্যক্তি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পেল অথচ তাদের খেদমত করে জান্নাত লাভ করতে পারলো না সে যেন ধ্বংস হয়, আমি বললাম- আমিন (দীর্ঘ হাদিসের অংশ)। যাদের বাবা-মা বেঁচে আছেন, তারা বড়ো ভাগ্যবান। আর যাদের বাবা-মা মারা গেছেন তারাও বাবা-মার খেদমত করতে পারেন। যে কোনো ভালো কাজ করে আল্লাহকে বলুন, হে আল্লাহ! তুমি এর সওয়াব আমার পিতামাতার আমলনামায় দান করো। ফলে এর সওয়াব পিতা-মাতার সাথে সাথে আপনিও পাবেন। আল্লাহপাকের শেখানো দোয়া তো রয়েছেই ‘রব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা’- এই দোয়া ব্যর্থ হবার নয়। কবুল হবেই- যিনি শেখাচ্ছেন তাঁরই কাছে করা দোয়া। বেশি বেশি করে দোয়া করবেন। পিতামাতার খেদমতের ব্যাপারে কুরআন-হাদিসে নানাভাবে বলা হয়েছে। তাদের খেদমতে রয়েছে জান্নাত অন্যথায় ঠিকানা হবে জাহান্নাম।
মানুষকে ক্ষমা করুন বিনিময়ে আপনিও আল্লাহর ক্ষমা পাবেন। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে তার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করবে আল্লাহপাক কেয়ামতের দিন তার অপরাধ ক্ষমা করবেন। হ্যাঁ, কারো প্রতি যদি জুলুম করা হয় তাহলে তার প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার তার রয়েছে, তবে প্রতিশোধ হবে সমপরিমাণ। আর যদি ক্ষমা করা হয় ও সংশোধন করে নেয়া হয় তাহলে তার পুরস্কার আল্লাহর জিম্মায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার প্রদান অর্থই হলো ক্ষমা করা ও জান্নাতে স্থান দেয়া। মানুষকে ক্ষমা করা জান্নাতে যাওয়ার একটি সহজতম উপায়। প্রতিশোধ গ্রহণ নয়, ক্ষমা করুন বিনিময়ে সহজে জান্নাত পাবেন।
গিবত যে গুনাহের কাজ তা লোকজন ভুলেই গেছে। তাই একত্র হলেই একে অপরের নিন্দা করে। গিবত জেনা অপেক্ষাও জঘন্য। আমরা জেনাকে ঘৃণা করি কিন্তু গিবতকে সেভাবে মনে করি না। আল্লাহপাক গিবতকে মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। গিবত হলো মানুষের মধ্যে দোষ রয়েছে সেটি অপরের কাছে প্রকাশ করে তাকে হেয় করা, অপমান করা। অথচ রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে তার ভাইয়ের দোষ গোপন রাখবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন। দোষ গোপনকারীর জন্য কত বড়ো সুসংবাদ!
মানুষের প্রতি জুলুম করাকে আল্লাহপাক হারাম করেছেন। সুরা হুমাজায় তিনি কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে। মানুষকে যারা হেয় করে, চড়-থাপ্পড় মারে, গালাগাল করে, অপমান করে এবং অসাক্ষাতে নিন্দা করে- এরা কেউ আল্লাহর বান্দা হতে পারে না। এদের পরিণতি হুতামা, আল্লাহর আগুন প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত- উৎক্ষিপ্ত। আমার জানা মতে আল্লাহপাক জালেমের প্রতি চরম ক্রোধ প্রকাশ করতে গিয়ে এই একটি জায়গায় জাহান্নামকে আল্লাহর আগুন বলেছেন। মনে রাখবেন, জালেমের জন্য জান্নাতে এক ইঞ্চি পরিমাণ জমিও বরাদ্দ নেই যদি তওবা না করে|
আমাদের দেশে হিংসার চাষ হয়। হিংসা আছে পরিবারে, আত্মীয়-স্বজনের মাঝে, সমাজে, রাজনীতির অঙ্গনে, এমনকি আলেম সমাজের মাঝেও। আপনারা যদি জান্নাতের প্রত্যাশী হন তাহলে অবশ্যই হিংসামুক্ত হয়ে জীবন যাপন করতে হবে। হিংসা শুধু কবিরা গুনাহ নয়, হিংসা মানুষের নেক আমল ধ্বংসকারী কঠিন অপরাধ। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের সকল নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। সমাজে মারামারি, গুম-খুন ও গিবতের মূল কারণ হিংসা। শবে কদরসহ বিশেষ বিশেষ রাতে আল্লাহপাক তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন এবং এই সাধারণ ক্ষমা থেকে বাদ পড়ে সেই হতভাগা যে শিরক করে ও হিংসা করে। হিংসুক আল্লাহর কাছে খুবই ঘৃণিত এবং সুরা ফালাকে আল্লাহ হিংসুকের অনিষ্ট থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন। যার অন্তরে হিংসা আছে সে বড়ো সংকীর্ণমনা, সে মানুষকে ক্ষমা করতে জানে না।
আপনাদের সম্মুখে একটি ঘটনা বলতে চাই যা আপনাদেরকে সহজে জান্নাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রেরণা হতে পারে। মদিনার মসজিদে রসুলুল্লাহ সা. সাহাবিদের সাথে করে বসে আছেন, এমন সময় এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করলে তিনি তার প্রতি দৃষ্টি দিয়ে সাহাবায়ে কেরাম রা.-দের বলেন, এই মুহূর্তে যে লোকটি প্রবেশ করছে সে জান্নাতি। এভাবে তিনি পরপর তিনদিন একই ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন যে, সে জান্নাতি। রসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক সুসংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তি সম্পর্কে একজন সাহাবির জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তিনি তার ঘরে তিনদিনের জন্য মেহমান হন। এই তিনদিন তিনি তাঁর মাঝে বাড়তি কিছুই লক্ষ করেন না, একেবারে স্বাভাবিক জীবন। শেষে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, রসুলুল্লাহ সা. পরপর তিনদিন আপনাকে জান্নাতি বলে ঘোষণা দিলেন অথচ আপনার মাঝে বাড়তি কোনো আমলই লক্ষ করলাম না। জবাবে সেই সাহাবি বললেন, ভাই- আমি তো এমন কোনো আমল করি না যা দ্বারা এভাবে সম্মানিত হবো। তবে প্রতিদিন ঘুমানোর পূর্বে দোয়া-দরুদ পড়ার পর সবাইকে ক্ষমা করে দেই, কারো প্রতি কোনো হিংসা-বিদ্বেষ রাখি না। তখন সেই সাহাবি বললেন, আপনার এই হিংসামুক্ত জীবন ও ক্ষমাশীলতাই আপনাকে এতো মর্যাদাবান করেছে।
আমি এই গ্রামেরই সন্তান। আপনাদের মধ্যে যারা বয়স্ক তাদের সাথে আমার জানাশোনা রয়েছে। আমি মরহুম মো. লুৎফর রহমানের বড়ো সন্তান। আপনাদের খুবই পরিচিত একান্ত আপনজন মরহুম মওলা বক্স চাচাকে আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ও তাঁর মাগফেরাত কামনা করি। আমার আব্বা ছয় গ্রামের মানুষের গড়া ইদগাহে সুদীর্ঘকাল ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর মরহুম মওলা বক্স চাচা দায়িত্ব পালন করেছেন এবং মৃত্যুর পরও তাঁরা দু’জন পাশাপাশি শায়িত আছেন।
এটা নিশ্চিত যে, আর কোনো নবি-রসুল আসবেন না। মুহাম্মদ সা. শেষ নবি ও শ্রেষ্ঠতম নবি। কিন্তু নবি সা.- এর উত্তরাধিকার (ওয়ারিস) রয়েছেন এবং সেই উত্তরাধিকার হলেন আলেম সমাজ। আলেমদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ করবেন। তাদেরকে অসম্মান বা কষ্ট দেয়া মূলত আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে কষ্ট দেয়ার শামিল।
কোনো মানুষকে অহেতুক কষ্ট দেয়া মূলত আল্লাহকেই কষ্ট দেয়া। মানুষকে কষ্টদানকারী জালেমকে আল্লাহ তায়ালা বড়ো শক্তভাবেই ধরবেন। তার কোনো রেহাই নেই। আর মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার আল্লাহরই সাথে ভালো ব্যবহার। মানুষ তো আল্লাহরই প্রতিনিধি। আমরা কবিতা পড়েছি, হাশরের দিন বিচারে বসিয়া সুধাবে জগতস্বামী- তুমি মোরে করো নাই সেবা যবে রুগ্ন যে ছিলাম আমি। এটি আসলে হাদিসের বাণী। অর্থাৎ হাশরের দিন আল্লাহ বলবেন- আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি খাবার দাওনি, আমি পিপাসার্ত ছিলাম, তুমি পানি পান করাওনি এবং আমি অসুস্থ ছিলাম তুমি সেবাযত্ন করোনি। মানুষ বলবে, এটি কেমন করে সম্ভব? আল্লাহ বলবেন, আমার বান্দাকে খাওয়ালে, পান করালে ও চিকিৎসা করালে আজ আমাকে পেতে। ঠিক তেমনি মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে, কষ্ট দিলে, জুলুম করলে আল্লাহরই সাথে করা হয়।
আসুন, আমরা হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে এবং একে অপরকে ক্ষমা করার মধ্য দিয়ে পরস্পর মিলেমিশে বসবাস করি। আল্লাহপাক আমাদের সাহায্য করুন।
Comments
Post a Comment